স্বাধীনতা দিবস-২৬ মার্চ

যেভাবে হলো কনসার্ট ফর বাংলাদেশ

আমি তখন নিউইয়র্কে যাচ্ছি। তখনই শুনলাম গণহত্যার খবর। এর কয়েক মাস পর জর্জ হ্যারিসনের সঙ্গে দেখা। জর্জ পশ্চিমা সংগীতের বিখ্যাত মানুষ, গীতিকার এবং সাবেক ‘বিটল’। মানসিকভাবে আমি তখন ভীষণ অস্থির। জর্জ আমার সমস্যাটা জানতে চাইল। তাকে বাংলাদেশের নারকীয় অবস্থার কথা বয়ান করলাম। সব শুনে জর্জ খুব কষ্ট পেল। জানতে চাইল, এ ব্যাপারে তার করার কিছু আছে কি না। ভাবলাম, রিলিফ ফান্ড বা অন্য কোথাও কিছু টাকাকড়ি তো আমরা পাঠাতেই পারি। ধরা যাক, অন্তত ২৫ কি ৩০ হাজার ডলার? পাঠানো তো যায়ই। কিন্তু আমি চাইছিলাম অন্য কিছু করতে, আরও অর্থপূর্ণ কিছু। যদি বড় মাপের একটা অনুষ্ঠান করা যায়, তাহলে হয়তো আরও বড় দর্শকশ্রোতার কাছে যাওয়া যাবে। তাদের মধ্যে তৈরি হতে পারে সচেতনতা।

বড় মনোকষ্টে ছিলাম। ওই অবস্থাতেই কম্পোজ করলাম দুটি গান, একটি জয় বাংলা, জয় বাংলা’, অন্যটি ‘ও ভগবান, খোদাতালা’। দুটি গানই পরে রেকর্ড করা হয়েছিল। যা কিছু করছিলাম, সবই কিন্তু তাৎক্ষণিক আবেগের বশে। ঠিক করলাম, মঞ্চে একটা মিউজিক্যাল কনসার্ট করব। ব্যাপারটার জন্য জর্জ যেন তৈরি হয়েই ছিল। বলল, তার সামর্থ্য অনুযায়ী সবকিছু সে করবে। ঠিক হলো, অনুষ্ঠান করব সবসুদ্ধ দুটো। একটা হবে ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সংগীতের, অন্যটি পশ্চিমা সংগীতের। পশ্চিমা জনপ্রিয় তারকারা সেখানে গান করবেন। এদিকে হাতে সময় খুবই কম। ঠিক করলাম, এই অল্প সময়ের নোটিশে যাঁরা ম্যানেজ করে আসতে পারবেন, তাঁরাই অংশ নেবেন অনুষ্ঠানে। সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো, পারফরমাররা অনুষ্ঠানের জন্য কোনো টাকা-পয়সাও নেবেন না।

এর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে জর্জ তার গায়ক বন্ধুবান্ধবদের ফোন করতে শুরু করল। মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে যাঁরা প্রথিতযশা ছিলেন, যেমন বব ডিলান, এরিক ক্ল্যাপটন তাঁদের সঙ্গে জর্জের যোগাযোগ হলো। মাত্র দিনকয়েকের মধ্যেই সবকিছু ঠিকঠাক। ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেনে কনসার্টের ব্যবস্থা হলো। সেখানেই টানা দুই-এক সপ্তাহ কনসার্টের পরিকল্পনা নিলাম। এ উপলক্ষে জর্জ নিজে তো একটা গানই লিখে ফেলল: ‘বাংলাদেশ, বাংলাদেশ’। আলী আকবর ভাই ও আল্লারাখা ভাইকে অনুরোধ করলাম আমার সঙ্গে বাজাতে। এক কথায় রাজি হয়ে গেলেন তাঁরা।

কী বিশাল সাফল্য! প্রতিদিন টানা দু-দুটো শো হতো আমাদের—একটি ম্যাটিনি, অন্যটি সন্ধ্যাবেলায়। প্রতিটি শোতেই হাজার বিশেকেরও বেশি দর্শকের সমাগম হতো। কনসার্টের ওপর তৈরি ছবি, ডিস্ক ও ক্যাসেট বিক্রির বদৌলতে সন্তোষজনক পরিমাণ অর্থ সংগৃহীত হলো। টাকাকড়ি লেনদেনে সরাসরি আমাদের কোনো হাত ছিল না। খরচাপাতি বাদ দিয়ে পুরো টাকাটাই ইউনিসেফ পরিচালিত বাংলাদেশি শরণার্থীদের সাহাঘ্য তহবিলে তুলে দেওয়া হলো। কিন্তু সবচেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে, ‘বাংলাদেশ’ নামটি রাতারাতি সবার কাছে পরিচিত হয়ে উঠল। আর জর্জ হ্যারিসনের সেই গান ‘বাংলাদেশ বাংলাদেশ’ তো তক্ষুণি হিট!

আমার খুব আনন্দ হচ্ছে, এই সামান্য কাজটুকু তো অন্তত করতে পেরেছি। শেষ ভালো যার সব ভালো তার!

‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৭১-এর ১ নিউইয়র্ক সিটির ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেনে। যেসব শিল্পী সেখানে অংশ নিয়েছিলেন তারা হচ্ছেন:

পণ্ডিত রবিশঙ্কর, ওস্তাদ আলী আকবর খান, ওস্তাদ আল্লারাখা খান, কমলা চক্রবর্তী, জর্জ হ্যারিসন, এরিক ক্ল্যাপটন, বব ডিলান, বিলি প্রেসটন, লিওন রাসেল, রিংগো স্টার, ক্লাউস ভুরম্যান, ব্যাড ফিঙ্গার, পিট হ্যাম, টম ইভান, জোয়ি মোলান্ড, মাইক গিবনস, এলান বাটলার, জেসি এড ডেভিস, চাক ফিন্ডলে, মার্লিন গ্রিন, ইয়ানি গ্রিন, জো গ্রিন, ডলোরেস হল, জিম হর্ন, জ্যাকি ক্যালসো, জিম কেল্টনার, ক্লডিয়া লিনিয়ার, লু ম্যাকক্রিরি, ওলি মিশেল, ডন নিক্স, ডন প্রেস্টন, কার্ল র‌্যাডলে।

অনুবাদ: কাজল চৌধুরী

সূত্র: ২৬ মার্চ ২০১০ প্রথম আলোর "স্বাধীনতা দিবস" বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত