স্বাধীনতা দিবস-২৬ মার্চ

যুদ্ধের সাক্ষী যাঁর ছবি

মধ্যরাতে হঠাত্ ফোন! কার ফোন বুঝতে পারলেও কেন ফোন করেছে, তা বোঝার আগেই লাইন কেটে গেল। নানা সংশয় নিয়ে ঘড়ির দিকে তাকালাম। রাত একটা ৪৬ মিনিট। দুঃসংবাদের শঙ্কা বুকে নিয়ে কল ব্যাক করলাম। ও প্রান্ত থেকে নিউ এজ-এর আলোকচিত্রী আবু তাহের খোকন জানাল, ‘আলম ভাই সম্ভবত নেই।’ তারিখটা এ বছরের ১০ জানুয়ারি। তা কী করে হয়? মাত্র তিন ঘণ্টা আগে রাত ১১টায় যে লোকটি ফোনে কথা বললেন আমাদের সঙ্গে; তিনি নেই, এটা অবিশ্বাস্য। কোথাও একটা ভুল হচ্ছে ভেবে আলম ভাইয়ের নম্বরে ফোন করলাম। আলম ভাই তাঁর মোবাইল ফোনটি রিসিভ করার ঊর্ধ্বে চলে গেছেন নিশ্চিত হলাম।

তবুও মেনে নিতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল অন্য একটি কারণে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন অস্থায়ী সরকারের নিয়োগপ্রাপ্ত একমাত্র আলোকচিত্র সাংবাদিক ছিলেন মো. আলম। তাঁর বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবন তাঁর সহকর্মীদের অনেকের কাছেই ছিল অজানা। কেবল পেশাগত দায়িত্বই নয়, সেই সঙ্গে নিবেদিতপ্রাণ একজন দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধাও তিনি। স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিগত ফটোগ্রাফার হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন বঙ্গবন্ধুর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। রাষ্ট্রযন্ত্রের অনেক কিছুই তাঁর জানা ছিল, দেখা ছিল কাছ থেকে।

সেই না-বলা কথাগুলো জানার জন্য আমাকে পিআইবি থেকে তাঁর একটি সাক্ষাত্কার নেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। এ নিয়ে আমি যখন আলম ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলতে চাইলাম; তখন তিনি বললেন, ‘এগুলো কেউ শুনতে চায় না, শুনলেও মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগকে হূদয় দিয়ে কেউ উপলব্ধি করে ন।’ কিন্তু আমি নাছোড়বান্দা হয়ে পেছনে লেগে থাকলাম। সকাল, সন্ধ্যা, মধ্যরাতে ফোন করি। কখনো কাজের চাপে বিরক্ত হন, কখনো বলেন কাল কথা বলব।

বসে থাকি ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাঁর অপেক্ষায়। শেষ পর্যন্ত তাঁর যুদ্ধের সময়ের কথাগুলো আমাকে বলেন। একের পর এক সাক্ষাত্কার শেষ করে পিআইবিতে জমা দিই ডিসেম্বর সংখ্যার জন্য, যেটি জানুয়ারির মাঝামাঝি প্রকাশিত হওয়ার কথা। স্মৃতিচারণার পর আমি যখন তাঁকে তা পড়ে শোনাতাম, তখন দেখতাম তাঁর মধ্যে পরবর্তী কথাগুলো বলার জন্য এক ধরনের আগ্রহ তৈরি হতো। কিন্তু আমার দুঃখ, ছাপার হরফে তাঁর কথন তিনি দেখে যেতে পারলেন না। সাক্ষাত্কার দেওয়ার ব্যাপারে ভীষণ অনাগ্রহী মানুষটি ৪ জানুয়ারি ২০০৮ জিজ্ঞেস করছিলেন—‘কিরে, লেখাটি ছাপা হয়েছে?’ আমি বলেছিলাম, ‘১৪-১৫ তারিখের দিকে বের হবে।’ কিন্তু আলম ভাইয়ের হাতে সেই সময়টুকু আর ছিল না। একজন আলোকচিত্র সাংবাদিকের দেশপ্রেম ও যুদ্ধকালীন ভূমিকার কিছু অংশ এখানে উল্লেখ করলাম। ষাটের দশকে দৈনিক আজাদ পত্রিকা দিয়ে তাঁর কর্মময় জীবনের শুরু।

১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ সালে সামরিক হেফাজতে থাকা অবস্থায় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম বিবাদী সার্জেন্ট জহুরুল হককে পাঞ্জাবি সৈন্যরা যখন গুলি করে হত্যা করে তখন এ দেশের মানুষ প্রচণ্ড বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। মওলানা ভাসানী পল্টন ময়দানে জনসভা ডাকেন। লক্ষাধিক মানুষের সেই জনসভায় মো. আলম সাংবাদিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মওলানা সাহেবের নির্দেশে বিক্ষুব্ধ জনগণ আব্দুল গনি রোডের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে অবস্থিত পূর্ব পাকিস্তানের মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, প্রাদেশিক যোগাযোগমন্ত্রী সুলতান আহমেদের বাসায় আগুন ধরিয়ে দেয়।

মোঃ আলম, মুক্তিযুদ্ধকালীন অস্থায়ী সরকারের নিয়োগপ্রাপ্ত আলোকচিত্র সাংবাদিক ও মুক্তিযোদ্ধা।

এর উল্টো দিকে বাসা ছিল মনসপ্রুর। সুলতান আহমেদ ও মনসপ্রু সেদিন জনতার রোষে এক কাপড়ে তাঁদের সরকারি বাসভবন থেকে পালিয়ে যান, যার ছবি মো. আলম তুলেছিলেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্তি পেয়ে শেখ মুজিবুর রহমান যখন তাঁর ৩২ নম্বরের বাসায় ওঠেন, তখনই সংবাদটি ছড়িয়ে পড়লে ঢাকা শহরবাসীর প্রায় সবাই তাঁর বাসার দিকে ছোটে। সেদিন কেউই বঙ্গবন্ধুর বাসায় ঢুকতে পারেনি, কিন্তু মো. আলম তাঁর ক্যামেরা নিয়ে দেয়াল টপকে বাসায় ঢুকলেন। দোতলায় টিভি দেখার প্যাসেজটিতে শেখ হাসিনাকে জড়িয়ে ধরা বঙ্গবন্ধুর সেই আবেগাপ্লুত দৃশ্যটি মো. আলমের ক্যামেরায় বন্দী হলো।

সত্তরের নির্বাচনে জয়লাভের পর প্রেসিডেন্ট হাউসে (এখন সেটি সুগন্ধা) পরপর ছয় দিন ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানের বৈঠক হয়। সেখানে প্রতিদিনই কর্তব্যরত ছিলেন মো. আলম। বঙ্গবন্ধু বের হয়ে দু-একটি কথা বলে সাংবাদিকদের উদ্দেশে হাত নেড়ে গাড়িতে উঠতেন। সংলাপ ব্যর্থ হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু সব সাংবাদিককে তাঁর বাসায় ডেকেছিলেন প্রেস কনফারেন্সের জন্য রাত আটটায়; কিন্তু অত্যন্ত বিষণ্ন শেখ মুজিবুর রহমান সেদিন কোনো প্রেস কনফারেন্স করেননি। মো. আলম সন্ধ্যা সাতটা থেকে সেখানে উপস্থিত ছিলেন। কাজ শেষে যখন বাসায় ফিরছেন তখন রাত সাড়ে ১১টার মতো। শাঁখারীবাজার, চানখাঁরপুল, লালবাগ—সর্বত্র ব্যারিকেড, গুলির শব্দ, ট্রেচার বুলেট থেকে কেবল বেরুচ্ছে আগুন! এটি ২৪ মার্চ রাতের ঘটনা।

সাহসী এ তরুণ সাংবাদিক তখনো রাস্তায়। পলাশী মোড়ে ফায়ার সার্ভিস কার্যালয়ের সব কর্মীকে গুলি করে হত্যা করে—তাদের নিজস্ব কাজের জন্য যে গর্ত করেছিল—সেই গর্তগুলো লাশে ভরে ফেলেছিল পাক আর্মিরা! অন্ধকারে মো. আলম ছবি তুলছেন আর তাঁর ফ্ল্যাশ লক্ষ করে গুলি ছুড়েছে আর্মিরা। রাত সোয়া ১২টায় আবার অফিসে গেলেন, নেগেটিভ জমা দিয়ে বাসায় ফিরলেন। পঁচিশে মার্চ কারফিউর মধ্যে ইকবাল হলের মাঠে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ছাত্রের লাশ পড়ে আছে শুনে হেঁটে বের হলেন তিনি। গুলির শব্দে বসে পড়েন আবার হাঁটতে থাকেন।

ইকবাল হলের ছবি তুলতে যে ছেলেটি তাঁকে পথ দেখিয়ে নিয়ে গিয়েছিল—হলের দেয়ালের ওপর মাথা তুলতেই ছেলেটির মগজ বের হয়ে গেল গুলিতে, যা তাঁর বেলায়ও হতে পারত। তবু সাহসী তরুণ থেমে থাকেনি। পঁচিশে মার্চ রাত থেকে ছাব্বিশে মার্চ পর্যন্ত রোকেয়া হল, শামসুননাহার হল, শিববাড়ি ইকবাল হলে যত হত্যাযজ্ঞ ঘটে—তার সব ছবি তিনি সংগ্রহ করেন আর জগন্নাথ হলের অংশবিশেষ। পুরান ঢাকার চানখাঁরপুল ও শাঁখারীবাজারের ঘরে ঘরে আগুন। আলমারি-সিন্দুক খোলা, সোনা-গয়না, নতুন টাকার বান্ডিল ও সোনার কয়েন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে রাস্তায়। বাসার বারান্দায়, গলিতে, ড্রেনের পাশে পড়ে আছে অসংখ্য লাশ! বিশ্ববিদ্যালয়ের শিববাড়ি কোয়ার্টারে একই মশারির নিচে সন্তানসহ মায়ের ঝাঁঝরা হওয়া লাশ (!), যার ছবি তিনি তুলেছিলেন।

এপ্রিলে পাঞ্জাবি আর্মিদের বেইলি রোড অফিসে তাঁকে ডেকে পাঠালেন ব্রিগেডিয়ার রফিক। বঙ্গবন্ধুর পতাকা উত্তোলনের ছবি দেখিয়ে বললেন, ‘এ ছবি তোমার তোলা? তুমি পিন্ডিতে গিয়ে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে শেখ সাহেবের সামনে বলতে পারবে?’ সম্মত হলে তাঁকে নেগেটিভসহ পরদিন আসতে বলে ছেড়ে দিল; কিন্তু তিনি আর সেখানে যাননি। ‘রাব্বি ভাই’ নামের এক ব্যবসায়ীর সহায়তায় বৈদ্যেরবাজার থেকে লঞ্চযোগে রামচন্দ্রপুর হয়ে কসবা দিয়ে আগরতলা পার হলেন। আজাদ-এর আইডি কার্ড, ক্যামেরা, ব্যাগ, এখানে তোলা ছবিগুলোর নেগেটিভ তাঁর সঙ্গে। আগরতলা রিক্রুট অফিসে লতিফ ভাইকে পেলেন।

লতিফ ভাই তাঁকে কলকাতা থিয়েটার রোডের ইনফরমেশন অফিসে পাঠালেন। আমিনুল হক বাদশা ওখান থেকে ফরেন অফিসের মাধ্যমে মুকুল ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে ২১ বালু হক্কাক লেনে (পার্ক সার্কাস) জয়বাংলা অফিসে নিয়ে গেলেন। সেখানে দুজন আওয়ামী লীগ নেতা—জিল্লুর রহমান ও আব্দুল মান্নানসহ মুকুল ভাই বসতেন। তাঁরা আলম ভাইকে সাদরে গ্রহণ করলেন। এক ঘণ্টার মধ্যে মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ৩০০ টাকা বেতনে একটি নিয়োগপত্র ও ওয়ার ফটোগ্রাফার হিসেবে একটি পরিচয়পত্র দিলেন। মো. আলমই ছিলেন মুজিবনগর সরকারের একমাত্র নিয়োগ পাওয়া ফটোগ্রাফার।

নয় নম্বর সেক্টর হিংগলগঞ্জ দিয়ে শুরু হলো তাঁর কাজ। মেজর জলিল তাঁকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন। আর নির্দেশ থাকল, প্রতিবার অপারেশনে যাওয়ার সময় তাঁকে সঙ্গে নিতে। আত্মরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ হিসেবে ফায়ারিং, রেকি করা, হ্যান্ড গ্রেনেড ছোড়া, মাইন ব্লাস্ট ইত্যাদি শেষ হলো। তাঁকে দেওয়া হলো একটি চাইনিজ মেশিনগান ও একটি রিভলবার। শুরু হলো যুদ্ধে সরাসরি অংশ নেওয়ার কাজ। বিভিন্ন অপারেশনের মধ্যে শ্যামনগর থানা দখল একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। ২৩০ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল মেজর জলিলের নির্দেশে আর ক্যাপ্টেন হুদার নেতৃত্বে সেই অপারেশনে অংশ নেয়।

নৌকাযোগে ইছামতী নদী পার হয়ে কোমরসমান কাদা রাস্তা ভেঙে থানার কাছাকাছি সড়কে পৌঁছাতেই অ্যামবুশে পড়ে যায় মুক্তিযোদ্ধার দলটি। ক্রলিংয়ের মাধ্যমে অগ্রসর হয়ে পাশের একটি বেড়িবাঁধে নিরাপত্তার জন্য ঘণ্টাখানেক আশ্রয় নিতে হয়। এভাবে সকাল হয়ে যাওয়ার পর যুদ্ধ ছাড়াই থানাটি দখল করা হলো। কারণ, পাকিস্তানি আর্মিরা পালিয়ে গেছে। থানার ওসির যোগসাজশে পাক আর্মিরা থানা ত্যাগ করেছিল। পরের রাতে একটি ভয়াবহ সংঘর্ষের মুখোমুখি হয় থানা দখলকারী মুক্তিযোদ্ধার দলটি। আক্রমণের মুখে মুক্তিযোদ্ধাদের দলটি থানা থেকে বেরিয়ে আসে। এলোপাতাড়ি গুলিতে নিহত হলেন অনেক মুক্তিযোদ্ধা। মো. আলমের পাশেই মুক্তিযোদ্ধা দলের হাবিলদার ইলিয়াস নিহত হলেন—নিজের টমিগানটি বুকের ওপর নিয়ে।

মুক্তিযুদ্ধের সার্বিক চিত্র তুলে ধরতে হলে কেবল একটি সেক্টরের সঙ্গে থাকলেই চলবে না। তাই মো. আলম যাতে সব সেক্টরে ঘুরে কাজ করতে পারেন, এ জন্য একটি বিশেষ পাসের ব্যবস্থা করা হলো—সেটি এয়ারপোর্টে দেখালে যেকোনো সেক্টরে নিয়ে যাবে। কাজের সুবিধার্থে একটি গাড়ির ব্যবস্থা করা হলো তাঁর জন্য। মো. আলমের পক্ষেই কেবল সব সেক্টরে ঘুরে কাজ করার সুযোগ হয়েছিল। মূর্তি ক্যাম্প থেকে বাঙালি মুক্তিযোদ্ধা আর্মি অফিসারদের প্রথম ব্যাচটি প্রশিক্ষণ শেষ করে মার্চপাস্টে অংশ নেবে, সেখানেও মো. আলম; যেখানে শেখ কামাল ট্রেনিং করেছিলেন। মো. আলমকে দেখেই শেখ কামাল লাইন থেকে চেঁচিয়ে ডাকছেন ‘প্যাথেটিক আব্বা’ বলে। আন্দোলনের সময় প্রায়ই আহত হতেন মো. আলম, তাই শেখ কামাল তাঁকে ‘প্যাথেটিক আব্বা’ বলে ডাকতেন।

কখনো প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে, কখনো প্রেসিডেন্টের সঙ্গে একেকটি সেক্টরে একাধিকবার তাঁকে যেতে হয়েছে। আগরতলার সাবরুমে সব সেক্টর কমান্ডারের একটি গোপন বৈঠক হয়েছিল, যেখানে তাজউদ্দীন আহমদ ও নজরুল ইসলাম সেক্টর কমান্ডারদের উদ্দেশে ভাষণ দিয়েছিলেন। সেই বৈঠকেও মো. আলম কর্তব্যরত ছিলেন। মুকুল ভাই আর বাদশা ভাই বসে থাকতেন কখন মো. আলম ছবি নিয়ে ফিরবেন। আর সারা বিশ্বে সেই ছবিগুলো পাঠাতে হবে। বিভিন্ন সেক্টরে যা যা দেখে আসতেন, সেগুলোও মুকুল ভাইকে বলতে হতো চরমপত্র লেখার জন্য। ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে’—গানের তবলচি মো. আলম। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের তবলচি আসেনি, তো মো. আলমকে তবলাও ধরতে হয়েছে। জয়বাংলা পত্রিকাটি ছাপা হয়ে জমে আছে, হকারদের কাছে পৌঁছে দিতে হবে—জিপ টান দিয়ে সেটিও করেছেন তিনি।

আট নম্বর সেক্টরের নেতৃত্বে যশোর-চৌগাছা মুক্ত করার অপারেশনে জেনারেল ওসমানী তাঁকে পাঠালেন ছবি সংগ্রহ করতে। রাতে ক্যাম্পে থাকতে হলো। আজানের ঠিক পর পরই পাক আর্মিরা ক্যাম্প আক্রমণ করল। প্রচণ্ড গুলির শব্দে মুক্তিযোদ্ধারাও পাল্টা আক্রমণ করলেন, যা ছিল অত্যন্ত ভয়াবহ। চৌগাছা নদী ছিল সেদিন একটি লাশের নদী। যশোর মুক্ত হলো। পরদিন সার্কিট হাউস ময়দানে ‘যশোর মুক্তি’ উপলক্ষে জনসভায় তাজউদ্দীন আহমদ বক্তব্য দেন। অপারেশনসহ আনন্দ-উল্লাস ও প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতার সব ছবি তুলে জয়বাংলা অফিসে ফিরলেন মো. আলম। দেশ স্বাধীন হলো।

কলকাতা থেকে আগরতলা হয়ে এয়ার ফোর্সের সুলতান আহমদের সঙ্গে ঢাকায় এলেন কোনো রকমের প্রস্তুতি ছাড়াই, শুধু ক্যামেরাটি সঙ্গে নিয়ে। ১৭ ডিসেম্বর ঢাকায় এসে ১৮ ডিসেম্বর আজাদ-এ যোগ দিলেন। মুকুল ভাই ঢাকায় তাঁকে পিআইডিতে যোগ দিতে বললেন। বঙ্গভবনের মানিক হাউসে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা আর তাজউদ্দীন আহমদ ও নজরুল ইসলামের সঙ্গে ডিউটি করতে বললেন। শেখ মুজিবুর রহমান তখনো এসে পৌঁছেননি।

১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকায় পৌঁছালে তাঁকে তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে থাকতে বলা হলো। তিনি পুরোটাই কাভার করলেন। ১২ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রীর শপথ নিলেন বঙ্গভবনে, সেখানেও মো. আলম দায়িত্বরত ছিলেন। প্রথম কেবিনেট মিটিংয়ে যুদ্ধকালীন সার্বিক অবস্থার একটি ধারাবাহিক বর্ণনা দিলেন তাজউদ্দীন আহমদ বঙ্গবন্ধুকে। ছবি তুলে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন মো. আলম।

কেবিনেট সচিবের পিএ এসে বললেন, ‘আলম, তোমাকে নিয়ে কথা হচ্ছে।’ মুক্তিযোদ্ধাদের শ্রম ও আত্মত্যাগের দৃষ্টান্ত দিতে গিয়ে মো. আলমের প্রসঙ্গ এসেছে। ‘সে গুলি চালিয়েছে, ছবিও তুলেছে। একই সঙ্গে দেখা গেছে কাঁধে রাইফেল, হাতে ক্যামেরা।’ বলেছেন তাজউদ্দীন আহমদ। ঠিক এভাবেই মুকুল ভাই তাঁর আমি বিজয় দেখেছি গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ‘একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় আলমকে দেখলেই গ্রামবাংলার কিশোর ও তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতীক বলে আমার কাছে মনে হতো।’

বঙ্গবন্ধু তাঁকে দেখতে চাইলেন, কথা বলতে চাইলেন। কেবিনেট মিটিং ভাঙার পর মো. আলমকে ভেতরে ডাকা হলো। বঙ্গবন্ধু তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘তুমি তো মুক্তিযুদ্ধে অনেক কাজ করেছ। আজ থেকে তুমি আমার ব্যক্তিগত চিফ ফটোগ্রাফার।’ রফিকুল্লাহ চৌধুরীকে বললেন, ‘এখনই একটি নিয়োগপত্র তৈরি করে দাও।’ সেদিন থেকে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাঁর সঙ্গেই কাজ করেছেন মো. আলম। ক্ষমতার শীর্ষ ব্যক্তির একান্ত কাছে থেকেও সম্পদকে জরুরি মনে করেননি, যা তাঁর সাধারণ জীবনযাপন থেকে প্রতীয়মান হয়। জীবনের শেষ কথোপকথনে যে দুঃখবোধটির আভাস পেয়েছি; তা টাকা-পয়সা নয়, পদক নয়—সত্যিকার মুক্তিযোদ্ধার সঠিক মূল্যায়ন।

সূত্র: ২৬ মার্চ ২০০৮ প্রথম আলোর "স্বাধীনতা দিবস" বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত