স্বাধীন বাংলা বেতার-২৫ মে
চরমপত্র
চরমপত্র, বিশেষ ব্যঙ্গ রচনা, চরমপত্র লিখতেন এবং পড়তেন এম আর আখতার মুকুল। অনুষ্ঠানটি পরিকল্পনা করেছিলেন আবদুল মান্নান এমএনএ। নামকরণ করেছিলেন আশফাকুর রহমান খান। অনুষ্ঠানটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। যার শুরু ২৫ মে এবং শেষ ১৬ ডিসেম্বর।
ঢাকা শহর ও নারায়ণগঞ্জ থেকে ভয়ানক দুঃসংবাদ এসে পৌঁছেছে। গত ১৭ এবং ১৮ মে তারিখে খোদ ঢাকা শহরের দুই জায়গায় হ্যান্ডগ্রেনেড ছোড়া হয়েছে। এসব জায়গার মধ্যে রয়েছে প্রাদেশিক সেক্রেটারিয়েট, স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তান, হাবিব ব্যাংক, মর্নিং নিউজ অফিসে, রেডিও পাকিস্তান আর নিউমার্কেট। পাকিস্তানি হানাদার সৈন্যদের দখলকৃত ঢাকা নগরীতে মুক্তিফৌজদের এ ধরনের গেরিলা তৎপরতা সামরিক জান্তার কাছে নিঃসন্দেহে এক ভয়ংকর দুঃসংবাদ বৈকি।
তবে পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ সদম্ভে ঘোষণা করেছিল যে ঢাকা নগরী সম্পূর্ণ করায়ত্ত আর জীবনযাত্রা ‘স্বাভাবিক’ হয়ে গেছে। তাহলে মুক্তিফৌজদের এ ধরনের কাজকর্ম সম্ভব হচ্ছে কীভাবে? এ ছাড়া ঢাকা শহরে এর মধ্যেই নাকি মুক্তিফৌজের পক্ষ থেকে প্রচারপত্র পর্যন্ত বিলি করা হয়েছে। এই না বলে প্রশাসনব্যবস্থা আবার চালু করা হয়েছে? তাহলে পাকিস্তানি জেনারেলদের নাকের ডগায় কীভাবে মুক্তিফৌজওয়ালারা প্রচারপত্র বিলি করতে পারে? আপনাদের ‘অশান্তি কমিটি’, মাফ করবেন, তথাকথিত ‘শান্তি কমিটির’ তথাকথিত নেতৃবৃন্দ করে কী? এদের যেটি করে Active করতে পারেন না? জনসাধারণের ওপর নাকি এদের দারুণ প্রভাব? এদের অঙ্গুলি হেলনে নাকি বাংলাদেশ ওঠাবসা করছে!
না, না, না ও ব্যাপারে আপনারা কিসসু চিন্তা করবেন না। আপনারা ভুল করে একটা সাধারণ নির্বাচন নিজেদের তত্ত্বাবধানে করিয়েছিলেন। আর সেই নির্বাচনে আপনাদের গোঁ ধরা নেতাদের জন্য সব বাঙালি ‘বিশ্বাসঘাতকতার’ জন্য হেরে গেছে। বাংলাদেশের ভোটাররা সব মহাপাজি—একেবারে পাজির পাঝাড়া। না হলে কক্সবাজারের ফরিদ আহমেদ, সিলেটের মাহমুদ আলী, চট্টগ্রামের ফ কা চৌধুরী, ঢাকার খাজা খয়েরউদ্দিন, মোহাম্মদপুরের গোলাম আযম, আর পাকিস্তান অবজারভার হাউসের মাহবুবুল হকের মতো নেতারা নির্বাচনে হেরে যায়? আর নির্বাচনে এরা হারলেই বা কী আসে যায়—এরা তো এক একজন বিরাট দেশপ্রেমিক। আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধররা এদের নাম চমৎকারভাবে মীরজাফরের সঙ্গে পড়ে মুখস্থ রাখবে—তাই না?
যাক, যা বলছিলাম। ব্রাদার মিঠঠা খান, সরি জেনারেল মিঠঠা খান—একেই তো দুই মাসের যুদ্ধে তোমার প্রায় হাজার কয়েক সৈন্য মারা গেছে, তার ওপরে আবার বাংলাদেশ, দখলের যুদ্ধেরও সমাপ্তি ঘটাতে পারোনি। এবার খোদ শহরেই মুক্তিফৌজ ছোকরাদের গেরিলা অ্যাকশন! তাহলে কি বুঝব তোমার সৈন্যরা মুক্তিফৌজ যোদ্ধাদের সামান্যতম ক্ষতি পর্যন্ত করতে পারেনি।
ওকি আঁতকে ওঠো না! ঢাকার আরমানিটোলা আর কুর্মিটোলার সামরিক ছাউনির কাছে আজমপুর গ্রামে গেরিলারা যে টহলদার হানাদার সৈন্যদের হত্যা করেছে, সে কথা কাউকে জানাবা না। কেমন কি না, এবার খুশি হয়েছ তো! মরুভূমির উটপাখির মতো তুমি মুখটা বালুর মধ্যে লুকিয়ে ফেলো, কেউই তোমাকে দেখতে পাবে না।
ছি ছি ছি। এতে লজ্জার কী আছে? খোদ ঢাকাতেই যখন গেরিলা অ্যাকশন শুরু হয়েছে, তখন নারায়ণগঞ্জেও যে একটু বড় আকারে ওসব হবে, তাতে সন্দেহ নেই। তাই নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীর ওপরে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন সংস্থার টার্মিনালটার ক্ষতি একটু বড় রকমেরই হয়েছে। যাক লে. জেনারেল নিয়াজি এর মধ্যেই সামরিক হেলিকপ্টারে বাংলাদেশের কয়েকটা শহর সফর করে হানাদার সৈন্যদের মনোবল তৈরির চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তিনি যে আবার কয়েকটা খারাপ সংবাদ নিয়ে এলেন। বর্ষার আগেই হানাদার সৈন্যরা ক্যান্টনমেন্টে ফিরে যাবার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছে। কেননা মুক্তিফৌজের চোরাগোপ্তা মারের চোটে ওরা ছোট ছোট দলে টহল দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। বাংলাদেশের নদীর সাইজ দেখেই নাকি ওরা ভিরমি খেয়ে পড়েছে।
মিঠঠা খান ভাইয়া। শুনলেও হাসি পায়। ঢাকার কাছে পাগলাতে তোমার নির্দেশেই তো হানাদার সৈন্যরা সাঁতার কাটা আর ছোট নৌকা চালানো শিখছে। আরে ও সাঁতার তো মায়ের পেট থেকে পড়েই শিখতে হয়! বাংলাদেশের ছেলেগুলো তো পাঁচ বছর বয়স থেকেই সাঁতার শেখে। এ তো আর পাঞ্জারের এক হাঁটু পানিওয়ালা নদী নয়—এ যে বিরাট দরিয়া। শুনেছি তোমার হানাদার সৈন্যরা যখন চাঁদপুর থেকে বরিশাল যাচ্ছিল, তখন তারা ভেবেছিল তারা বোধ হয় বঙ্গোপসাগরে এসে গেছে। ওদের একটু ভালো করে ভূগোল শিখিয়ে দিয়ো, ওটা তো মেঘনা নদী। আর শোনো, একটা কথা তোমাকে গোপনে বলে দিই। বাংলাদেশের বরিশাল ও পটুয়াখালী জেলা আর মাদারীপুর ও গোপালগঞ্জ মহকুমায় এক ইঞ্চি রেললাইন কোনো সময়ই বসানো সম্ভব হয়নি। ওখানে অনেক নদীর নাম পর্যন্ত নেই—গ্রামের নামেই নদীর নাম। এসব এলাকার হাটগুলো পর্যন্ত নদীর ওপরে বসে, বুঝেছ অবস্থাটা! এখানেই একটা নদী আছে, নাম তার আগুনমুখো। নাম শুনেই বুঝেছ, বর্ষায় ওর কী চেহারা হবে?
না, না, তোমাকে ভয় দেখাব না। একবার যখন হানাদারের ভূমিকায় বাংলাদেশের কাদায় পা ডুবিয়েছ—তখন এ পা আর তোমাদের তুলতে হবে না। গাজুরিয়া মাইর চেনো? সেই গাজুরিয়া মাইরের চোটে তোমাগো হগগলরেই কিন্তুক এই ক্যাদোর মাইধ্যে হইত্যা থাকোন লাগব।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র (অধ্যাপকডা. অরূপরতনচৌধুরী, আগামী প্রকাশনী) থেকে
Also Read
-
খালেদা জিয়াকে দেখতে হাসপাতালে জুবাইদা রহমান
-
শারীরিক অবস্থা ঠিক থাকলে রোববার খালেদা জিয়াকে লন্ডনে নেওয়া হবে
-
মুক্তিযুদ্ধে বিদেশি স্বজনদের কথা
-
ক্ষমতার প্রতি মোহমুক্ত একজন নেলসন ম্যান্ডেলা
-
পপি বীজ, প্রসাধনীর চালান জব্দ করাতেই কি দুই কাস্টমস কর্মকর্তার ওপর হামলা