স্বাধীনতা দিবস-২৬ মার্চ

সালদানদীর যুদ্ধ

এম এইচ এ গাফফার, বীর উত্তম

মুক্তিযুদ্ধের সময় সালদানদী সাবসেক্টর সামরিক দিক দিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ রণাঙ্গন ছিল। সাবসেক্টরটি গঠিত হয়েছিল কুমিল্লা জেলার সালদানদী এলাকা, নয়নপুর এবং বুড়িচং এলাকার কিছু অংশ নিয়ে। এর আয়তন ছিল প্রায় ২০০ বর্গকিলোমিটার। সালদানদী রেলস্টেশনটি এমন একটি জায়গায় ছিল যে এটি পাকিস্তানিরা দখলে রাখতে পারলে তারা ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলযোগাযোগ চালু রাখতে পারত। পাকিস্তানি হানাদার সেনাবাহিনী তাই সালদানদী রেলস্টেশন ও বাজারের সামরিক গুরুত্বের কথা চিন্তা করে ৩০ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের দুটি কোম্পানি এ অঞ্চলে মোতায়েন রাখে। মুক্তিবাহিনীর জন্যও একইভাবে অঞ্চলটির নিয়ন্ত্রণ রাখা ছিল বেশ জরুরি। কারণ এ অঞ্চল মুক্তিবাহিনী কবজায় নিতে পারলে ঢাকার সঙ্গে চট্টগ্রামের রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব হতো। কৌশলগত দিক দিয়ে সালদানদী সাবসেক্টরের গুরুত্বের কারণে ১৯৭১ সালের জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত এ অঞ্চলে মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর মধ্যে বেশ কয়েকটি যুদ্ধ হয়। বর্তমান লেখায় সালদানদী কমপ্লেক্স দখলে ৮ অক্টোবর যে ভয়াবহ যুদ্ধ হয়েছিল এ সম্পর্কে আলোকপাত করব।

মুক্তিযুদ্ধের সময় সালদানদী সাবসেক্টর সামরিক দিক দিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ রণাঙ্গন ছিল। সাবসেক্টরটি গঠিত হয়েছিল কুমিল্লা জেলার সালদানদী এলাকা, নয়নপুর এবং বুড়িচং এলাকার কিছু অংশ নিয়ে। এর আয়তন ছিল প্রায় ২০০ বর্গকিলোমিটার। সালদানদী রেলস্টেশনটি এমন একটি জায়গায় ছিল যে এটি পাকিস্তানিরা দখলে রাখতে পারলে তারা ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলযোগাযোগ চালু রাখতে পারত। পাকিস্তানি হানাদার সেনাবাহিনী তাই সালদানদী রেলস্টেশন ও বাজারের সামরিক গুরুত্বের কথা চিন্তা করে ৩০ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের দুটি কোম্পানি এ অঞ্চলে মোতায়েন রাখে। মুক্তিবাহিনীর জন্যও একইভাবে অঞ্চলটির নিয়ন্ত্রণ রাখা ছিল বেশ জরুরি। কারণ এ অঞ্চল মুক্তিবাহিনী কবজায় নিতে পারলে ঢাকার সঙ্গে চট্টগ্রামের রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব হতো। কৌশলগত দিক দিয়ে সালদানদী সাবসেক্টরের গুরুত্বের কারণে ১৯৭১ সালের জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত এ অঞ্চলে মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর মধ্যে বেশ কয়েকটি যুদ্ধ হয়। বর্তমান লেখায় সালদানদী কমপ্লেক্স দখলে ৮ অক্টোবর যে ভয়াবহ যুদ্ধ হয়েছিল এ সম্পর্কে আলোকপাত করব।

যুদ্ধের পরিকল্পনা

সালদানদী কমপ্লেক্স দখলের প্রথম যুদ্ধে মুক্তিবাহিনী ব্যর্থ হয়। এ ব্যর্থতা আমরা মেনে নিতে পারিনি। তাই ভেতরে ভেতরে আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম কীভাবে এ অঞ্চল দখলে সফল অভিযান পরিচালনা করা যায়। আমাদের সেক্টর কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল খালেদ মোশাররফকে রাজি করালাম তিনি যেন অভিযান পরিচালনার ভার আমার ওপর দেন। রাজিও হলেন খালেদ মোশাররফ। এরপর রাত-দিন আমার ধ্যান-জ্ঞান হয়ে দাঁড়ায় কীভাবে এ অভিযান পরচালনা করব তার ছক কষতে। আগেই বলেছি, এ অঞ্চলের সামরিক গুরুত্ব অনুধাবন করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী খুব শক্তভাবে ঘাঁটি গেড়েছিল। তাদের অস্ত্রশস্ত্রও ছিল বেশ আধুনিক। সে তুলনায় আমাদের রসদ এবং অস্ত্র ছিল সেকেলে ও অপ্রতুল। আমরা বুঝতে পারলাম, প্রথাগত কৌশলে যুদ্ধ করলে এ অঞ্চলে কখনো পাকিস্তানি বাহিনীর শক্তির সঙ্গে আমরা পেরে উঠব না।

যুদ্ধ এলাকার নকশা

পরিকল্পনা করলাম চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গলে একটি পদাতিক কোম্পানি (তিনটি প্লাটুন) এ অভিযানে অংশ নেবে। আরেকটি কোম্পানিকে প্রস্তুত রাখা হবে রিজার্ভ ফোর্স হিসেবে। সিদ্ধান্ত হলো তিন দিক থেকে সাঁড়াশি আক্রমণ চালানো হবে। আমরা ঠিক করলাম আমাদের বাহিনীর সবচেয়ে অভিজ্ঞ রিকয়েললেস রাইফেল বিশেষজ্ঞ সুবেদার মহম্মদ হোসেনের একটি ১০৬ মিমি ও একটি ৭৫ মিমি রিকয়েললেস রাইফেল ডিটাচমেন্ট রাতের অন্ধকারে নদীর যে পারে পাকিস্তানি বাংকার তার অপর পারে অবস্থান নেবে। পরদিন সকালে চূড়ান্ত যুদ্ধের আগে গোলা ছুড়ে তারা সালদানদীর অন্য পারে শত্রুর আটটি বাংকার ধ্বংস করবে। সুবেদার বেলায়েতের নেতৃত্বে আরেকটি পদাতিক প্লাটুন তখন নদী অতিক্রম করে চারটি বাংকার দখল করবে। এর ফলে শত্রুর মূল দুটি অবস্থান: সালদানদী বাজার ও রেলস্টেশন বিচ্ছিন্ন হবে। সুবেদার সিরাজের নেতৃত্বে আরেকটি পদাতিক প্লাটুন সালদানদী রেলস্টেশনের পূর্ব পাশের পাহাড়ে এফইউপিতে অবস্থান নিয়ে নির্দিষ্ট সময়ে নেমে এসে দখল নেবে রেলস্টেশনের। একই সঙ্গে সুবেদার মঙ্গল মিয়ার নেতৃত্বে অন্য একটি পদাতিক প্লাটুন নদী পার হয়ে সালদানদী গোডাউন ও বাজার এলাকা দখল করবে। সুবেদার ওহাবের নেতৃত্বে চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গলের অপর একটি পদাতিক কোম্পানিকে রিজার্ভ ফোর্স হিসেবে রাখা হয়। ওহাবের বাহিনীর দায়িত্ব ছিল আক্রমণের আগের রাতে অর্থাত্ ৭ অক্টোবর রাতে পাঁচটি রেইড টিম গঠন করে বড়দুশিয়া, চানলা সাহেববাড়ী, গোবিন্দপুর এবং কাইয়ুমপুরে শত্রুর অবস্থানসমূহে হানা দিয়ে তাদের মনোযোগ অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়া। এতে করে তারা আমাদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু ও সময় সম্পর্কে বিভ্রান্ত হবে। আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল সারা রাত শত্রুর প্রতিরক্ষা অবস্থানগুলোকে এমনভাবে ব্যতিব্যস্ত রাখা, যাতে তারা সকালে গোলাগুলি বন্ধ হলে ক্লান্ত হয়ে রাজাকারদের হাতে দায়িত্ব দিয়ে বিশ্রামে চলে যায়। এই রিজার্ভ ফোর্সের আরেকটি দায়িত্ব ছিল সালদানদী এলাকায় আমাদের মূল আক্রমণের সময় এমনভাবে অবস্থান নেওয়া যাতে বড়দুশিয়া, চানলা, সাহেববাড়ি, গোবিন্দপুর এবং কাইয়ুমপুরে পাকিস্তানি ঘাঁটি থেকে শক্তি বৃদ্ধি করা সম্ভব না হয়।

যুদ্ধের বর্ণনা

৭ অক্টোবর রাতের আঁধারে আমরা আমাদের সব প্লাটুন ও ডিটাচমেন্ট নিজ নিজ অবস্থানে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করি। ওই রাতেই ওহাবের অধীনে থাকা ডাইভারশনারি ফোর্স সালদানদী এলাকার আশপাশের শত্রু ঘাঁটির ওপর আক্রমণ চালায়। পরদিন, অর্থাত্ ৮ অক্টোবর সকাল নয়টায় আমরা সিগন্যালের সঙ্গে সঙ্গে নদীপাড়ের চারটি বাংকারের মধ্যে দুটিকে রিকয়েললেস রাইফেলের নিখুঁত নিশানায় প্রথম শটেই ধ্বংস করে দেওয়া হয়। বাংকার দুটির ছাদ উড়ে য়ায়। বাংকারের ভেতরে থাকা বিশ্রামরত পাকিস্তানি সেনারা হতবিহ্বল হয়ে ছুটোছুটি করতে থাকে। সেন্ট্রি ডিউটিরত রাজাকাররা প্রাণভয়ে তখনই পালিয়ে যায়। প্রথম আক্রমণের পরপরই সুবেদার মহম্মদ হোসেনের নেতৃত্বে একটি দল অন্য দুটি বাংকারের ওপর আঘাত হানে। এই দুটি বাংকারেরও পতন ঘটে একইভাবে। বাংকার চারটিতে অবস্থানরত বেঁচে যাওয়া পাকিস্তানি সেনারা কেউবা রেলস্টেশনের দিকে, আবার কেউবা বাজারের দিকে দৌড়ে পালিয়ে যায়। এ সময়ে আমি ওয়্যারলেসের মাধ্যমে সুবেদার বেলায়েত হোসেনকে নির্দেশ দিই সে যেন তার প্লাটুন নিয়ে নদী সাঁতরে বাংকার চারটি দখল করে। সুবেদার হোসেনের দল সফলভাবে দখল করে নেয় বাংকারগুলো। সেখান থেকে তারা পালিয়ে যাওয়া শত্রুদের সালদানদী বাজার এবং স্টেশনের দিকে তাড়া করে।

যুদ্ধের ফলাফল

কর্নেল ওসমানীর অভিনন্দনপত্র

এই সফল অভিযানে শত্রু বাহিনীর অনেক অস্ত্রশস্ত্র আমাদের হাতে আসে। দখলকৃত অস্ত্রের মধ্যে ছিল ২১টি থ্রি নটথ্রি রাইফেল, চারটি ৭.৬২ এমএম এলএমজি, তিনটি এমজি ওয়ান এ থ্রি রাইফেল, দুটি এমজির স্পেয়ার ব্যারেল, ৪০ এমএম রকেট লঞ্চার, ছয়টি বিটাগান (ইউকে), নতুন চারটি ২ ইঞ্চি মর্টার, দুই বাক্স, ৩১টি ৭.৬২ এমএম এলএমজির ম্যাগাজিন, ২০০টি ২ ইঞ্চি মর্টারের গোলা, ৯২টি ৮১ এমএম মর্টারের গোলা, ১০ হাজারটি থ্রি নট থ্রি গুলি এবং আরও বিভিন্ন রকম ২০,২৫০টি গুলি। এ ছাড়া আমাদের হাতে আসে ওয়্যারলেস কমিউনিকেশন সেট, ফিল্ড টেলিফোন এবং গুরুত্বপূর্ণ অনেক অপারেশনাল ম্যাপ ও নথিপত্র। এই অভিযানে ৮ জন শত্রুসেনা নিহত হয় এবং ১২ জন গুরুতর আহত হিসেবে বন্দী হয়। যুদ্ধে আমরা আমাদের দুই সহযোদ্ধাকে হারাই আর আহত হন আটজন। এই অভিযানের মাধ্যমে সালদানদী রেলস্টেশন ও বাজার শত্রুসেনা মুক্ত হয়।

লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) এম এইচ এ গাফফার বীর উত্তম: চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক (অক্টোবর থেকে), সাবেক মন্ত্রী

সূত্র: ২৬ মার্চ ২০১৩ প্রথম আলোর "স্বাধীনতা দিবস" বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত