স্বাধীনতা দিবস-২৬ মার্চ

বাঙালি সৈনিকদের প্রস্তুতি

বাঙালি সৈনিকদের শপথ

১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। জাতীয় পরিষদের ১৬২টি আসনের মধ্যে ১৬০টি আসনে এবং প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৮৮টি আসনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়। দীর্ঘ বিলম্বের পর প্রসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের প্রথম অধিবেশন আহ্বান করেন। ১ মার্চ দুপুরে কোনো কারণ ছাড়াই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করেন। সারা বাংলায় প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। জনগণ হরতাল ও অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে সারা বাংলাকে অচল করে দেয়। সব শ্রেণীর রাজনীতিবিদ, পেশাজীবী, ব্যবসায়ী, ছাত্র, কৃষক, সরকারি কর্মকর্তার সামনে একটিই মাত্র দাবি—বাঙালির ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা। বিপরীতে হানাদাররাও আন্দোলনকে নস্যাত্ করার প্রস্তুতি নিতে থাকে। পাকিস্তান সামরিক বাহিনীতে কর্মরত এবং অবসরপ্রাপ্ত বাঙালি সৈনিকেরাও বসে থাকেননি। তাঁরা ব্যক্তিগত বা সমষ্টিগতভাবে আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন এবং বিভিন্নভাবে আন্দোলনকে সফল করতে এগিয়ে আসেন। এ ধরনের কয়েকটি ঘটনার কথা এখানে উল্লেখ করা হলো।

গ্রুপ ক্যাপ্টেন (পরে এয়ার ভাইস মার্শাল) এ কে খন্দকার অসহযোগ আন্দোলনকালে ঢাকা সেনানিবাসে অবস্থান করছিলেন। পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণের প্রস্তুতি সম্পর্কে তিনি জানতেন। বিষয়টি রাজনৈতিক নেতাদের কাছে পৌঁছানোর উদ্যোগ নেন তিনি। তাঁর ভাষায়, ‘আমি মার্চে নয়, ফেব্রুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহ থেকে দেখছি এই বিল্ড আপ [সামরিক প্রস্তুতি] চলছে এবং এই বিল্ড আপের কথা আমি উইং কমান্ডার মীর্জা, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট রেজাকে জানাই এবং তাঁদের বলি, সংবাদ যেন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বকে জানানো হয়। আমি তাঁদের বলেছি, কীভাবে প্রতিদিন ট্রুপস আসছে, কীভাবে কমান্ডো আসছে, কীভাবে আর্মস অ্যামুনেশন আসছে—এসব কথাই বলার জন্য তাঁদের বলেছিলাম। তাঁরা রাজনৈতিক নেতৃত্বকে বিষয়টি জানিয়েছিলেন বলে আমি জানি।’ (প্রথম আলো, ১৬ ডিসেম্বর ২০০৮)

উইং কমান্ডার (অব.) এস আর মীর্জা হানাদার বাহিনীর অসহযোগ আন্দোলন দমনের প্রস্তুতি এবং হানাদারদের প্রতিহত করার সম্ভাব্য উপায় সম্পর্কে সেনাবাহিনীর বাঙালি কর্মকর্তাদের কাছ থেকে বেশ কিছু তথ্য সংগ্রহ করেন। উইং কমান্ডার মীর্জার ভাষায়, ‘এখনো এই প্রদেশে (পূর্ব পাকিস্তান) বাঙালি সৈন্যের সংখ্যা অবাঙালি সৈন্যদের থেকে বেশি। তা দিয়ে গোদনাইল জ্বালানি তেলের ডিপো ধ্বংস করা, ঢাকা বিমানবন্দর অকেজো করে ফেলা এবং চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর দখল করা—এই তিনটি একযোগে করা সম্ভব। এগুলো হলেই পাকিস্তানিরা খুব অসুবিধায় পড়বে। এ কাজগুলো করার জন্য বাঙালি ফোর্স পাওয়া যাবে কি এবং কীভাবে পাওয়া যাবে, তা-ই ছিল আমার প্রশ্ন।

‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’—এই মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ ছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা, ১৯৭১।

