স্বাধীনতা দিবস-২৬ মার্চ
যুদ্ধবন্দি বিনিময়
শিমলা সম্মেলনের আগে আমি জুলফিকার আলী ভুট্টোর সঙ্গে সাক্ষাত্ করি। তিনি তখন প্রেসিডেন্ট। ১৯৭১ সালে ঢাকার পতনের সময় আত্মসমর্পণকারী ৯০ হাজার যুদ্ধবন্দির ব্যাপারে আমাদের মধ্যে কথাবার্তা হয়।
ভারতের ভয় ছিল, তখনো শান্তি প্রতিষ্ঠিত না হওয়ায় সুপ্রশিক্ষিত সৈন্যদের চারটি ডিভিশন পাকিস্তানের কাছে ফেরত দেওয়া হলে, এরপরই পাকিস্তান আরেকটি হামলা চালাবে। এই আশঙ্কা ব্যক্ত করায় ভুট্টো জবাব দিলেন : ‘ওদেরকে আপনারা কতদিন রেখে দেবেন? অনন্তকাল নিশ্চয়ই না। আমরা আবার চারটা ডিভিশন বানাতে পারব, পাঁচটা পারব এবং সামর্থ্য থাকলে ১০টা ডিভিশনও বানানো যাবে। আমাদের জনবলের কমতি নেই। এ তো গেল একটা জবাব। দ্বিতীয় জবাবটি হলো, আমাদের যদি অসত্ উদ্দেশ্য থেকে থাকে, সেক্ষেত্রে শুধু এখন নয়, আগামী দিনেও চীন আমাদের সহায়তা করতে এগিয়ে আসবে।’
আরেকটা ব্যাপার হলো, যুদ্ধবন্দিরা এককভাবে নয়াদিল্লির অধীনে ছিল না। যেহেতু পাকিস্তানি সৈন্যরা ভারতীয় বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর যৌথ কমান্ডের হাতে আত্মসমর্পণ করেছে, তাই তারা ভারত ও বাংলাদেশ উভয়ের যৌথ হেফাজতে আছে। বস্তুত নয়াদিল্লি কয়েকজন বেসামরিক যুদ্ধবন্দিকে ফেরত দিতে চাইলেও ঢাকা এই মর্মে শর্ত জুড়ে দিয়েছিল যে, তাদের পশ্চিম পাকিস্তানে আটক বাঙালিদের সঙ্গে বিনিময় করতে হবে। রাওয়ালপিন্ডি এটিকে একটা বানোয়াট আইনি মারপ্যাঁচ হিসেবে আখ্যায়িত করল। আমি পাকিস্তানের মন্তব্য মুজিবকে জানানোর পর তিনি বললেন, ‘যৌথ বাহিনী কোনো কল্পিত আইনি জটিলতা নয়, এটা বাস্তব। যুদ্ধের সময় একটা যৌথ কমান্ড, যৌথ বাহিনী তৈরি করা হয়েছিল। যুদ্ধবন্দিরা উভয় বাহিনীর হাতেই বন্দি। পাকিস্তানের মন্তব্যের মাধ্যমে তো আর প্রকৃত সত্য বদলে যাচ্ছে না।’
মুজিব এটা সঙ্ষ্ট জানিয়ে দিলেন যে, বাংলাদেশের সম্মতি ছাড়া যুদ্ধবন্দি সমস্যা নিষিত্তর কোনো আলোচনা দিল্লি শুরু করতে পারে না। তিনি এও জানিয়ে দিলেন যে, ভুট্টো যে পাকিস্তানে আটক বাঙালিদের সঙ্গে যুদ্ধবন্দিদের বিনিময় করতে চান, সেটা তার অজানা নয়। ‘কিন্তু বেসামরিক নাগরিকদের বিপরীতে সৈন্য বিনিময় কখনো কোথাও হয়নি। আমি পাকিস্তানে আটক বাঙালিদের বিপরীতে বাংলাদেশের বিহারিদের বিনিময় করতে রাজি আছি।’
মুজিব ‘যুদ্ধাপরাধীদের’ বিচারের ব্যাপারে খুব জোর দিতেন আর এ ব্যাপারে তার অবস্থান খুব সঙ্ষ্ট ছিল। তিনি বলেন, যারা গণহত্যা চালিয়েছে, তাদেরকে কী করে ছেড়ে দেওয়া সম্ভব, এটা তার মাথায় আসে না। তিনি বলেন, ‘উত্তর প্রজন্ম কী বলবে? হত্যা, ধর্ষণ আর লুটপাটের বিচার না করলে আন্তর্জাতিক সমঙ্রদায় আমাদের ক্ষমা করবে না। আমার লোকজনকে কসাইয়ের মতো হত্যা করা হয়েছে; কয়েক শত নয়, কয়েক হাজার নয়, ৩০ লাখ মানুষ মেরে ফেলা হয়েছে। যেসব পাকিস্তানি সৈন্যের বিরুদ্ধে আমাদের সুসঙ্ষ্ট তথ্য-প্রমাণ রয়েছে, অন্তত তাদের বিচার আমাদের করতেই হবে।’
শুনেছি, ঢাকা এমন দলিলপত্র পেয়েছে, যাতে বলা হয়েছে, রাও ফরমান আলী নিজ হাতে লিখেছেন, বাংলাদেশের সবুজ মানচিত্র লালে লাল করে দেওয়া হবে।
পাকিস্তানের জনগণ স্বীকারই করছিল না যে, কোনো বিচারটিচারের দরকার আছে। কেননা সৈন্যরা ‘একটা বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন দমনের’ জন্য লড়ছে এবং এটা ‘দেশের প্রতি তাদের কর্তব্য’। ভুট্টো আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘বলুন দেখি, কোন হিসাবে ওরা যুদ্ধাপরাধী? ওরা হয়তো বাড়াবাড়ি করে থাকতে পারে, কিন্তু ওরা ওদের মতো করে এমন একটা দেশের অখণ্ডতা রক্ষা করার চেষ্টা করছিল যেটি নিজের প্রয়োজনেই সৃষ্টি হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণও পাকিস্তান তৈরির জন্য লড়েছে। ওরা তো শুধু দেশের অখণ্ডতা রক্ষার চেষ্টা করেছে। এর সঙ্গে ফরাসি, কিংবা বেলজিয়ান বা ডাচদের বিরুদ্ধে জার্মানদের নৃশংসতাকে আপনি কীভাবে এক করে দেখবেন? শেখ মুজিবুর রহমান যদি মনে করেন, কতিপয় লোক বাড়াবাড়ি করেছে, সেক্ষেত্রে আমি পেশোয়ারে দেওয়া এক বক্তৃতায় তাকে বলেছি যে, ঠিক আছে, তাদের বিরুদ্ধে কিছু ব্যবস্থা নিন। কিন্তু খামোখা পরিস্থিতি তিক্ত করবেন না। এখন তিনি যদি যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু করেন অথবা ভারত যদি তাকে সেই বন্দোবস্ত করে দেয় এবং যুদ্ধবন্দিদের কাউকে মুজিবের হেফাজতে হস্তান্তর করে, সেক্ষেত্রে বিশ্ব এ কথা আর বিশ্বাস করবে না যে, সৈন্যরা ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ কমান্ডের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। মোদ্দা কথা, ভারত এটা করলে শুধু সময়ের চাকাই উল্টো ঘুরিয়ে দেওয়া হবে এবং এর ফলে উত্তেজনা সৃষ্টি হবে এবং এতে করে আমার দায়িত্ব (একটা নিষিত্তর লক্ষ্যে আলাপ-আলোচনা) পালন অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। কিন্তু তাকে যদি রক্তের পিপাসায় পেয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে আমরা এখানে সেইসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে কিছু ব্যবস্থা নিতে পারি, যারা স্বীকৃত আচরণবিধি লঙ্ঘন করেছে। উপমাটি এ ক্ষেত্রে লাগসই না হলেও বলছি, যদি তিনি নুরেমবার্গ ধাঁচের দৃষ্টান্তমূলক বিচার করতে চান, সেটা চলতেই থাকবে। কেননা হাজার হলেও একটা আইনি বিচারে আমাদেরকে প্রতিনিধি পাঠাতে হবে, নতুবা কোনো আন্তর্জাতিক আইনজীবীকে নিয়োগ দিতে হবে। উপমহাদেশের ভবিষ্যত্ ঘটনাচক্রে এটি কি শুভ ইঙ্গিত বয়ে আনতে পারবে?’
যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে ভারত বরং কিছুটা বেকায়দায় ছিল : তারা এমন কিছু করতে চাইছিল না, যা পাকিস্তানকে ‘পয়েন্ট অব নো রিটার্ন’-এ ঠেলে দেয়। বিশ্ব প্রতিনিধিদের মাধ্যমে এই হুমকিটাই ভুট্টো নয়াদিল্লির কানে পৌঁছে দিয়ে ছিলেন। অন্যদিকে মুজিবকেও তারা ক্ষুব্ধ করতে চাচ্ছিল না। মুজিব তখন শুধু বিচার শুরুর ব্যাপারে উদগ্রীবই ছিলেন না, নিজের অনুসারীদের তরফ থেকেও চাপের মুখে ছিলেন তিনি। ওদের অনেকে নিজ চোখে হত্যা, অগ্নিসংযোগ এবং আরো জঘন্য অপরাধ সংঘটিত হতে দেখেছে। কাজেই নয়াদিল্লি যে মধ্যপন্থা উদ্ভাবন করল তা হলো মুজিবকে এ ব্যাপারে তাড়াহুড়ো না করার জন্য অনুরোধ করা এবং এ জাতীয় বিচার শুরু হলে আন্?র্জাতিক বিচারক নিয়োগ করার পরামর্শ দেওয়া। ভারত এক পর্যায়ে ‘অপরাধীদের’ তালিকা ৫ হাজার থেকে কমিয়ে ১ হাজার ৫০০ করতে সক্ষম হয়েছিল। বিচার শুরু হলে এ সংখ্যা হয়তো আরো কমিয়ে আনা হতো এবং সম্ভবত দণ্ডাদেশ কার্যকরও করা হতো না।
আটকাবস্থায় দেখা করতে আসা ভারতীয় কর্মকর্তাদের নিয়াজি বলেছিলেন, তিনি ভারতেই পড়ে থাকতে চান। কেননা বাংলাদেশ ও পাকিস্তান উভয়ই তার বিচার করার পরিকল্পনা করছে। বাংলাদেশে বিচারের কাঠগড়া আর পাকিস্তানে কোর্ট মার্শালের ভয়ে নিয়াজির মতো বেশ কিছু পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তাও জানিয়েছিলেন, তারা ভারতেই থেকে যেতে চান। ফরমান আলী দাবি করেন, তিনি কোনো যুদ্ধাপরাধ করেননি। জেরার জবাবে তিনি বলেন, তিনি একজন ‘উচ্চপদস্থ’ সরকারি কর্মকর্তা, যার দায়িত্ব শুধু বেসামরিক কর্মকর্তাদের তত্ত্বাবধান করা। ফরমান আলী বাঙালিদের একটি তালিকা দিয়ে দাবি করেন, তাদের তিনি ‘বিভিন্নভাবে বাঁচিয়ে দিয়েছেন এবং সাহায্য করেছেন।’
তরুণ সেনা কর্মকর্তাদের জেরা করতে গিয়ে বোঝা যায়, এরা অন্তর থেকেই বিশ্বাস করে, তারা যুদ্ধে হারেনি বরং ‘শীর্ষস্থানীয় সামরিক নেতৃত্ব’ তাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। সুযোগ পেলে তারা এর প্রতিশোধ নেবে। তারা ক্ষুব্ধ এবং তাদের কোনো অনুতাপ নেই। অসুস্থ হওয়ার পর এদের কেউ কেউ কাফেরদের দেওয়া ওষুধ খেতেও অস্বীকার করে। তাদের সন্দেহ ওষুধের নাম করে বিষ খাওয়ানো হতে পারে। ভারত ও ভারতীয়দের সমের্ক ভয়াবহ সব গল্প তাদের খাওয়ানো হয়েছে। জেরার জবাবে জানা যায়, এদের অনেকেই বিশ্বাস করে, ভারতে প্রতি বছর হিন্দুরা লাখ লাখ মুসলমানকে হত্যা করে, এখানে সব মসজিদ হয় ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে, নতুবা মন্দির বানিয়ে দেওয়া হয়েছে।
দুই দশক ধরে যে আতঙ্ক ও ঘৃণার প্রচারণা চলেছে, এ ছিল তারই ফল। সন্দেহ নেই, এতটা প্রবল আকারে না হলেও ভারতেও অনেকের মধ্যে এ রোগের লক্ষণ দেখা যায়। এখানে অন্তত সরকার ও বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল আন্তরিকভাবে এটির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছে।
১৯৭১ সালের ৫ নভেম্বর ওয়াশিংটনের এক গির্জায় বক্তৃতাকালে মিসেস গান্ধী যেমনটা বলেছিলেন, ‘উপমহাদেশ যখন ভারত ও পাকিস্তানে ভাগ হয়ে যায়, তখনই এটা এক অস্বাভাবিক বিভক্তি ছিল। আমরা জানতাম, এটি সমস্যা সৃষ্টি করবেই। কিন্তু তবু আমরা তা মেনে নিই স্বাধীনতার প্রতিদান মনে করে। আমরা ভেবেছিলাম, সমস্যা থাকলেও আমরা অন্তত সামনে এগিয়ে যেতে পারব এবং আমাদের অংশে কিছু হলেও করতে পারব। প্রবল উসকানি সত্ত্বেও আমরা কখনোই অপর পাশে কী হচ্ছে, সে ব্যাপারে নাক গলাইনি।’
ইংরেজি থেকে অনূদিত
সূত্র: ২৬ মার্চ ২০০৩ প্রথম আলোর "স্বাধীনতা দিবস" বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত
Also Read
-
বগুড়ায় এত বাল্যবিবাহ কেন, কী বলছেন বাসিন্দারা
-
নেত্রকোনায় উত্তপ্ত ভোটের মাঠ, কী বলছেন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা
-
কোহলি বললেন, শুধু চার-ছক্কা হলেই ক্রিকেট জমে না
-
কিরগিজস্তানে বিদেশিদের ওপর হামলা, আতঙ্কে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা
-
৪৬তম বিসিএসের ফল এত দ্রুত যেভাবে, জানাল পিএসসি