সেই উত্তরও আলম [বাঙালি অফিসারদের সাথে যোগাযোগ রক্ষাকারী] নিয়ে আসেন। ফোর্স আছে, তবে আর্মির লোকদের মুভ করাতে হলে একটা অর্ডার লাগে, উপরের লেজিটিমেট অর্ডার ছাড়া তারা মুভ করতে পারে না। সেই লেজিটেমিসি শেখ মুজিবের এখনো নেই, তবু বিপুল ভোটে জয়ী হওয়ার ফলে তিনি একটা মরাল অথরিটি পেয়েছেন। এর ভিত্তিতে তিনি যদি অর্ডার দেন ক্লিয়ারকাট, তবে বাঙালি ফোর্সরা অস্ত্র ধরতে রাজি হবে, যেমন—সিভিল সার্ভিসের সবাই তাঁকে মেনে নিয়েছেন।’ (প্রথম আলো, ১৬ ডিসেম্বর ২০০৮)। উইং কমান্ডার মীর্জা শেখ মুজিবুর রহমানের পূর্বপরিচিত ছিলেন। ৫ মার্চ রাত সাড়ে নয়টায় উইং কমান্ডার মীর্জা শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করেন এবং হানাদারদের বিরুদ্ধে বাঙালি কর্মকর্তাদের যুদ্ধ-পরিকল্পনা বর্ণনা করেন। শেখ মুজিব বিষয়টি তাজউদ্দীন আহমদকে জানাতে বলেন। পরে এ বিষয়ে আর কোনো অগ্রগতি হয়নি।

মার্চের প্রথম দিকে চট্টগ্রামে প্রায় তিন হাজার প্রশিক্ষিত ও প্রশিক্ষণরত বাঙালি সৈনিক মজুত ছিল, বিপরীতে সেখানে অবাঙালি সৈনিক মজুত ছিল প্রায় এক হাজার। ব্রিগেডিয়ার এম আর মজুমদার চট্টগ্রামে সর্বজ্যেষ্ঠ বাঙালি কর্মকর্তা ছিলেন। ব্রিগেডিয়ার মজুমদার চট্টগ্রামে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে অকার্যকর করার একটি পরিকল্পনা করেন। এ বিষয়ে ক্যাপ্টেন (পরে মেজর জেনারেল) আমীন আহম্মেদ চৌধুরী বলেন, ওই সময়ে চট্টগ্রামে দুজন বাঙালির সমুদ্রগামী জাহাজ ছিল। ব্রিগেডিয়ার মজুমদার পরিকল্পনা করেন, এই দুজনের দুটি জাহাজ কর্ণফুলীর মোহনায় ডুবিয়ে দিলে চট্টগ্রাম বন্দর সাময়িকভাবে অকার্যকর হয়ে যাবে এবং এই ফাঁকে বাঙালি সৈনিকদের দিয়ে চট্টগ্রাম এলাকা দখলে নেওয়া সম্ভব হবে। ব্রিগেডিয়ার মজুমদারের নির্দেশে ১১ মার্চ ক্যাপ্টেন আমীন জাহাজ দুটির মালিকের সঙ্গে সাক্ষাত্ করেন এবং তাদের সম্মতি গ্রহণ করেন। ১৪ মার্চ ক্যাপ্টেন আমীন ঢাকা আসেন এবং কর্নেল (পরে জেনারেল) ওসমানীকে বিস্তারিত পরিকল্পনা জানান। ক্যাপ্টেন আমীন হাইকমান্ডকে [অর্থাত্ শেখ মুজিবকে] অথবা হাইকমান্ডের দ্বিতীয় বা তৃতীয় ব্যক্তিসহ কর্নেল ওসমানীকে চট্টগ্রামে আসার অনুরোধ করেন, যাতে সময়-সুযোগমতো স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়া সম্ভব হয়। কর্নেল ওসমানী ক্যাপ্টেন আমীনকে যোগাযোগ রাখতে বলে বিদায় দেন। (দৈনিক ইত্তেফাক, ২৬ মার্চ ২০০৮)

১৪ মার্চ স্বাধীন বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে বেশ কিছু ঘোষণার সঙ্গে বাঙালি সৈনিকদের জন্য নিচের ঘোষণাটি দেওয়া হয়, ‘বর্তমানে ছুটি উপভোগকারী বাঙালি সৈনিকদের বাংলাদেশ ত্যাগ না করিয়া স্ব-স্ব এলাকায় সংগ্রাম পরিষদের সহিত যোগাযোগ করিয়া স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রস্তুতি গ্রহণের আহ্বান জানাইতেছি। তাহাদিগকে সামরিক নির্দেশ মোতাবেক কাজে যোগদান না করার জন্য অনুরোধ করিতেছি এবং এই মর্মে আশ্বাস প্রদান করিতেছি যে, স্বাধীন বাংলার সরকার প্রতিষ্ঠিত হইলে তাহাদিগকে সশস্ত্র বাহিনীতে অগ্রাধিকার ও পূর্ণ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠত করা হইবে।’ (দৈনিক আজাদ, ১৫ মার্চ ১৯৭১)। এর আগের দিন অর্থাত্ ১৩ মার্চ সামরিক আইন প্রশাসকের সদর দফতর থেকে ১১৫ নং সামরিক আইন জারি করা হয়। তাতে নির্দেশ দেওয়া হয়, প্রতিরক্ষা খাতের বেতনভুক্ত বেসামরিক কর্মচারীদের ১৫ মার্চ সকালের মধ্যে কাজে যোগ দিতে হবে। কেউ যথাসময়ে কাজে যোগদানে ব্যর্থ হলে তাঁকে চাকরি থেকে ছাঁটাই করা হতে পারে এবং পলাতক হিসেবে সামরিক আদালতে বিচার ও সামরিক আইনের ২৫ নম্বর বিধি অনুযায়ী সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হবে। প্রতিরক্ষা বাহিনীর বেসামরিক কর্মচরীরা এ নির্দেশ অমান্য করে। অর্ডন্যান্স ডিপো কর্মচারী ইউনিয়নের মুখপাত্র জানান, ‘গতকাল সামরিক বিভাগের অধীনস্থ প্রায় ১১ হাজার বেসামরিক কর্মচারীর মধ্যে কেহই কাজে যোগদান করেন নাই।’ (দৈনিক ইত্তেফাক, ১৬ মার্চ ১৯৭১)

১৮ মার্চ শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে বিমানবাহিনীর সাবেক বাঙালি সৈনিকেরা অবসরপ্রাপ্ত উইং কমান্ডার বাকীর সভাপতিত্বে সমাবেশ করেন। সমাবেশে উইং কমান্ডার বাকী, রোকন উদ্দিন, তাজউদ্দীন, শাহ্জাহান চৌধুরী ও সার্জেন্ট শামসুল হক বক্তৃতা দেন। তাঁরা বলেন, বক্তৃতা ও সভা-সমিতির দিন শেষ হয়েছে, এখন সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করতে হবে এবং ভিয়েতনামের মতো মুক্তি সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। তাঁরা স্থল, নৌ ও বিমানবাহিনীর সাবেক সৈনিকদের সমন্বয়ে সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রাম চালানোর কথা উল্লেখ করেন। তাঁরা বাংলার নিরস্ত্র জনতাকে সৈনিকে রূপান্তর করারও অঙ্গীকার করেন। তাঁরা আশা ব্যক্ত করেন, শিগগিরই তাঁরা স্বাধীন বাংলার বিমানবাহিনী গঠন করবেন। তাঁরা বলেন, ‘আমরা সৈনিক ছিলাম। আমরা জানি কি করিয়া শত্রুকে আঘাত করিতে হয়, রাইফেল চালাইতে হয় আর শত্রু বিমান ভূপাতিত করিতে হয়। গ্রামে গ্রামে ছড়াইয়া পড়িয়া আমরা জনতাকে যুদ্ধ পরিচালনা শিক্ষা দিব। কেবল নেতার নির্দেশের অপেক্ষায় রহিয়াছি। নেতার নির্দেশ আর পরিকল্পনা মোতাবেক আমরা কাজ চালাইয়া যাইব। বাংলাদেশকে মুক্ত করিব।’ (দৈনিক আজাদ, ১৯ মার্চ ১৯৭১)

১৯ মার্চ দৈনিক পূর্বদেশ-এ প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ সাবেক সৈনিক, আনসার, ন্যাশনাল গার্ডদের আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীতে যোগদানের জন্য আহ্বান জানিয়েছে এবং ২০ মার্চ বিকেল তিনটায় জে এম সেন হলে এ বিষয়ে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে।

২০ মার্চ শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে নৌবাহিনীর সাবেক বাঙালি সৈনিকেরা লে. কমান্ডার জয়নাল আবেদীনের সভাপতিত্বে সমাবেশ করেন। সমাবেশে লে. কমান্ডার জয়নাল, লে. কমান্ডার ইমাম হোসেন, লে. সিদ্দীক, এ এম এ হোসেন, এম ইউ আহমদ বক্তৃতা করেন। সভায় স্থল, নৌ ও বিমানবাহিনীর সাবেক সৈনিকদের নিয়ে ‘সংযুক্ত মুক্তিবাহিনী কমান্ড’ গঠনের প্রস্তাব করা হয়। তাঁরা আরও উল্লেখ করেন, বাঙালি পল্টন গড়ে তোলা না হলে বাংলাকে রক্ষা করা যাবে না এবং নিজস্ব সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী না থাকলে প্রকৃত অর্থে নিজেদের স্বাধীন ভাবা যাবে না। নৌবাহিনীর সাবেক সৈনিকেরা স্বাধীনতা অর্জনের পর তা রক্ষা করার জন্য প্রতিটি পরিবার থেকে একজন করে সশস্ত্রবাহিনীতে যোগ দেয়ারও আহ্বান জনান। সভাশেষে সৈনিকেরা মিছিলসহকারে শেখ মুজিবুর রহমানের বাসায় যান। শেখ মুজিব সাবেক সৈনিকদের উদ্দেশে বলেন, ‘বাংলার ৭ কোটি মানুষের মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত আমি আপনাদের কাঁধে কাঁধ মিলাইয়া সংগ্রাম করিয়া যাইব।’ শেখ মুজিবের ভাষণ চলাকালে একজন সাবেক সৈনিক চিত্কার করে বলেন, ‘হে বঙ্গবন্ধু বাংলার স্বাধীনতা কি করিয়া আদায় করিতে হয় তাহা আমরা জানি। শুধু আপনি আমাদের পাশে থাকুন। আমাদের নেতৃত্ব দিন।’ (দৈনিক আজাদ, ২১ মার্চ ১৯৭১)

২১ মার্চ দৈনিক সংবাদ সূত্রে জানা যায়, ক্যাপ্টেন (অব.) নওয়াব হোসেন ও ক্যাপ্টেন (অব.) আশরাফ আহমদ আর্মড পুলিশসহ সাবেক সৈনিকদের একটি যৌথ কমান্ডের অধীনে প্রশিক্ষণ শুরু করার আহ্বান জানিয়েছেন। তাঁরা প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সর্বজ্যেষ্ঠ বাঙালি সেনা কর্মকর্তা মেজর জেনারেল (অব.) ইসফাকুল মজিদকে উদ্যোগ নেওয়ার অনুরোধ করেন। একই তারিখে ঢাকার উপকণ্ঠে কল্যাণপুরে সাবেক সৈনিকেরা সভার আয়োজন করেন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য থানা পর্যায়ে ‘প্রাক্তন সৈনিক সংগ্রাম পরিষদ’ গঠনের প্রস্তাব দেন। তাঁরা শেখ মুজিবকে ২৫ মার্চের আগেই রাজনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ঘোষণার জন্য আহ্বান জানান।

২২ মার্চ বায়তুল মোকাররম মসজিদ প্রাঙ্গণে সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর সাবেক সৈনিকদের বিশাল সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এই সমাবেশের ঘোষণা আগেই পত্রিকার মাধ্যমে প্রচার করা হয়েছিল। সমাবেশে সাবেক সৈনিকেরা ছাড়াও ছুটিতে অবস্থানরত চাকরিরত সৈনিকেরাও পোশাক পরে অংশ নেন। সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন ১৯২৪ সালে সান্ডহার্স্ট মিলিটারি কলেজ থেকে কমিশন পাওয়া মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ ইসফাকুল মজিদ। সভা পরিচালনা করেন লে. কর্নেল (অব.) আতাউল গনী ওসমানী। সভায় বক্তৃতা করেন জেনারেল মজিদ, কর্নেল ওসমানী, লে. কমান্ডার আবেদীন, সৈয়দ আহমদ, এস এস হোসেন, মাহমুদুন্নবী, খলিলুল্লাহ্, আশরাফ প্রমুখ। ‘জয় বাংলা’ সংগীতের সঙ্গে সামরিক কায়দায় অভিবাদন জনানোর মাধ্যমে সভার কাজ শুরু হয়। সমাবেশে দেশের আসন্ন স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য উপস্থিত সবাই শপথ নেন। যাঁরা আসতে পারেননি, সমাবেশে তাঁদের প্রতিও আহ্বান জানানো হয়। সমাবেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কর্মরত সব বাঙালি কর্মকর্তা ও জওয়ানকে কর্মস্থল ত্যাগ করে স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগদানের জন্য চলে আসারও আহ্বান জানানো হয়। বক্তারা আরও বলেন, তাঁরা আর সাবেক হিসেবে বসে থাকতে পারেন না, তাঁদের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানোর সময় এসেছে। তাঁদের অভিজ্ঞতার সাহায্যে জনসাধারণকে প্রস্তুত ও সুশৃঙ্খল করে গড়ে তুলতে চান। জেনারেল মজিদ বলেন, ‘আমরা সৈনিক। কথার চাইতে কাজে বেশী বিশ্বাস করি।’ (দৈনিক আজাদ, ২৩ মার্চ ১৯৭১)। সাবেক সৈনিকদের কথা শোনার জন্য বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গণে বিপুল জনসমাগম হয়। জনতা বক্তৃতার মধ্যে মধ্যে হর্ষধ্বনি ও করতালির মাধ্যমে সৈনিকদের প্রতি সমর্থন প্রকাশ করে। ঢাকার নবাব পরিবারের সদস্য মেজর হাসান আশকারী এই সমাবেশে চলমান আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন।

সভা শেষে সৈনিকেরা বাদ্যের তালে তালে মার্চ করে শহীদ মিনারে আসেন, এখানে মিনারের বেদিতে সামরিক কায়দায় পুষ্পমাল্য অর্পণ করেন। এখান থেকে মার্চ করে তাঁরা শেখ মুজিবের ধানমন্ডির বাসায় যান। মার্চে নেতৃত্ব দেন জেনারেল মজিদ ও কর্নেল ওসমানী। সাবেক সৈনিকদের সমগ্র যাত্রাপথে রাস্তার দুই পাশ থেকে জনতা হর্ষধ্বনি ও করতালি দিয়ে উত্সাহ দেয়।

শেখ মুজিব বাড়ির গেটে সাবেক সৈনিকদের স্বাগত জানান। সেখান থেকে তিনি জেনারেল মজিদ, কর্নেল ওসমানীসহ চারজনকে বাড়ির ভেতর নিয়ে যান। তাঁদের নিয়ে তিনি তাঁর লাইব্রেরিতে একান্ত বৈঠক করেন। জেনারেল মজিদ এ বৈঠকে শেখ মুজিবকে শক্তির প্রতীক একটি তরবারি উপহার দেন এবং অবসরপ্রাপ্ত বাঙালি সৈনিকদের পক্ষ থেকে তাঁদের সার্ভিস বঙ্গবন্ধুর কাছে নিবেদন করেন। শেখ মুজিব সসম্মানে চুম্বনের সঙ্গে তরবারিটি গ্রহণ করেন।

২২ মার্চ মগবাজারে অনুষ্ঠিত পাক মোটর মহিলা সংগ্রাম পরিষদের সভায় সাবেক সৈনিকদের অনতিবিলম্বে জেনারেল মজিদের নেতৃত্বে একটি প্যারামিলিটারি বাহিনী গঠনের জন্য আহ্বান জানানো হয়।

এই সমাবেশে ও মার্চপাস্টে অংশ নেওয়া বিমানবাহিনীর সর্বজ্যেষ্ঠ সাবেক সৈনিক উইং কমান্ডার এস আর মীর্জা উল্লেখ করেছেন, ‘এর মধ্যে আমার এক ভাতিজা একদিন ফোন করে আমাকে বলল, ২২ মার্চ অবসরপ্রাপ্ত সামরিক লোকদের একটি মার্চপাস্ট অর্থাত্ শোভাযাত্রা হবে বায়তুল মোকাররমে, কর্নেল ওসমানী সেখানে থাকবেন। আমি যেন উপস্থিত থাকি। আমি সেখানে গেলাম। গিয়ে দেখলাম কর্নেল রব আছেন, জেনারেল মজিদ আছেন। আমরা তিন লাইনে দাঁড়ালাম। আমি একটা লাইনে ছিলাম। কর্নেল ওসমানী এসে আমাকে বললেন, বিমানবাহিনীর মধ্যে আপনি সবচেয়ে সিনিয়র। আপনি বিমানবাহিনীর প্রতিনিধিত্ব করেন। এতে আমি রাজি হলাম। শোভাযাত্রা শেষ করে আমরা বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে গেলাম। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমাদের দেখা হলো।’ (প্রথম আলো, ১৬ ডিসেম্বর ২০০৮)

সূত্র: ২৬ মার্চ ২০০৯ প্রথম আলোর "স্বাধীনতা দিবস" বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত