স্বাধীনতা দিবস-২৬ মার্চ

বাংলাদেশ-পাকিস্তান : স্বীকৃতির খেলা

জাতিসংঘের সদস্যপদ অর্জিত না হলে বড় ধরনের আন্তর্জাতিক সাহায্য কার্যক্রম চালু হওয়ার সম্ভাবনাও কম। কিন্তু সেখানেও বাগড়া দিয়ে রেখেছে চীন। মুক্তিযুদ্ধের সময় সে পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করেছিল। এ অবস্থায় পাকিস্তানের স্বীকৃতি অর্জন বাংলাদেশের জন্য একটি প্রধান কূটনৈতিক অগ্রাধিকারে পরিণত হয়। ইসলামাবাদ স্বীকৃতি দিলে ইসলামি দেশগুলোর আপত্তি বা চীন-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৈরিতা কমবে-এমন আশা করা অযৌক্তিক ছিল না।

পূর্বকথা

১৯৭৪ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। তার দুদিন পর ২৪ ফেব্রুয়ারি লাহোরে ইসলামিক সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেন, যুদ্ধাপরাধের জন্য যে ১৯৫ জন পাকিস্তানি সেনাসদস্যকে বাংলাদেশ চিহ্নিত করেছে, তাদের ব্যাপারে একটি সমঝোতায় আসতে তিনি প্রস্তুত। ৯ এপ্রিল দিল্লিতে ভারত-পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত এক ত্রিপক্ষীয় চুক্তিতে বাংলাদেশ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে তার সকল দাবি প্রত্যাহার করে নেয়। তার আড়াই মাস পর ২৭ জুন জুলফিকার আলি ভুট্টো ঢাকায় সরকারি সফরে আসেন। সে সফরের সময় প্রকাশ্যে ভারতের বিপক্ষে ও পাকিস্তানের পক্ষে মিছিল করা হয়। ১৪ মাস পরে ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেনা অভ্যুত্থানে সপরিবারে নিহত হন। তার মৃত্যুর তিন বছর পর ১৯৭৮ সালে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত গোলাম আজম বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। আরো এক বছর পর ১৯৭৯ সালে ইতিপূর্বে নিষিদ্ধ ঘোষিত জামায়াতে ইসলামীকে প্রকাশ্যে রাজনীতি করার অনুমতি দেওয়া হয়। আর তার মাত্র ১২ বছর পর ২০০১ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে একটি দক্ষিণপন্থি চারদলীয় জোটের সদস্য হিসেবে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশে সরকার গঠনের অধিকার অর্জন করে।

এসব ঘটনা সব যে একে অপরের সঙ্গে সমির্কত তা নয়। জটিল জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির প্রভাবে এসব ঘটনা নির্মিত। কিছুটা ষড়যন্ত্র, কিছুটা রাজনৈতিক অদূরদর্শিতাও তার পেছনে রয়েছে। বক্ষ্যমাণ আলোচনায় আমরা সেসব প্রশ্নের বিবেচনায় যাব না। আমাদের লক্ষ্য ১৯৭২ থেকে ১৯৭৪ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সোয়া দু বছরে বাংলাদেশ-পাকিস্তান সমের্কর চালচিত্র উদ্ধার এবং মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তার বিজয় ও ব্যাপক আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি সত্ত্বেও বাংলাদেশ কীভাবে কূটনৈতিকভাবে পরাস্থ হলো তার কতিপয় লক্ষণ চিহ্নিত করা। একটি অনুল্লেখ্য উদ্দেশ্য থাকবে, এই ব্যর্থতার কারণে একাত্তরবিরোধী শক্তিসমূহের প্রত্যাবর্তনের বীজ কীভাবে বোনা হলো, তার উত্তর খোঁজা। এই পর্বের ইতিহাসটি নির্মাণে আমি নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় প্রতিবেদিত ঘটনাক্রম অনুসরণ করেছি। বর্তমানে সিঙ্গাপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনারত মোহাম্মদ আয়ুবের ইন্ডিয়া, পাকিস্তান অ্যান্ড বাংলাদেশ সার্চ ফর নিউ রিলেশনস (নিউদিল্লি, ১৯৭৫) ও ডেনিস রাইটের বাংলাদেশ অ্যান্ড ইন্ডিয়ান ওশান কান্ট্রিস, ১৯৭১-১৯৭৫ (ইন্টারনেট থেকে সংগৃহিত) গ্রন্থ দুটি থেকেও আমি প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করেছি। রচনাটির প্রধান সীমাবদ্ধতা বাংলাদেশী তথ্য সূত্রের স্বল্পতা। সে কথা আমি গোড়াতেই কবুল করে নিচ্ছি।

মুজিব ও ভুট্টো

‘জুলফিকার আলি ভুট্টো ঘোষণা করেছেন, আগামী দু-এক দিনের মধ্যেই শেখ মুজিবকে মুক্তি দেবেন। মুজিব তার ইচ্ছেমতো যেকোনো স্থানে যেতে পারেন, তার কাছ থেকে আগাম কোনো প্রতিশ্রুতিও চাওয়া হবে না। ভুট্টো বলেন, কোনো চাপের মুখে থেকে নয়, পাকিস্তানের দুই অংশের দুই নির্বাচিত নেতা হিসেবে তিনি ও মুজিব কথা বলেছেন। তিনি আশা ব্যক্ত করেন যে, পাকিস্তান নামটি রেখে সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে শিথিল কোনো মৈত্রী সমর্ঙ্ক বজায় রাখা সম্ভব হবে’ (নিউইয়র্ক টাইমস, ২ জানুয়ারি ১৯৭২)।

‘পাকিস্তান রেডিও জানিয়েছে, মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে এবং তিনি ঢাকার উদ্দেশে রওনা হয়ে গেছেন। বিমানবন্দরে মুজিবকে বিদায় দিতে গিয়ে ভুট্টো বলেছেন, পূর্ব পাকিস্তানের নেতা হিসেবে মুজিবের ওপর তার ইচ্ছা চাপিয়ে দেওয়ার কোনো চেষ্টা তিনি করবেন না।’ (টাইমস, ৮ জানুয়ারি ১৯৭২)

১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের ভেতর দিয়ে স্বাধীন সর্বভৌম বাংলাাদেশের অভ্যুদয়। পরবর্তী ছয় মাসের ভেতরেই, যুক্তরাষ্ট্রসহ পৃথিবীর অধিকাংশ দেশ এই নব্য স্বাধীন দেশটিকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি জানায়। কিন্তু এই ধারায় প্রধান ব্যতিক্রম ছিল চীন, অধিকাংশ ইসলামি/আরব দেশ ও পাকিস্তান।

পাকিস্তানের স্বীকৃতি বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত জরুরি ছিল একাধিক কারণে। নব্য স্বাধীন এই দেশটি কাগজে-কলমে স্বাধীনতা অর্জন করলেও টিকে থাকার এক মরণপণ সংগ্রাম তার মাত্র শুরু হয়েছে। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের ফলে তার অবকাঠামো বিধ্বস্ত। অধিকাংশ বাণিজ্যিক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান মুখ থুবড়ে রয়েছে। শোনা যাচ্ছে, দুর্ভিক্ষের অশনি সংকেত। সে সময় তার বন্ধু বলতে একমাত্র দেশ প্রতিবেশী ভারত এবং তারই সূত্রে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন। বাংলাদেশকে সাহায্য করার ক্ষমতা তাদের কারোরই অফুরন্ত নয়। তেলসমৃদ্ধ আরব দেশগুলো সাহায্যের হাত বাড়ালে অবস্থা অনেকটা বদলায়। কিন্তু পাকিস্তানকে নারাজ করে তাদের কেউ সে পথে পা বাড়াবে না। জানুয়ারির গোড়ায় ভুট্টো ঘোষণা দিয়ে বসেছিলেন, বাংলাদেশকে যারা স্বীকৃতি দেবে, তাদের সঙ্গে পাকিস্তান সমর্ঙ্ক ছিন্ন করবে। জাতিসংঘের সদস্যপদ অর্জিত না হলে বড় ধরনের আন্তর্জাতিক সাহায্য কার্যক্রম চালু হওয়ার সম্ভাবনাও কম। কিন্তু সেখানেও বাগড়া দিয়ে রেখেছে চীন। মুক্তিযুদ্ধের সময় সে পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করেছিল। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়ে তাকে ক্ষেপিয়ে তোলায় তার কোনো আগ্রহ ছিল না। এ অবস্থায় পাকিস্তানের স্বীকৃতি অর্জন বাংলাদেশের জন্য একটি প্রধান কূটনৈতিক অগ্রাধিকারে পরিণত হয়। ইসলামাবাদ স্বীকৃতি দিলে ইসলামি দেশগুলোর আপত্তি বা চীন-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৈরিতা কমবে-এমন আশা করা অযৌক্তিক ছিল না।

পাকিস্তান বাংলাদেশের জন্ম মেনে নেয়নি। সে বিনা ওজরে তাকে স্বীকৃতি দেবে-তা আশা করা তাই বাতুলতা। পাকিস্তানের জন্য সবচেয়ে গ্লানির বিষয় ছিল এই দেশ ভাগের ভেতর দিয়ে সে আজন্মশত্রু ভারতের কাছে রাজনৈতিকভাবে যেমন, সামরিকভাবেও মারাত্মক পরাজয়বরণ করে। ভারতের হাতে তখন প্রায় ১ লাখ পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দি আটকা পড়ে আছে। ঢাকায় ভারত-বাংলাদেশ যৌথ কমান্ডের হাতে তারা আত্মসমর্পণ করে। বাংলাদেশকে সমতার ভিত্তিতে আলোচনায় অংশগ্রহণ করতে না দিলে ভারত একা যুদ্ধবন্দি প্রশ্নে কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না, দিল্লি সে কথা ইসলামাবাদকে জানিয়ে দেয়। এদিকে ঢাকা বারবার ঘোষণা করে, যুদ্ধবন্দি যে ১৯৫ জন পাকিস্তানি সৈন্য ও অফিসারকে চিহ্নিত করা হয়েছে, যুদ্ধাপরাধের জন্য তাদের বিচারে সে বদ্ধপরিকর। পাকিস্তানের নব্য কর্ণধার জুলফিকার আলি ভুট্টোর জন্য সে সময় মাথাব্যথার প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়ায় একদিকে যুদ্ধবন্দিদের ফেরত আনার প্রশ্নটি, অন্যদিকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকান। ১৯৭১ সালের যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনা সমঙ্ূর্ণ পর্যুদস্ত হলেও তার ক্ষমতায় টিকে থাকা ও সর্বতোভাবে নির্ভর করে পাঞ্জাবি সেনা কমান্ডের মর্জির ওপর। ভুট্টো সে কথা খুব ভালো করেই জানতেন। আটকে পড়া সেনাসদস্যদের অধিকাংশই ছিল পাঞ্জাবের চারটি জেলা ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের দুটি জেলার বাসিন্দা। ১৯৭২ সালের গোড়া থেকেই প্রদেশ দুটিতে সেনাসদস্যদের পরিবার-পরিজনদের মধ্যে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। সেনাবাহিনীর অধস্তন সদস্যদের মধ্যেও ক্ষোভ দানা বাঁধছিল। ইয়াহিয়া খানের ওপর সব দোষ চাপিয়ে নিজে রাষ্ট্রনায়ক বনতে চেষ্টা করলেও বন্দি সেনাসদস্যদের দেশে ফিরিয়ে আনার দাবির মুখোমুখি ভুট্টোকে হতেই হয়। তাদের প্রত্যাবর্তন যত বিলম্বিত হচ্ছিল, রাজনৈতিকভাবে তত কোণঠাসা হয়ে পড়ছিলেন তিনি।

এ অবস্থায় বাংলাদেশকে স্বীকৃতি ও জাতিসংঘে তার অন্তর্ভুক্তির প্রশ্নটি তুরুপের তাস হিসেবে ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিলেন ভুট্টো। তিনি ইঙ্গিত করলেন, বাংলাদেশকে সময়মতো স্বীকৃতি দিতে তিনি প্রস্তুত, কিন্তু তার আগে সকল পাকসেনাকে দেশে ফেরত পাঠাতে হবে। অন্যদিকে বাংলাদেশের রণকৌশল দাঁড়াল, সৈন্য ফেরত পাঠানো প্রশ্নে কোনো আলাপ-আলোচনা করতে হলে আগে কূটনৈতিক স্বীকৃতি চাই। একমাত্র সমতার ভিত্তিতেই আলাপ-আলোচনা হতে পারে, আর সেই সমতার প্রথম শর্তই হলো স্বীকৃতি।

বাংলাদেশকে স্বীকৃতির ব্যাপারে ভুট্টো অনেকটা দুমুখো পথ ধরেন। প্রকাশ্য বক্তৃতা-বিবৃতিতে তিনি স্বীকৃতির প্রশ্নটি বাতিল করলেও কূটনৈতিক চ্যানেলগুলোর মাধ্যমে তিনি স্বীকৃতির প্রশ্নটি শুধু সময়ের ব্যাপার বলে ইঙ্গিত দিতে শুরু করলেন। প্রেসিডেন্ট নিক্সনের কাছে পাঠানো একাধিক বার্তায় সে কথা তিনি খোলাসা করে বলেন। বাংলাদেশকে ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের ‘খপ্পর’ থেকে রক্ষা করার জন্যও বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়া প্রয়োজন। সে যুক্তিও তিনি তুলে ধরেন। কিন্তু বাংলাদেশকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি দেওয়ার আগে যে বিষয়টি তার জন্য প্রধান বিবেচ্য হয়ে ওঠে তা হলো ভারতে অবস্থানরত পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দিদের ফিরিয়ে আনা। বাংলাদেশ আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপক স্বীকৃতি পেলে ভারত ও বাংলাদেশের সঙ্গে দরকষাকষিতে পাকিস্তান দুর্বল হয়ে পড়বে, সে কারণে তা ঠেকাতে ভুট্টো ব্যক্তিগতভাবে তত্পর হয়ে ওঠেন। ১২ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে এক সংবাদ সম্মেলনে ভুট্টো চট করে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেওয়ার জন্য বিভিন্ন দেশের কাছে আবেদন করেন, কারণ খুব তাড়াতাড়ি স্বীকৃতি দিলে ‘মুসলিম বাংলার’ সঙ্গে কোনো রকম সমঝোতায় আসা পাকিস্তানের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়বে। পাকিস্তানের ভেতরে বাংলাদেশের জন্ম মেনে নিতে খুব কম লোকই প্রস্তুত ছিল। সে কথা স্মরণ রেখেই এ সময় ভুট্টো পাকিস্তানের দুই অংশের পুনঃসংযুক্তির কথা বারবার উচ্চারণ করছিলেন। মুসলিম দেশগুলোও পাকিস্তানি চাপের মুখে এবং ইসলামি সংহতির নামে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেওয়ার নীতি গ্রহণ করে। জানুয়ারির ১০ তারিখে কায়রোতে আফ্রো-এশীয় সংহতি সম্মেলনে বাংলাদেশ একটি বেসরকারি প্রতিনিধি দল পাঠিয়েছিল। তারা সদস্যপদের জন্য আবেদন করলে লিবিয়া ও অন্যান্য আরব দেশের প্রতিবাদের মুখে সে প্রস্তাব গ্রহণের বদলে তা একটি বিশেষ কমিটির কাছে বিবেচনার জন্য পাঠানো হয়।

কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগের লক্ষ্যে যারা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবে তাদের সঙ্গে পাকিস্তান সকল সমর্ঙ্ক ছিন্ন করবে বলেও ভুট্টো এ সময় ঘোষণা করেন। সঙ্ষ্টতই তার বিশেষ লক্ষ্য ছিল ইসলামিক দেশগুলো। তারা যাতে সে পথে পা না বাড়ায় সে উদ্দেশ্যে লবি করার জন্য ভুট্টো নিজে জানুয়ারির শেষ নাগাদ বেশ কয়েকটি ইসলামি দেশ সফর করেন। ভুট্টোর জোরালো ক্যামেঙ্ইন সত্ত্বেও জানুয়ারির মাঝামাঝি থেকে একের পর এক পূর্ব ইউরোপীয় দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়া শুরু করে। তিনি কথায় ও কাজে এক তা প্রমাণের জন্য তাদের কোনো কোনোটির সঙ্গে সত্যি সত্যিই কূটনৈতিক সমর্ঙ্ক ছিন্ন করেন। সে সব দেশের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-বুলগেরিয়া, মঙ্গোলিয়া, পূর্ব জার্মানি ও যুগো্পাভিয়া। প্রায় একই সময়ে একাধিক পশ্চিম ইউরোপীয় দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়, যেমন-ডেনমার্ক, সুইডেন ও ফিনল্যান্ড, কিন্তু তাদের কারো সঙ্গেই পাকিস্তান তার সমর্ঙ্ক ছেদ করেনি। সমর্ঙ্ক ছেদের হুমকি দিয়ে পাকিস্তান যে খুব সুবিধা করতে পারছে না, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ মেলে ২৪ জানুয়ারি সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার কথা ঘোষণা করলে। ভুট্টো সেদিন মরক্কোর রাজধানী রাবাতে। তার দেশ এখন মস্কোর সঙ্গে সমর্ঙ্ক ছেদ করবে কি না জানতে চাওয়া হলে ভুট্টো জানান, বৃহত্ শক্তিসমূহের ব্যাপারে পাকিস্তানকে বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অন্য কথায়, ক্ষুদ্র দেশ হিসেবে কোনো পরাশক্তির বিরুদ্ধে একতরফা ব্যবস্থা পাকিস্তান চাইলেও নিতে পারবে না। রাবাতেই ভুট্টো প্রথমবারের মতো ঘোষণা করেন, বাংলাদেশ যে একটি বাস্তবতা, সে সত্যটি মেনে নেওয়া ছাড়া পাকিস্তানের আর পথ নেই (নিউইয়র্ক টাইমস, ২৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২)। জানুয়ারির শেষ নাগাদ সঙ্ষ্ট হয়ে যায় যে, ব্রিটেনসহ অধিকাংশ কমনওয়েলথভুক্ত দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে যাচ্ছে। সে কথা জানতে পারার সঙ্গে সঙ্গে ভুট্টো তড়িঘড়ি করে কমনওয়েলথ থেকে পাকিস্তানের সদস্যপদ প্রত্যাহার করে নেন। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এ কথাও ঘোষণা করেন যে, ব্রিটেনের সঙ্গে তার দেশ কূটনৈতিক সমর্ঙ্ক বজায় রাখবে (নিউইয়র্ক টাইমস, ৩১ জানুয়ারি ১৯৭২)।

কূটনৈতিক হুমকি দিয়ে খুব একটা কাজ হচ্ছে না, এ কথা সঙ্ষ্ট হয়ে গেলে ভুট্টো তার সুর নরম করে আনেন। এবার তিনি আবদার তোলেন যে, স্বীকৃতির প্রশ্নে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে মুজিবের সঙ্গে তিনি সরাসরি কথা বলতে চান। ক্রিশ্চিয়ান সায়েন্স মনিটর পত্রিকার সঙ্গে এক সাক্ষাত্কারে তিনি যুক্তি দেখান, দুই দেশের মানুষের মধ্যে যে ভাঙন ধরেছে তা সংস্কারের সব চেষ্টা করে দেখতে চান তিনি (আয়ুবের গ্রন্থে উদ্ধৃত, পৃ. ৭৭)। একই বছর আগস্ট মাসে মুজিব লন্ডনে চিকিত্সার জন্য এলে ভুট্টো তাকে ব্যক্তিগতভাবে টেলিফোন করে মুখোমুখি সাক্ষাতের প্রস্তাব করেন। ২৫ মার্চ ইসলামাবাদে মার্কিন রাষ্ট্রদূত জোসেফ ফারল্যান্ডের সঙ্গে এক সাক্ষাত্কারে ভুট্টো সঙ্ষ্ট করেই জানিয়ে দেন, ‘বাংলাদেশকে স্বীকৃতির প্রশ্নটি আদৌ জটিল কোনো ব্যাপার নয়। যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্যদের তিনি আগেই জানিয়েছিলেন যে ঠিক সময় ও পরিস্থিতিতে তিনি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবেন। ভুট্টো সে সাক্ষাত্কারের সময় জানান যে, এর আগের সপ্তাহে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার এলেক ডগলাস হিউমকে তিনি জানিয়েছেন, স্বীকৃতির ব্যাপারে তিনি এই আগাম লিখিত প্রতিশ্রুতি দিতে প্রস্তুত যে, মুজিবের সঙ্গে মুখোমুখি সাক্ষাতের পর তিনি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবেন’ (দেখুন, দি আমেরিকান পেপারস, অক্সফোর্ড ইউ. প্রেস, ১৯৯৯, পৃ : ৮২৭)।

মুজিবের সঙ্গে মুখোমুখি সাক্ষাতের দাবিটি এরপর আরো কয়েকবার তুলেছিলেন ভুট্টো। ১৯৭২ সালের জুলাইতে ভারত-পাকিস্তান শীর্ষ পর্যায়ে বৈঠকের পর ভুট্টো এমন কথাও বললেন, ‘মুজিবের সঙ্গে কথা শুরু হওয়ামাত্রই আমরা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেব। তার সঙ্গে আলোচনার ফলাফর যাই হোক না কেন, (স্টেটসম্যান, কলকাতা, ১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭২)।

মুজিবের সঙ্গে মুখোমুখি সাক্ষাতে ভুট্টোর এই আগ্রহের একটি কারণ তার নিজ দেশবাসীকে বোঝান, কোনো রকম চাপের মুখে নয়, নিজের শর্তেই তিনি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে সম্মত হয়েছেন। স্বীকৃতি ছাড়াই বাংলাদেশ পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনায় রাজি হলে দেশের ভেতর ভুট্টোর প্রভাব নির্ঘাত বৃদ্ধি পেত। বাংলাদেশে প্রায় সবাই এবং পাকিস্তানের ভেতরে অনেকেই বাংলাদেশের গণহত্যার জন্য ভুট্টোকে দায়ী করে থাকেন। সে দায়ভার ঘোচানোর একটা চেষ্টা ছিল মুজিবকে দ্রুত মুক্তি দেওয়া। বাংলাদেশের সঙ্গে যেমন করেই হোক একটি কাঠামোগত সমর্ঙ্ক বজায় রাখতে তিনি যে বদ্ধপরিকর, সে কথাও তার দেশবাসীকে বোঝাতে আগ্রহী ছিলেন ভুট্টো। এ ব্যাপারে মুজিবের কাছে তিনি প্রথমবারের মতো প্রস্তাব তোলেন ২৭ ডিসেম্বর ১৯৭১। মুজিব তখনো পাকিস্তানে বন্দি। ভুট্টোর সঙ্গে সাক্ষাত্কারের জন্য তাকে বিশেষ বিমানে করে মিয়ানয়ালির জেল থেকে পিন্ডিতে নিয়ে আসা হয়। কোনো কোনো ভাষ্যকার ইঙ্গিত করেছেন যে, সে বৈঠকে মুজিব পাকিস্তান-বাংলাদেশের মধ্যে কনফেডারেশনের গঠনের প্রস্তাবটি সমর্থন করেন। কিন্তু মার্কিন গবেষক স্টানলি ওয়ালপার্ট তার তথ্যনির্ভর গ্রন্থ জুলফিকার আলি ভুট্টো অব পাকিস্তান (অক্সফোর্ড ইউ. প্রেস, ১৯৯৩)-এ সরকারি আর্কাইভে রক্ষিত তাদের দুজনের রেকর্ডকৃত কথোপকথনের যে বিবরণ দিয়েছেন, তার ছবিটি কিছুটা ভিন্ন। কনফেডারেশনের প্রশ্নে মুজিব আপাতভাবে সম্মত হয়েছিলেন বটে, কিন্তু ওয়ালপার্ট এ কথা ঠিকই ধরতে পেরেছিলেন যে, সেনা প্রহরায় বন্দি অবস্থায় চাপের মুখেই মুজিব সে কথা বলেছিলেন। সে কথোপকথন ওয়ালপার্টের মন্তব্যসহ এখানে তুলে ধরছি :

“সেনা গার্ডসহ কারাকক্ষে ভুট্টো প্রবেশ করলে মুজিব খুবই বিস্মিত হন। ইতিমধ্যে কী ঘটে গেছে, তার কিছুই তিনি জানতেন না। ‘আমি ভেবেছিলাম আরেকটা দুর্যোগ বোধহয় নেমে এসেছে’ তিনি ভুট্টোকে বললেন। পিন্ডিতে ক্ষমতার হাত বদলের কথা ভুট্টো তাকে জানালে মুজিব মন্তব্য করেন, ‘আমি খুশি হয়েছি, বিশ্বাস করুন, আমি খুশি হয়েছি। এখন বলুন আমার বাংলার কী অবস্থা। আমি খুবই উদ্বিগ্ন অবস্থায় আছি।’

ভুট্টো তাকে ব্যাখ্যা করে জানালেন, ‘ভারতীয় বাহিনী ঢাকা ‘দখল’ করে আছে। সোভিয়েত অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে, সোভিয়েত বিমান ও নৌবহরের প্রহরায় তারা সেখানে গেছে। সে কথা শুনে মুজিব আর্তনাদ করে ওঠেন, ‘তার মানে তারা আমাদের হত্যা করেছে, ভুট্টো, তারা আমাদের মেরে ফেলেছে। আমাকে এখনি ঢাকায় পাঠানোর ব্যবস্থা করুন। আপনাকে একটা আশ্বাস দিতে হবে। যদি ভারতীয়রা আমাকে জেলে পাঠায়, তাহলে আপনি আমার হয়ে লড়বেন।’

ভুট্টো প্রতিশ্রুতি দিয়ে বললেন, ‘আমরা একসঙ্গে লড়ব।’

‘না, না, চেঁচিয়ে উঠলেন মুজিব। তিনি ভালো করেই জানতেন যার সঙ্গে তিনি কথা বলছেন কেমন ধরনের মানুষ তিনি। তিনি এ কথা খুব ভালো করে জানতেন, তার প্রতিটি কথা রেকর্ড করা হচ্ছে। মুজিব বললেন, ‘আমার সমস্যা আমাকেই মোকাবিলা করতে হবে। বিদেশী সেনাবাহিনী এখন সেখানে রয়েছে। আওয়ামী লীগ একা তাদের হঠাতে পারবে না। আপনার সাহায্য আমি চাই। আমি ভারতীয় বাহিনী থাকুক, তা চাই না। আপনি সে কথা বিশ্বাস করেন তো?’

‘আমি আপনাকে বিশ্বাস করি, আর সে জন্যই তো সবার আগে আপনার মুক্তির ব্যবস্থা করেছি।’

‘আপনি এখন দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন, তাতে আমি খুবই খুশি হয়েছে।’ মুজিব সে কথা ফের বললেন, যদিও তার গলা শুনে মনে হলো না তিনি খুশি হয়েছেন। তার তখন একমাত্র চিন্তা নিজের প্রিয়তম ঢাকাকে তিনি আবার কখন দেখতে পাবেন, আদৌ দেখতে পাবেন কি না তাও নিশ্চিত নয়। এরপর মুজিব তাকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি তাহলে সেনাবাহিনী ভেঙে দিয়েছেন?

ভুট্টোর জবাব, ‘সেটা কোনো জরুরি ব্যাপার নয়। সেনাবাহিনী আর ক্ষমতায় ফিরে আসতে পারবে না। আমি শুধু চাই আমার দেশের ঐক্য, তা যে শর্তেই হোক না কেন।’ ভুট্টো তখনো স্বপ্ন দেখছেন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান ফের এক হবে। তিনি আমাদের না বলে আমার দেশ বললেন, কারণ মুজিবকে তিনি তখনো বিশ্বাস করতেন না, যেমন মুজিব তাকে বিশ্বাস করতেন না।

‘না, না, কোনো শর্ত নয়,’ মুজিব বললেন, ‘আপনি বলুন, আমাদের দেশের এখন কী অবস্থা।’

‘মুজিব ভাই, আমরা একসঙ্গে থাকব, তার কি কোনো সম্ভাবনাই নেই?’

‘আমি ঢাকায় জনসভা করব, আমি আমার দেশের মানুষের সঙ্গে কথা বলব, তারপর আপনাকে জানাব। এই প্রতিশ্রুতি আমি দিচ্ছি। এ নিয়ে এখনি আমি কিছু বলতে পারব না।’ প্রেসিডেন্ট ভুট্টোর সঙ্গে তিনি সমঝোতা করছেন সে কথা জানতে পারলে তার দলের নেতা-কর্মীরা কতটা দুঃখ পাবে তা ভেবে মুজিব সঙ্ষ্টতই ব্যাকুল ছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই লোকটি, যার হাতে তার জীবন ও মৃত্যুর চাবি রয়েছে, তার সঙ্গে তিনি মোটেই বিনীত হয়ে কথা বলছিলেন না।

এরপর আরো ১১ দিন জেলে আটকে রাখা হয় মুজিবকে। ৭ জানুয়ারি রাতে ফের তার সঙ্গে দেখা করতে এলেন ভুট্টো। সে সময় তিনি মুজিবকে দলে টানতে খুবই উদগ্রীব। যে পাকিস্তান ইয়াহিয়ার কারণে দ্বিখণ্ডিত হয়েছে, তাকে তিনি ফের জোড়া লাগাবেন। দেশের মানুষ তাকে বলবে কায়েদে আজম শহিদ-ত্রাণকর্তা ভুট্টো।

‘২৭ তারিখে আপনি বলেছিলেন সশস্ত্র বাহিনী, পররাষ্ট্রনীতি ও অর্থ, এ রকম দুটো বা তিনটি ক্ষেত্রে আমরা একসঙ্গে থাকতে পারি। ভুট্টো মুজিবকে স্মরণ করিয়ে দিলেন।

মুজিব সন্ত্রস্তভাবে বললেন, ‘কিন্তু সেসব বিষয়ে কথা বলার আগে আমাকে মুক্তি দিতে হবে।’

(দুই দেশের মধ্যে) কনফেডারেশন ব্যবস্থা, তা যত শিথিলই হোক না কেন, তাতে আমি সম্মত।’

‘না, না, আমি আপনাকে আগেই বলেছি আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। কোনো একটা ব্যবস্থা আমরা করতে পারি। কনফেডারেশনের কথা আমি বলেছি। এ কথা কিন্তু একদম আপনার-আমার মধ্যে। আমি আশা করি এ কথা আর কাউকে আপনি বলেননি, মুজিব বললেন।

ভুট্টো বললেন, শুনুন, প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, যা খুশি আপনি হতে পারেন। আমার কোনো কিছুতেই আর আগ্রহ নেই। আমি গাঁয়ে চলে যাব। পবিত্র কোরআন ছুঁয়ে বলছি, আমি গ্রামে চলে যেতে প্রস্তুত।’

মুজিব বললেন, ‘আমি তো বলেছি আমার কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু তার পথ তো আপনার জানা আছে। আমাকে ফিরতে হবে। আমাকে সমস্যার মোকাবিলা করতে হবে। আমাদের সেনাবাহিনী ক্ষতবিক্ষত হয়েছে, ইন্দোনেশিয়ার মতো। আরেকটা কথা-আপনাকে সঙ্ষ্ট করে বলছি, পশ্চিম বাংলার বাঙালিদের ঠেকাতে হবে, আমার মুশকিল তো আপনি বোঝেন।’

‘হ্যাঁ, আমি বুঝি,’ ভুট্টো বললেন।”

কারা প্রকোষ্ঠে সেনা প্রহরায় পাকিস্তানের নতুন রাষ্ট্রপতিকে মুজিব যাই বলে থাকুন না কেন, স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে পা রেখে তার সিদ্ধান্ত ছিল একদম সরলরৈখিক। ১০ ফেব্রুয়ারি ঢাকার রেসকোর্সের উত্তাল জনসমুদ্রে তিনি ঘোষণা করলেন, পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের পুনঃসংযুক্তির কোনো প্রশ্ন ওঠে না এবং যুদ্ধাপরাধের জন্য পাকিস্তানি সেনাসদস্যদের বিচার হতেই হবে।

‘নয় মাসের কারাজীবনের পর শেখ মুজিব জনতার অভিনন্দনে শিক্ত হয়ে আজ দেশে ফিরেছেন। ঢাকার বিশাল জনসভায় তিনি বলেছেন, মুক্ত বাংলায় পা রাখতে পেরে তার জীবনের স্বপ্ন সফল হয়েছে। জনতার উদ্দেশে তিনি আবেদন করেন, ৩০ লাখ বাঙালির হত্যার জন্য কারো বিরুদ্ধে কেউ যেন প্রতিশোধ না নেয়। আজ বাংলাদেশে সবাই বাঙালি, সবাই এখানে শান্তিপূর্ণভাবে থাকবে বলে তিনি ঘোষণা করেন। মুজিব জানান, পাকিস্তান থেকে বিমানে ওঠার আগে ভুট্টো তার শেষ কথায় পাকিস্তানকে এক রাখার অনুরোধ করেছিলেন। তিনি সে আবেদনের জবাব দেননি। পাকিস্তানের সঙ্গে কোনো না কোনো সমর্ঙ্ক বজায় রাখার অনুরোধ সত্ত্বেও সে সমর্ঙ্ক আর সম্ভব নয় বলে মুজিব ঘোষণা করেন’ (নিউইয়র্ক টাইমস, ১১ জানুয়ারি)।

রেসকোর্সের সে ভাষণে মুজিব এ কথা সঙ্ষ্ট করে দেন যে, শুধু সার্বভৌম সমতার ভিত্তিতে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে কোনো আলোচনা হতে পারে। পাকিস্তানিদের উদ্দেশে তিনি বলেন, তোমাদের সেনাবাহিনী যদিও আমাদের বিরুদ্ধে জঘন্যতম অপরাধ করেছে, তোমাদের প্রতি আমাদের কোনো ঘৃণা নেই। তোমরা তোমাদের স্বাধীনতা নিয়ে থাক, আমরা আমাদের স্বাধীনতা নিয়ে থাকব। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্নেও যে তিনি কোনো সমঝোতা করবেন না, তাও সঙ্ষ্ট করে দেন। তিনি জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে যুদ্ধাপরাধের বিচারের আহ্বান জানান।

বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের বিরুদ্ধে ভুট্টোর একটি প্রধান যুক্তি ছিল, যতদিন ভারতীয় সৈন্য বাংলাদেশের মাটিতে আছে, ততদিন দেশটিকে স্বাধীন বলা যায় না। সে কেবলমাত্র ভারতীয় সেনা নিয়ন্ত্রণে। এমন ভূখণ্ডকে সে যেমন স্বীকৃতি দেবে না, তেমনি অন্য কোনো দেশেরও উচিত নয় স্বীকৃতি দেওয়া। কিন্তু ১২ মার্চ ১৯৭২ তারিখের মধ্যে বাংলাদেশের মাটি থেকে শেষ ভারতীয় সৈন্যটি দেশে ফিরে গেলে ভুট্টোর যুক্তির আর কোনো ওজন থাকল না। প্রকৃতপক্ষে ভারত আগে জানিয়েছিল ১৯৭২ সালের ২৫ মার্চের আগে তারা সকল সৈন্য সরিয়ে নেবে। কিন্তু সে সময়সীমা পেরোনোর ১৩ দিন আগেই তার সৈন্য প্রত্যাহার করে নেওয়ায় ভারতীয় আগ্রাসন বিষয়ে যে যুক্তি ভুট্টো তুলে ধরেছিলেন, তা আর ধোপে টিকল না।

মজার ব্যাপার হলো, ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার করে নেওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তান তার মুসলিম মিত্রদের এ কথা বোঝানোর চেষ্টা অব্যাহত রাখল যে, আসলে বাংলাদেশ ভারতের নিয়ন্ত্রণেই রয়েছে। সৈন্য প্রত্যাহারের ব্যাপারটা শুধু চোখে ধুলো দেওয়ার চেষ্টা মাত্র। বাংলাদেশ থেকে শেষ ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহারের প্রায় ছয় মাস পরও পাকিস্তান সেই একই কথা বলতে থাকে। আগস্ট মাসে ভুট্টো মন্ত্রিসভার অন্যতম সদস্য এম কে জাতোই মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া সফরে এসে প্রকাশ্যেই সে কথা বলে যান। জাতোই সে সময় দাবি করেন, শেখ মুজিব ভারতীয় অধিকৃত পূর্ব পাকিস্তানে কার্যত বন্দি রয়েছেন। তিনি যদি দেশের বাইরে এসে নিজের কথা স্বাধীনভাবে বলতে পারতেন, তাহলে যুদ্ধবন্দি প্রশ্নটি কেবল সমাধান হয়ে যেত তা নয়, পাকিস্তানের দুই অংশের পুনঃএকত্রীকরণও সম্ভব হতো। বাংলাদেশ এ সময় জাতিসংঘে সদস্যপদের জন্য চেষ্টা শুরু করে। সেখানেও সেই একই যুক্তি দেখিয়ে বাগড়া দেওয়ার চেষ্টা করে পাকিস্তান। জাতিসংঘ মহাসচিব কুর্ট ওয়ালডহাইমের কাছে লেখা এক চিঠিতে পাকিস্তানের স্থায়ী প্রতিনিধি দাবি করেন যে, ‘পূর্ব পাকিস্তান সমস্যা’র রাজনৈতিক সমাধানের লক্ষ্যে ভুট্টো শেখ মুজিবের সঙ্গে ‘সরাসরি’ আলাপ-আলোচনা শুরু করেছেন। বলাই বাহুল্য যে, বাংলাদেশ সে দাবি এককথায় নাকচ করে দেয়। ভারতীয় স্থায়ী প্রতিনিধির মাধ্যমে বাংলাদেশ এই বলে অভিযোগ তোলে যে, পাকিস্তান পৃথিবীর মানুষকে ধাপ্পা দেওয়ার চেষ্টা করছে।

পাক-ভারত আলোচনা ও বাংলাদেশকে স্বীকৃতির প্রশ্ন

মার্চ ১৯৭২ থেকেই পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে তাদের বিভিন্ন দ্বিপক্ষীয় সমস্যা নিয়ে কূটনৈতিক পর্যায়ে আলাপ-আলোচনা শুরু হয়। দু দেশের মধ্যে সামরিক নিয়ন্ত্রণ রেখা নির্ধারণ সে আলোচনার অন্যতম লক্ষ্য হলেও পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দি প্রত্যাহারের প্রশ্নটি সেখানে অনিবার্যভাবে এসে পড়ে। পাকিস্তান কর্তৃক বাংলাদেশকে স্বীকৃতির প্রশ্নটিও সে আলোচনার বাইরে রাখা স্বাভাবিকভাবেই অসম্ভব ছিল। দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতে তৃতীয় কোনো পক্ষের হস্তক্ষেপ ছাড়া বিভিন্ন প্রশ্নে ভারত-পাকিস্তান আলোচনার প্রস্তাব প্রথম আসে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কাছ থেকে ৩১ ডিসেম্বর ১৯৭১। কিন্তু ভুট্টো বারবার চাপ দিচ্ছিলেন সরকারপ্রধান পর্যায়ে, অর্থাত্ তার ও মিসেস গান্ধীর মধ্যে সরাসরি সে আলোচনার জন্য। কিন্তু সর্বোচ্চ পর্যায়ে আলোচনার আগে পূর্ব আলোচনার জন্য ভারত দূত পর্যায়ে মতবিনিময়ের প্রস্তাব দেয়। অনেক ওজর-আপত্তি তুললেও পাকিস্তান শেষ পর্যন্ত সে প্রস্তাব মেনে নেয়। এদিকে মার্চের ১৮ তারিখ ঢাকা সফরে আসেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। তার সফর শুরুর আগেই দিল্লি থেকে ঘোষণা করা হয়, পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দি প্রশ্নে বাংলাদেশের দাবি ভারত সমর্থন করে। যেসব পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীর ব্যাপারে বাংলাদেশ তথ্য-প্রমাণ হাজির করবে তাদের বিচারের প্রশ্নে ভারত আপত্তি করবে না। বাংলাদেশ সরকার তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহের ব্যাপারে যে নিয়ম-কানুন অনুসরণ করছে, তার আইনগত শুদ্ধতা নিয়ে ভারতের কোনো সন্দেহ নেই বলেও দিল্লি জানায় (নিউইয়র্ক টাইমস, ১৮ মার্চ ১৯৭২)

আসন্ন পাক-ভারত আলোচনায় যুদ্ধবন্দি ও যুদ্ধাপরাধী প্রশ্নে কোন রণকৌশল অবলম্বন করা হবে, তার একটি রূপরেখা ইন্দিরার ঢাকা সফরকালে নির্ধারিত হয়ে যায়। ইন্দিরা ও মুজিব দুজনই সে সময় এ ব্যাপারে একমত হন যে, পাকিস্তান যতক্ষণ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দিচ্ছে, যুদ্ধবন্দি হস্তান্তর প্রশ্নে পাকিস্তানের সঙ্গে কোনো সমঝোতা হবে না। দু দেশের প্রধানমন্ত্রীই পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে ঐকমত্য প্রকাশ করেন। এই সফর শেষে প্রকাশিত যৌথ ইশতেহারে বলা হয় যে, ‘বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে তার সরকার কী কী পদক্ষেপ নিয়েছে, সে ব্যাপারে তাকে অবহিত করেন। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী তাদের দ্রুত বিচারের ব্যাপারে বাংলাদেশ আগ্রহী বলে তিনি জানান। জবাবে ভারতে প্রধানমন্ত্রী দোষী ব্যক্তিদের বিচারের ব্যাপারে তার সরকারের পূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাস প্রদান করেন’ (আয়ুবের গ্রন্থে উদ্ধৃত, পৃ. ৮০)।

ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে ইন্দিরা গান্ধী নিজেই সঙ্ষ্ট জানিয়ে দিলেন, যুদ্ধাপরাধের জন্য বিচারের প্রশ্নটি একান্তভাবে বাংলাদেশের নিজস্ব সিদ্ধান্ত। এ ব্যাপারে তিনি নাক গলাতে চান না। এ প্রশ্ন নিয়ে তার দেশের সঙ্গের পাকিস্তানের সমর্ঙ্ক স্বাভাবিককরণে কোনো বাধা সৃষ্টি হওয়া উচিত নয় বলেও তিনি মন্তব্য করেন। (নিউইয়র্ক টাইামস, ১৯ মার্চ ১৯৭২)।

‘বাংলাদেশ সরকার জানিয়েছে, যুদ্ধাপরাধের জন্য তারা ১ হাজার পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তা ও সৈন্যের বিচার করবে। যাদের নাম এই তালিকায় রয়েছে তারা হলেন জেনারেল নিয়াজি ও জেনারেল রাও ফরমান আলি। জেনারেল টিক্কা খানকে তার অনুপস্থিতিতে বিচার করা হবে। প্রধান অপরাধীদের দেশী ও আন্তর্জাতিক বিচারকমণ্ডলী সমন্বয়ে গঠিত প্যানেলের হাতে বিচার হবে; অন্যদের ক্ষেত্রে বাঙালি বিচারকদের সে দায়িত্ব দেওয়া হবে’ (নিউইয়র্ক টাইমস, ৩০ মার্চ, ১৯৭২)।

যুদ্ধাপরাধ বিচারের প্রশ্নে তার এই কঠোর অবস্থান সত্ত্বেও পূর্ণ অন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ছাড়া বাংলাদেশের পক্ষে সে কাজ সমঙ্ন্ন করা খুব সহজ হবে না-বাংলাদেশ ও ভারত উভয়েই তা জানত। তার চেয়েও বড় কথা তার অর্থনৈতিক সমস্যা কাটিয়ে ওঠার জন্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি খুবই জরুরি ছিল। পাকিস্তানের স্বীকৃতি ছাড়া যে পূর্ণ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি মিলবে না, তা বাংলাদেশ ও ভারতের জানা ছিল। সে জন্যই যুদ্ধবন্দিদের মুক্তির প্রশ্নটি তারা বাংলাদেশের স্বীকৃতির প্রশ্নটির সঙ্গে যুক্ত করে ফেলে। ইন্দিরা ও মুজিব যে তাদের অভিন্ন রণকৌশল হিসেবে এই পথ অনুসরণ করবেন, তা ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর ঢাকা সফরের পরপর সঙ্ষ্ট হয়ে পড়ে। ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে দূত পর্যায়ে বৈঠক শুরু হয় মারিতে ২৯ এপ্রিল ১৯৮২। ঠিক তার আগে ঢাকা সফরে আসেন সে বৈঠকে ভারতীয় দলের নেতা ডিপি ধর। পাকিস্তানি সৈন্যদের প্রশ্নটি বাংলাদেশ ছাড়া ভারত একা আলোচনা করতে পারে না, আর বাংলাদেশ সার্বভৌম সমতা ছাড়া সে রকম আলোচনায় অংশগ্রহণে সম্মত নয়, তার এই সফরের পর সে কথা পাকিস্তানকে জানিয়ে দেওয়া হয়। যুদ্ধাপরাধী পাকিস্তানি সৈন্যদের বিচারের ব্যাপারে বাংলাদেশ যে আপস করবে না, একই সময়ে ঢাকা থেকে তা সঙ্ষ্টভাবে জানিয়ে দেওয়া হয়। সম্ভবত পাকিস্তানের ওপর চাপ বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে শেখ মুজিব বিচারের প্রশ্নটি আলাদা গুরুত্ব দিয়ে তথ্য মাধ্যমের প্রতিনিধিদের কাছে তুলে ধরেন। কলকাতার স্টেটম্যান পত্রিকায় এক সাক্ষাত্কারে তিনি বলেন, আমার দেশের মানুষ নির্মমভাবে নিহত হয়েছে, ‘কয়েক শ নয়, কয়েক হাজার নয়, ৩০ লাখ। আমরা অন্ততপক্ষে সেসব পাকিস্তানি সেনার বিচার করতে চাই, যাদের বিরুদ্ধে আমাদের সঙ্ষ্ট প্রমাণ রয়েছে। ভুট্টোর সঙ্গে মুখোমুখি সাক্ষাতের দাবি প্রসঙ্গে মুজিব সরাসরি জানিয়ে দেন, বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেওয়া পর্যন্ত আমি তার সঙ্গে কখনোই সাক্ষাত্ করব না। তার সমস্যার ব্যাপারটা আমি বুঝি, কিন্তু তাকে খুশি আমি করতে পারব না’ (দি স্টেটম্যান, ২৬ এপ্রিল ১৯৭২, আয়ুবের গ্রন্থে উদ্ধৃত)।

পাকিস্তানি সেনা হস্তান্তর ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে বাংলাদেশ যে সত্য সত্য অনড়, সে কথা বুঝতে ভুট্টোর কষ্ট হয়নি। ১৫ এপ্রিল ১৯৭২ প্রেসিডেন্ট নিক্সনের কাছে লেখা এক ‘গোপন’ চিঠিতে তিনি এ ব্যাপারে তার উদ্বেগের কথা তুলে ধরেন। পূর্ববর্তী মাসে সোভিয়েত ইউনিয়নে তার সফরের কথা উল্লেখ করে সে চিঠিতে ভুট্টো লেখেন, ‘সোভিয়েত নেতাদের সঙ্গে কথা বলে আমি বুঝেছি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেওয়া পর্যন্ত যুদ্ধবন্দিদের ফিরিয়ে দেওয়া হবে না। আমি (সোভিয়েত নেতাদের) জানিয়েছি যে, সরাসরি ভারতীয় হস্তক্ষেপের ফলেই বাংলাদেশের সৃষ্টি হয়েছে। পাকিস্তানের মানুষ যেভাবে তাদের দেশ দ্বিখণ্ডিত করা হয়েছে তা মেনে নেয়নি। (বাংলাদেশকে) স্বীকৃতির প্রশ্নটি তাদের মনে গভীর সন্দেহের সৃষ্টি করবে। এ অবস্থায় (স্বীকৃতির) পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য আমাকে প্রস্তুতি নিতে হবে।’ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রসঙ্গে ভুট্টো লেখেন, ‘ভারতীয় মদদে শেখ মুজিবুর রহমান ১৫০০ যুদ্ধবন্দির ‘যুদ্ধাপরাধে’র জন্য বিচারের ব্যাপারে বদ্ধপরিকর বলে মনে হয়। যদি বাংলাদেশ সত্যি সত্যি তেমন পথে এগোয়, তাহলে তার মারাত্মক প্রতিক্রিয়া হবে পশ্চিম পাকিস্তানে। পশ্চিম পাকিস্তানে প্রায় লাখ বাঙালি রয়েছে। এখন পর্যন্ত তাদের সঙ্গে কোনো রকম খারাপ ব্যবহার যাতে না হয় আমরা তা নিশ্চিত করতে পেরেছি। কিন্তু এই পরিকল্পিত বিচার যদি সত্যি সত্যি শুরু হয়, তার ফলে যে তিক্ততার সৃষ্টি হবে তাতে ভারত ও ‘বাংলাদেশের’ সঙ্গে স্বাভাবিক সমর্ঙ্ক তৈরি অসম্ভব হয়ে পড়বে’ (দি আমেরিকান পেপারস, পৃ. ৮৪২-৮৪২)। একই চিঠিতে ভুট্টো প্রেসিডেন্ট নিক্সনের কাছে আবেদন রাখেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট যেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধে তার প্রভাব খাটাতে চেষ্টা করেন।

‘২৬ মার্চ রাওয়ালপিন্ডিতে এক সংবাদ সম্মেলনে ভুট্টো ঘোষণা করেন যে, তিনি পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দিদের বিচারের দাবি মেনে নেবেন না। ভারতের সঙ্গে কোনো শান্তিচুক্তির স্বার্থে বা ভারতে অন্তরীণ পাকসেনাদের দেশে ফেরার বদলে সে বিচার মেনে নিতে হলে তিনি পদত্যাগ করতে প্রস্তুত। ভারতের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার জন্য তিনি সোভিয়েত ইউনিয়ন, সুইজারল্যান্ড ও সিলোনের মাধ্যমে যোগাযোগ করেছেন বলে স্বীকার করেন। বাংলাদেশে যুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষ মারা গেছে বলে শেখ মুজিবের দাবি প্রত্যাখ্যান করে ভুট্টো বলেন যে, মোট মৃতের সংখ্যা ৫০,০০০-৬০,০০০-এর বেশি হবে না। ভুট্টো বেশ খোলামেলাভাবেই এ কথা বলেন যে, যুদ্ধবন্দিদের বিচারের চেষ্টা হলে পাকিস্তানে আটকে পড়া বাঙালিদের বিরুদ্ধে স্থানীয় লোকজনের ক্রোধ দাবিয়ে রাখা তার পক্ষে অসম্ভব হবে (নিউইয়র্ক টাইমস, ২৬ মার্চ, ১৯৭২)।

যুদ্ধাপরাধীদের ব্যাপারে অন্য আরেক সমস্যা ছিল তাদের অপরাধের আইনগত ভিত্তি নির্মাণ। যুদ্ধাপরাধের তথ্য সংগ্রহ ও তার প্রামাণিকীকরণে যে জটিলতা ও আইনগত কঠোরতা পালনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে, বাংলাদেশ সে সম্বন্ধে পর্যাপ্তভাবে প্রস্তুত ছিল না। মার্চের মাঝামাঝি বাংলাদেশ দাবি করে তারা ১,৫০০ যুদ্ধাপরাধীকে চিহ্নিত করেছে এবং তাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ সাক্ষ্য-প্রমাণসহ তারা আদালতে উপস্থিত করবে। কিন্তু কার্যত দেখা গেল অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য সাক্ষ্যপ্রমাণ সংগ্রহে যে কঠোরতা প্রয়োজন, তা প্রয়োগের মাধ্যমে সে প্রমাণাদি দাখিল করা সম্ভব হচ্ছে না। এই পর্যায়ে বাংলাদেশ সরকার অভিযুক্তদের মোট সংখ্যা ১,৫০০ থেকে ১৯৫-তে নামিয়ে আনে। এ ব্যাপারে ভারত সরকারের একটি সম্ভাব্য ভূমিকার কথা উল্লেখ করেছেন ডেনিস রাইট তার গ্রন্থে। তার প্রদত্ত তথ্য অনুসারে বাংলাদেশ চাইছিল যত দ্রুত সম্ভব যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হোক, কারণ সে বিচার যত বিলম্বিত হবে, তা একদম না হওয়ার সম্ভাবনাও তত বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু ভারত এ ব্যাপারে তাড়াহুড়ো করতে মোটেই আগ্রহী ছিল না। ভারতের কাছে যুদ্ধাপরাধী বিচারের ব্যাপারটি ন্যায়বিচারের চেয়ে আলাপ-আলোচনায় ‘বারগেইনিং পয়েন্ট’ হিসেবে অধিক গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

ভারত-পাকিস্তান চুক্তি

১৯৭২ সালের ২৮ জুন থেকে ৩ জুলাই ভারতের শৈল শহর সিমলায় অনুষ্ঠিত হয় ইন্দিরা-ভুট্টো শীর্ষ বৈঠক। সামরিক ও রাজনৈতিক নানা দ্বিপক্ষীয় সমস্যা নিয়ে সে বৈঠকে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হলেও বাংলাদেশের স্বীকৃতি বা ভারত থেকে পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দি প্রত্যাহারের ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো না। সাংবাদিক ও ভাষ্যকারেরা অবশ্য দাবি করলেন, বাংলাদেশকে স্বীকৃতির ব্যাপারে ভুট্টো খুব শিগগিরই সিদ্ধান্ত নেবেন। কেউ কেউ এমন কথাও লিখলেন যে, ১০ জুলাই ভুট্টো সিমলা চুক্তি অনুমোদনের জন্য পাকিস্তানের আইন পরিষদের যে সভা ডেকেছেন, সেখানে তিনি নিজ থেকেই স্বীকৃতির প্রশ্নটি তুলবেন। কিন্তু বাস্তবে তা হলো না।

অধ্যাপক আয়ুব ব্যাখ্যা হিসেবে দুটি কারণের উল্লেখ করেছেন। প্রথমত, সিমলা চুক্তি নিয়ে দেশের ভেতর অনেকে তার বিরুদ্ধে ‘নতজানু’ নীতি গ্রহণের অভিযোগ তোলে, বিশেষ করে কাশ্মীর প্রশ্নে তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপ ছাড়া আলোচনার যে দাবি ভারত তুলেছিল তা মেনে নেওয়ায়। ভারতের মাটিতে বসে বাংলাদেশ প্রশ্নে একটি গোপন চুক্তি তিনি করেছেন, এমন অভিযোগও উঠল। পাঞ্জাবে ‘বাংলাদেশ নামঞ্জুর’ ্পোগান তুলে মিছিলের মাত্রা এ সময় বেড়ে যায়। এ অবস্থায় নিজের রাজনৈতিক অবস্থান সংহত করতে ভুট্টোকে জোরেশোরে বলতে হলো, যুদ্ধবন্দি ফেরত না আসা পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবেন না।

কিন্তু তার চেয়েও গুরুতর কারণ ছিল স্বীকৃতির ব্যাপারে সেনাবাহিনীর ভেতরে মতান্তর। বাংলাদেশ অভিযানের সঙ্গে যুক্ত টিক্কা খানকে ভুট্টো পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে মনোনীত করেছিলেন। বাংলাদেশে সামরিক বিপর্যয়ের অপমান তার বা পাক সেনাবাহিনীর অফিসারদের পক্ষে হজম করা সম্ভব হয়নি। তদুপরি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্নে বাংলাদেশ অনড় বলেই মনে হচ্ছিল। এ অবস্থায় সেনা কমান্ড কিছুতেই স্বীকৃতির প্রশ্নে সম্মত হতে পারছিল না। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি এক ভারতীয় পত্রিকার সঙ্গে খোলামেলা সাক্ষাত্কারে ভুট্টো সে কথা স্বীকার করে বললেন, বিচারের ব্যাপারে তার প্রধান সমস্যা নিজের সেনাবাহিনী নিয়ে। তার কথায়, ‘যুদ্ধাপরাধের বিচার সেনাবাহিনীর সঙ্গে আমার সমস্যা অনতিক্রম্য করে তুলবে এবং অবস্থা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে’ (স্টেটসম্যান, ১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭২)।

স্বীকৃতির ব্যাপারে পাকিস্তানের আপত্তির আরো একটি সম্ভাব্য কারণ ছিল জাতিসংঘে সদস্যপদের জন্য বাংলাদেশের চেষ্টা। জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যপদ লাভের অর্থ দাঁড়াত আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের মর্যাদা বহুলাংশে বেড়ে যাওয়া। তাকে একঘরে করে রেখে পাকিস্তান যুদ্ধবন্দি প্রশ্নে বাংলাদেশের ওপর চাপ সৃষ্টির যে সুযোগ আছে বলে ভাবছিল, জাতিসংঘে সদস্যপদ বা তার ব্যাপক আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির ফল সেই বাড়তি সুবিধাটুকু থেকে সে বঞ্চিত হবে। পাকিস্তানকে খুশি করতে এবং সম্ভবত সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারতের সঙ্গে তার শত্রুতার কারণে চীন জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে ভেটো প্রয়োগ করে সে চেষ্টায় সাগ্রহে সমর্থন জোগাল।

স্বীকৃতি ও সেনা হস্তান্তরের প্রশ্ন ছাড়াও ভিন্ন দুটি প্রশ্নে আশু সিদ্ধান্ত জরুরি হয়ে ওঠে। তার একটি হলো পাকিস্তানে আটকে পড়া বাঙালিদের প্রশ্ন ও অন্যটি হলো বাংলাদেশে অবস্থানরত পাকিস্তানি/বিহারিদের সমস্যা। অন্ততপক্ষে ৬ লাখ বিহারি, যারা পাকিস্তানে ফিরে যাওয়ার পক্ষে মত দিয়েছিল, তাদের ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য বাংলাদেশ চাপ দেওয়া শুরু করে। ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৩ এক বিবৃতিতে শেখ মুজিব সঙ্ষ্ট জানিয়ে দেন, বাংলাদেশের মাটিতে বিহারি/পাকিস্তানিদের তিনি রাখতে পারবেন না। মুজিব মন্তব্য করেন,‘ভুট্টো যদি তাদের ফিরিয়ে না নেয়, তাহলে আন্তর্জাতিক সমঙ্রদায়ের উচিত হবে তাদের জন্য একটি দ্বীপ কিনে সেখানে পাঠিয়ে দেওয়া’ (দি পিপল, ২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৩)। পাশাপাশি পাকিস্তানে আটকে পড়া প্রায় ৪ লাখ বাঙালিকে ফিরিয়ে আনাও মুজিবের জন্য জরুরি হয়ে পড়ে। সেসব বাঙালির বিরুদ্ধে শুধু যে হামলা শুরু হয়েছিল তাই নয়, ভুট্টো সরকার তাদের এবং পাক সেনাবাহিনীর বাঙালি সদস্যদের বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ এনে এক প্রহসনমূলক বিচারের উদ্যোগও নিচ্ছিল। জানুয়ারির গোড়াতে পাকিস্তানের পত্রপত্রিকায় জানান হয় সে বিচারের জন্য প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়নের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

প্রকৃতপক্ষ বাংলাদেশে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের পরপরই (পশ্চিম) পাকিস্তানে আটকে পড়া বাঙালিদের ওপর হামলা ও হয়রানি শুরু হয়ে যায়। বাড়ি লুট, ছুরিকাঘাত ও অন্যান্য ঘটনা মার্চের গোড়ার দিকে এতটা বেড়ে যায় যে, শেখ মুজিব জাতিসংঘ মহাসচিব ওয়ালডহাইমের কাছে এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপের আবেদন জানিয়ে পত্র লিখতে বাধ্য হন।

‘আমরা পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দিদের বিচারের কোনো চেষ্টাকে মেনে নেব না। সে চেষ্টা হলে পাকিস্তানে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে এবং আমাদের সে মোতাবেক ব্যবস্থা নিতে হবে। যুদ্ধবন্দিদের বিচার হলে আমাদের এখানে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হবে, তার বিরুদ্ধে শ্রমিক, ছাত্র ও সাধারণ জনতার বিক্ষোভ হবে। সেনাবাহিনীতেও প্রতিক্রিয়া হবে। আমাদের নাকে এভাবে খত দেওয়ার চেষ্টা করলে আমরা তা মেনে নেব না। জনমত এখানেও বিচারের দাবি করবে। আরা জানি, বাঙালিরা যুদ্ধের সময় তথ্য পাচার করেছে। তাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আনা হবে’ (নিউইয়র্ক টাইমস-এ সঙ্গে এক সাক্ষাত্কারে ভুট্টো, ২৮ মে, ১৯৭৩)।

এদিকে ভারতে আটক যুদ্ধবন্দিদের প্রশ্নটি নিয়ে পাকিস্তান এক আন্তর্জাতিক ক্যামেঙ্ইন শুরু করে। বাংলাদেশের স্বীকৃতির সঙ্গে এ প্রশ্নটি যুক্ত করা আইনসম্মত নয়, এই যুক্তিটি তারা বেশ সফলতার সঙ্গে দাঁড় করাতে সক্ষম হয়। প্রশ্নটি মানবিক, এমন একটি যুক্তি দেখিয়ে তারা জাতিসংঘের মহাসচিবের হস্তক্ষেপ প্রার্থনা করে। পাকিস্তান থেকে একদল যুদ্ধবন্দির স্ত্রী ও নিকটাত্মীয় জাতিসংঘ সদর দপ্তরে এসে লবি করা শুরু করে। আমেরিকার প্রধান প্রধান পত্রিকাগুলোতে যেমন নিউইয়র্ক টাইমস, বাংলাদেশের আপত্তি সত্ত্বেও যুদ্ধবন্দিদের ফেরত পাঠানো উচিত বলে যুক্তি দেখায়। জাতিসংঘ মহাসচিব কুর্ট ওয়ালডহাইম নিজেও এ ব্যাপারে মধ্যস্থতার জন্য ফেব্রুয়ারি ১৯৭৩ সালে উপমহাদেশ ঘুরে যান।

এ অবস্থায় প্রথম ছাড়টি আসে বাংলাদেশের তরফ থেকে। মার্চ ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তার দলের বিপুল বিজয়ের পর শেখ মুজিব নিজের সরকারের ব্যাপারে তখন অনেক বেশি আস্থাবান। পাকিস্তানি স্বীকৃতির চেয়েও আটকে পড়া বাঙালিদের ফিরিয়ে আনা তার জন্য তখন অধিক গুরুত্বপূর্ণ একটি ব্যাপার। সে সময় আফগানিস্তানের ভেতর দিয়ে ভারত হয়ে বাংলাদেশ আসার চেষ্টায় অনেক আটকে পড়া বাঙালি বিপদের সম্মুখীন হচ্ছিলেন। কেউ ডাকাতের হাতে পড়ে সবকিছু খোয়াচ্ছিলেন, কেউ কেউ মারাও গেলেন। যাতে বাঙালিরা দেশত্যাগ না করতে পারে সে জন্য এ সময় পাকিস্তান প্রতিটি পলায়নরত বাঙালিকে ধরিয়ে দিতে পারলে ১ হাজার রুপি পুরস্কার ঘোষণা করে (নিউইয়র্ক টাইমস, ডিসেম্বর ১৩, ১৯৭২)। হাজার হাজার বাঙালিকে ‘গুপ্তচরবৃত্তির’ অভিযোগে গ্রেপ্তার করে অবর্ণনীয় পরিবেশে অন্তরীণ করা হয়। এসব ঘটনায় বাংলাদেশে স্বাভাবিকভাবেই তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।

‘পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট ভুট্টো বলেছেন, বাংলাদেশ যদি যুদ্ধাপরাধের জন্য বিচার শুরু করে, তাহলে পাকিস্তানও অনুরূপ ট্রাইব্যুনাল গঠন করবে। ভুট্টোর এই হুমকি উপমহাদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার যে ভঙ্গুর চেষ্টা চলছে, তা বিপদাপন্ন হয়ে পড়ল। এই প্রথম পাকিস্তান সরকার বাংলাদেশকে যুদ্ধাপরাধী বিচারের বিরুদ্ধে সরাসরি হুমকি প্রদান করল। সামঙ্রতিক সময়ে পাকিস্তান সরকার হাজার হাজার বাঙালিকে গ্রেপ্তার করেছে। এদিকে হাজার হাজার বাঙালি আফগানিস্তান হয়ে দেশে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করেছে’ (নিউইয়র্ক টাইমস, ২৯ মে, ১৯৭৩)।

১৯৭৩ সালের নির্বাচনের পরপরই ঢাকায় ইন্দিরা গান্ধীর বিশেষ দূত হিসেবে পিএন হাকসার ঢাকা আসেন। সে সফরের অব্যবহিত পরেই দিল্লিতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল হোসেনও ভারত সরকারের সঙ্গে শলাপরামর্শ সেরে আসেন। এরপর ১৭ এপ্রিল ১৯৭৩ বাংলাদেশ ও ভারত এক যৌথ বিবৃতিতে প্রথমবারের মতো জানায়, চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী ছাড়া অন্য পাকিস্তানি সেনাসদস্যদের পাকিস্তানে ফেরত পাঠাতে তারা প্রস্তুত। তবে তা হতে হবে আটকে পড়া বাঙালি ও বাংলাদেশে অবস্থানরত বিহারিদের একই সময়ে স্থানান্তরের মাধ্যমে। এতদিন পর্যন্ত বাংলাদেশ দাবি করে আসছিল, যুদ্ধবন্দি প্রশ্নে যেকোনো আলোচনার আগে তাকে সার্বভৌম সমতা অর্জন করতে হবে। কিন্তু এই ঘোষণার মাধ্যমে সে দাবি প্রত্যাহার করে নেওয়া হলো।

কোনো কোনো ভাষ্যকার মন্তব্য করেছেন, স্বীকৃতির এই দাবি ত্যাগ পাকিস্তানের জন্য বিরাট বিজয় ছিল। ভুট্টো কোনো রকম ছাড় না দিয়েই যে যুদ্ধবন্দিদের ফিরিয়ে আনার সুযোগ পেলেন, সেটি তার নিজের জন্য রাজনৈতিক সুবিধাও এনে দেয়। সম্ভবত সে কারণেও বাংলাদেশের ওপর আরো চাপ সৃষ্টি করা যাবে, এই বিবেচনায় ভুট্টো ভারত-বাংলাদেশের এই যৌথ প্রস্তাবে তার তাত্ক্ষণিক সম্মতি না দিয়ে বরং কালক্ষেপণের পথ ধরলেন। একই উদ্দেশে পাকিস্তান ১৯৭৩ সালের মে মাসে বিশ্ব আদালতে (ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস) এক আবেদন পেশ করে, যার উদ্দেশ্য ছিল ভারত থেকে যুদ্ধাপরাধের জন্য অভিযুক্ত কোনো পাকিস্তানি সেনাসদস্যকে যেন বাংলাদেশে পাঠানো না হয়। সে আবেদন পরে অবশ্য পাকিস্তান প্রত্যাহার করে নেয়।

ঘটনাপ্রবাহের এ পর্যায় পর্যন্ত বাংলাদেশ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে সমঙ্ূর্ণ অনড় ছিল। এ ব্যাপারে সে কতটা গুরুত্বারোপ করছে তা আরো ভালো বোঝা যায় ১৯৭৩ সালের ১৬ জুলাই জাতীয় পরিষদে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস (ট্রাইব্যুনাল) বিল পাসের ভেতর দিয়ে। এই বিলটির লক্ষ্য ছিল সকল আন্তর্জাতিক আইনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে গণহত্যা ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য বিচারের আইনগত ভিত্তি নির্মাণ।

ঘটনার এই পর্যায়ে যুদ্ধবন্দিদের ফেরত নেওয়ার ব্যাপারে ব্যাগ্রতা থাকলেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকানো ছিল পাকিস্তানের জন্য অধিক জরুরি। ভারত চাইলেও অনন্তকাল ধরে পাকিস্তানি বন্দিদের তার ভূখণ্ডে আটকে রাখতে পারবে না, কারণ সেটা যেমন আইনবিরুদ্ধ হবে, তেমনি বিশ্বজনমতের বিপক্ষে দাঁড়াবে। কিন্তু যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিরুদ্ধে তার কোনো আইনগত অস্ত্র ছিল না। একমাত্র কূটনৈতিক চাপ এবং পাকিস্তানে আটকে পড়া বাঙালিদের বিচারের হুমকি ছিল ভুট্টোর জন্য একমাত্র হাতিয়ার। কিন্তু তা ঠেকাতে ভারত-বাংলাদেশ উভয়েই সচেতন ছিল বলেই মনে হয়। দিল্লিতে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে দ্বিতীয় দফা আলোচনা বসে আগস্ট ১৯৭৩ সালের ১৮ থেকে ২৮ তারিখ পর্যন্ত। সে বৈঠকের আগে ঢাকায় জরুরি শলাপরামর্শের জন্য আসেন হাকসার। ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে তার দীর্ঘস্থায়ী বৈঠকের পর ঠিক হয় আলোচনার সঙ্গে সমির্কত নয়-অর্থাত্ ‘একস্ট্রেনাস’-এমন কোনো বিষয়ে ভারত সে বৈঠকে আলোচনার জন্য উত্থাপন করতে দেবে না। সঙ্ষ্টতই ‘একস্ট্রেনাস’ বলতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কথাটিই বোঝানো হয়েছিল।

২৮ আগস্ট ১৯৭৩ দিল্লিতে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় তাতে ভারতে অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনাদের দেশে ফেরত পাঠানোর বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। একই সঙ্গে বিহারি ও পাকিস্তানে আটকে পড়া বাঙালিদের ফেরত দেওয়ার প্রশ্নটিও নিয়েও সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। পাকিস্তান কোনো রকম শর্ত ছাড়াই যেসব বাঙালি বাংলাদেশে ফিরতে চায়, তাদের ফেরত দিতে সম্মত হলো। একমাত্র ব্যতিক্রম হবে সেসব বাঙালি যারা ‘গুপ্তচর’বৃত্তির জন্য অভিযুক্ত। অন্যদিকে পাকিস্তান বিহারিদের তিন ভাগে ভাগ করে পর্যায়ক্রমে ফেরত নিতে সম্মত হলো। আদতে মোট বিহারির সংখ্যা সাড়ে ৭ লাখ বলা হলেও এ পর্যায়ে ফেরত যাবে এমন বিহারি আড়াই লাখ বলে হিসাব করা হলো।

এই দিল্লি চুক্তির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হলো, যে ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীর বিচারের জন্য বাংলাদেশ আগ্রহী ছিল, তাদের ব্যাপারে কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো না। এই প্রশ্নটি পরে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের ভেতর দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতে মীমাংসিত হবে বলে মেনে নেওয়া হলো। তবে এ ব্যাপারে ঐকমত্য হলো যে, চুক্তির সকল শর্ত পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত ভারত কোনো পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দিকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠাবে না।

কেউ কেউ এই দিল্লি চুক্তিতে বাংলাদেশের ‘বিজয়’ খুঁজে পেলেও প্রকৃতপক্ষে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সকল সম্ভাবনা সেখানেই সমাধিস্থ হলো। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সিদ্ধান্ত বাংলাদেশ ও পাকিস্তান সম্মতির ভিত্তিতে নেবে, এ কথা বাংলাদেশের মেনে নেওয়ার অর্থই ছিল সে বিচার আর কখনোই হবে না তা মেনে নেওয়া। কারণ, পাকিস্তান তো আগ থেকেই জানিয়ে দিয়েছে, বিচারের কোনো রকম দাবি তারা মেনে নেবে না। বাংলাদেশকে স্বীকৃতির প্রশ্নটি বিবেচনার আগে ঢাকাকে সে দাবি শর্তহীনভাবে তুলে নিতে হবে। পাকিস্তানের সম্মতি নিয়ে যদি সে বিচার হবে বলে বাংলাদেশ রাজি হয় তাহলে তার সোজা অর্থ এই যে, সে বিচার আর হবে না, তাও বাংলাদেশ মেনে নিয়েছে। সে কথা উল্লেখ করে ডেনিস রাইট ঠিকই মন্তব্য করেছেন, প্রকৃত বিচারের বদলে যুদ্ধাপরাধীদের প্রশ্নটি উভয় দেশের জন্যই একটি ‘ডিপ্লোম্যাটিক কার্ড’-এ পরিণত হলো। বাংলাদেশ তাকে ব্যবহার করবে পাকিস্তানি স্বীকৃতি আদায়ে, আর পাকিস্তান স্বীকৃতি দেওয়ার পূর্বশর্ত হিসেবে দাবি করবে সে বিচার নাকচকরণে।

অবশেষে স্বীকৃতি

লাহোরে ইসলামিক সম্মেলনভুক্ত দেশসমূহের প্রতিনিধিরা আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন যে, তারা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের কাছ থেকে পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না করার ব্যাপারে আশ্বাস আদায় করতে পারবেন (নিউয়র্ক টাইমস, ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪)।

‘পাকিস্তানি রাষ্ট্রপতি ভুট্টো ২২ ফেব্রুয়ারি লাহোরে ইসলামিক সম্মেলন সংস্থার বৈঠক শুরুর প্রাক্কালে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন। বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের ওপর অধিকাংশ মুসলিম দেশের তীব্র চাপের ফলেই এই ঘোষণা এল’ (নিউইয়র্ক টাইমস, ২৩ ফেব্রুয়ারি)।

বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও মুক্তিযুদ্ধের সময় ও অব্যবহিত পরে কোনো মুসলিম বা আরব দেশ তার সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেনি। পাকিস্তানিদের গণহত্যারও তারা কোনো প্রতিবাদ কার্যত করেনি। জর্দান ও ইরান পাকিস্তানকে অস্ত্র দিয়ে সে গণহত্যায় বরং উল্টো মদদ জোগায়। বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের পরও তারা যেমন স্বীকৃতি দেয়নি, তেমনি জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যপদের বিরোধিতার প্রশ্নে পাকিস্তানের নেতৃত্ব তারা বিনাবাক্যে মেনে নেয়।

মুসলিম দেশগুলোর সমর্থন আদায়ের চেষ্টা নবগঠিত বাংলাদেশ সরকার যে করেনি তা নয়। আরব দেশগুলো স্বীকৃতি না জানালেও ইসরায়েল অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে বাংলাদেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সমর্ঙ্ক স্থাপনে আগ্রহ দেখায়। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশকে সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য দিতেও সে আগ্রহ প্রকাশ করে। মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে সমর্ঙ্ক অগ্রাধিকারের সঙ্গে বিবেচিত হওয়ায় বাংলাদেশ ইসরায়েলের সে প্রস্তাবে সাড়া দেয়নি। ইসলামিক সংহতি প্রশ্নে বাংলাদেশের এই সঙ্ষ্ট অবস্থান সত্ত্বেও একমাত্র যে মুসলিম/আরব দেশ বাংলাদেশের প্রতি কিছুটা সহানুভূতি প্রকাশ করে সেটি হলো মিসর। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে এক মিসরই বাংলাদেশের সরকারি কোনো প্রতিনিধি দলকে স্বাগত জানায়। আবার মিসরের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাসান আল জাইয়াত ২৩ মার্চ ১৯৭৩ প্রথম আরব/মুসলিম দেশের প্রতিনিধি হিসেবে ঢাকা সফর করে যান। সঙ্ষ্টতই পাকিস্তান যাতে অখুশি না হয় সে কথা বিবেচনায় রেখে আরব দেশগুলো বাংলাদেশের প্রশ্নটি বিবেচনা করেছিল। তবে এই দুটি মুসলিমপ্রধান দেশ তাদের বৈরিতার অবসান করুক, সে ইচ্ছা সকল আরব/মুসলিম দেশের ছিল, তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। হাসান আল-জাইয়াত ঢাকায় সে রকম মনোভাবই প্রকাশ করেন। মিসরের রাষ্ট্রপ্রধান আনোয়ার সাদাতের ব্যক্তিগত আগ্রহেই মিসর ১৯৭৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর বাংলাদেশকে স্বীকৃতি জানায়। একই দিন সিরিয়াও কূটনৈতিক স্বীকৃতির কথা ঘোষণা করে। উভয় স্বীকৃতির কথা পাকিস্তানকে আগেভাগেই জানানো হয়েছিল।

১৯৭৪ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি থেকে পাকিস্তানের লাহোরে ইসলামিক সম্মেলন সংস্থা ওআইসির শীর্ষ পর্যায়ের একটি বৈঠক আগে থেকেই নির্ধারিত ছিল। সে সম্মেলনে বাংলাদেশ অংশগ্রহণ করুক, মিসরসহ বেশকটি মুসলিম দেশ তা চাইছিল। পাকিস্তান নিজেও প্রকাশ্যে ঘোষণা করে লাহোর সম্মেলনে সে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। ২৮ জানুয়ারি খায়েরপুরে এক জনসভায় ভুট্টো মন্তব্য করেন, ‘আমাদের পূর্ব পাকিস্তানি ভাইয়েরা যদি সে সম্মেলনে না আসে তা হবে খুবই দুঃখজনক।’ কিন্তু ঢাকা থেকে তাত্ক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় জানিয়ে দেওয়া হয় বাংলাদেশ সরকার সে বৈঠকের কোনো আমন্ত্রণ পায়নি। ভুট্টো পরে অবশ্য স্বীকার করেন যে, আমন্ত্রণ পাঠানোর দায়িত্ব তার সরকারের নয়, ওআইসি সচিবালয়ের। কিন্তু স্বীকৃতি ছাড়া বাংলাদেশ লাহোরে যাবে না, সে কথা ঢাকায় সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে আগেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। পররাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল হোসেন নিজেই সে কথা সম্মেলন কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দেন।

‘বাংলাদেশ প্রশ্নটি’ মীমাংসার লক্ষ্যে লাহোরে ইসলামিক সম্মেলনকে ব্যবহারে ভুট্টো নিজে গভীরভাবে আগ্রহী ছিলেন। কেননা, তার ব্যাখ্যায় অধ্যাপক আয়ুব বলেছেন, আপ্যায়নকারী দেশ হিসেবে এবং ‘ইসলামিক সংহতি’র বৃহত্তর স্বার্থে এই সম্মেলনকে প্রেক্ষাপট করে তিনি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার ‘উদারতা’ দেখাতে আগ্রহী ছিলেন তিনটি কারণে। প্রথমত, দেশের অভ্যন্তরে তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, যারা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার বিরুদ্ধে ছিল, তাদের জব্দ করা যাবে বলে তিনি ধরে নিয়েছিলেন। দ্বিতীয়ত, তিনি অভ্যাগত মুসলিম, বিশেষ করে ধনী আরব দেশগুলোকে এ কথা বোঝাতে সক্ষম হতেন যে, ইসলামি সংহতির স্বার্থে তিনি বড় ধরনের ত্যাগ স্বীকার করে নিচ্ছেন এবং তৃতীয়ত, ভুট্টো আশা করছিলেন যে, ইসলামি সম্মেলনের এই প্রেক্ষাপট ব্যবহার করার ফলে এবং অভ্যাগত আরব পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের চাপের মুখে বাংলাদেশের কাছ থেকে তিনি যুদ্ধাপরাধী বিচার না করার ব্যাপারে সম্মতি আদায় করে নিতে পারবেন (দেখুন, আয়ুব, ইন্ডিয়া, পাকিস্তান অ্যান্ড বাংলাদেশ : রিকগনিশন অ্যান্ড আফটার, দিল্লি, ১৯৭৫, পৃ. ১২৬)। ভুট্টো তার হিসেবে যে ভুল করেননি, সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর এক ঘোষণা থেকেই সঙ্ষ্ট হয়ে যায়।

বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে কূটনৈতিক দূতালির ব্যাপারে এ সময় একটি প্রধান ভূমিকা নেয় মিসর। সাদাত তার ব্যক্তিগত দূতের মাধ্যমে ঢাকা ও ইসলামাবাদের মধ্যে একটি অপ্রত্যক্ষ সংলাপ গড়ে তুলতে সক্ষম হন। তার আগ্রহে ইসলামিক সম্মেলনে বাংলাদেশের সম্ভাব্য অংশগ্রহণের প্রশ্নটি বিবেচনার জন্য ফেব্রুয়ারির গোড়ার দিকে পাকিস্তানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী আজিজ আহমেদ কায়রো সফর করে যান। ঠিক তার পরপরই সেখানে আসেন শেখ মুজিবের বিশেষ দূত বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। প্রায় একই সময়, অর্থাত্ ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ঢাকা সফরে আসেন ওআইসি মহাসচিব তোহামি। তড়িঘড়ি করে ব্যবস্থা করা সে সফরের উদ্দেশ্য ছিল সম্মেলনে বাংলাদেশকে অংশগ্রহণে চাপ দেওয়া। সার্বভৌম সমতার ভিত্তিতে অর্থাত্ কূটনৈতিক স্বীকৃতি দিয়েই তাকে সম্মেলনে অংশগ্রহণ করতে বলা হচ্ছে, এই ছিল তোহামির মোদ্দা বক্তব্য। অন্য কথায়, মুজিব যেতে সম্মত হলে পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবে, এই বার্তাটি তিনি বহন করে এনেছিলেন।

কিন্তু শুধু স্বীকৃতির বিষয়টি জানাতে তোহামি ঢাকা আসেনি। তার অন্য উদ্দেশ্য ছিল যুদ্ধাপরাধী বিষয়ে ঢাকার কাছ থেকে আগাম প্রতিশ্রুতি আদায় করে নেওয়া। মুজিব সরকার সে সম্মতি দিয়েছিলেন কি না তার কোনো সঙ্ষ্ট প্রমাণ নেই, যদিও কোনো কোনো ভাষ্যকার তেমন সম্ভাবনার প্রতি ইঙ্গিত করেছেন।

সম্মেলন শুরুর ঠিক আগ মুহূর্তে বাংলাদেশকে সে সম্মেলনে অংশগ্রহণে অনুরোধ করতে ঢাকা এলেন সাতটি মুসলিম দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। সে প্রতিনিধি দলের নেতৃত্বে ছিলেন কুয়েতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শেখ সাবাহ আল জাবের। সারারাত ধরে আলাপ-আলোচনা চলল। প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব নিজে সে আলোচনায় বাংলাদেশের নেতৃত্ব দিলেন। ২২ তারিখ সম্মেলন শুরুর দিন সকালে তারা লাহোরে ফিরে গিয়েই পাকিস্তানি নেতৃত্বের সঙ্গে দ্রুত বৈঠকে বসলেন। সেদিন সন্ধ্যায় লাহোরে প্রাদেশিক গভর্নর ও আইন পরিষদসমূহের এক যৌথ বৈঠকে ভুট্টো বাংলাদেশকে তার সরকারের স্বীকৃতির কথা ঘোষণা করলেন। সে ঘোষণার কথা ঢাকায় পৌঁছতে না পৌঁছতেই মুজিব সরকারের পক্ষ থেকে জানান হলো তারাও পাকিস্তানকে স্বীকৃতি দিচ্ছে। একজন মুখপাত্রের বরাত দিয়ে বলা হলো, ইসলামিক সম্মেলন সংস্থার বৈঠকে শেখ মুজিব অংশগ্রহণ করবেন।

লক্ষণীয় যে, এই আলোচনার কোনো পর্যায়েই কিন্তু বাংলাদেশ যুদ্ধাপরাধী বিচারের প্রশ্নটি নিয়ে কোনো আপসের ইঙ্গিত দেয়নি। ইসলামি সম্মেলনে তার ভাষণেও মুজিব এই প্রশ্নে কোনো ইঙ্গিত দিলেন না। কিন্তু লাহোর থেকে দেশে ফেরার আগে সাংবাদিকদের তিনি জানিয়ে এলেন ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীর প্রশ্নটির সন্তোষজনক সমাধান অর্জন সম্ভব হবে বলে তার বিশ্বাস। সাংবাদিকরা তার মন্তব্যের ব্যাখ্যা চাইলে মুজিব জানালেন, যুদ্ধবন্দি ও বাঙালি/বিহারি স্থানান্তর বিষয়ে ইতিপূর্বে সমঙ্াদিত দিল্লি চুক্তির পরপরই তার সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ করে দিয়েছে। সন্দেহ নেই মুজিবের এই মন্তব্য ঢাকায় ও দিল্লিতে বিস্ময়ের সৃষ্টি করে থাকবে। তার এই বক্তব্যের আগে কখনো বাংলাদেশ সরকার বা তার কোনো প্রতিনিধি বিচার প্রক্রিয়া বন্ধের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্তের কথায় জানায়নি। মুজিব লাহোরে আরো বললেন, ‘আমাদের তিন দেশের প্রতিনিধিরা একসঙ্গে বসে সকল অমীমাংসিত সমস্যার সমাধানে সক্ষম হবে।’ বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের পারসিরক স্বীকৃতির ভেতর দিয়ে উপমহাদেশে এক নতুন যুগের সূচনা হবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

৫ এপ্রিল ১৯৭৪ দিল্লিতে তিন দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা তাদের পূর্বনির্ধারিত ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে বসলেন। সে বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বাংলাদেশ ১৯৫ জন পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দির বিচারের দাবি প্রত্যাহার করে নেয়। কারণ হিসেবে বলা হয়, যুদ্ধাপরাধীদের প্রতি ‘ক্ষমাপরবশত’ এবং পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের জনগণের কাছে বিগত ভুলভ্রান্তির জন্য ক্ষমা ও ভুলে যাওয়ার জন্য যে আবেদন করেছেন তার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। একই বৈঠকে পাকিস্তানে আটকে পড়া বাঙালি ও বাংলাদেশে অবস্থানরত বিহারিদের ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারেও ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এই ত্রিপক্ষীয় চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন বাংলাদেশের কামাল হোসেন, ভারতের শরন সিং ও পাকিস্তানের আজিজ আহম্মেদ। ঢাকা, দিল্লি ও ইসলামাবাদ থেকে একযোগে সে চুক্তির বিবরণ প্রকাশ করা হয়।

উপসংহার

দিল্লি চুক্তির সিদ্ধান্ত উপমহাদেশের তিন রাজধানীতে সরকারিভাবে প্রশংসিত হলেও প্রকৃত বিজয় যে শুধু পাকিস্তানের হয়েছে, কোনো পক্ষেরই তা নিয়ে সন্দেহ ছিল না। তিন বছর বিলম্বিত হলেও ভুট্টো প্রতিটি পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দিকে দেশে ফেরত নিতে সক্ষম হলেন। যে ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীর বিচারের দাবি বাংলাদেশ করে আসছিল, তিনি সে দাবি আগাগোড়া প্রত্যাখ্যান করে এসেছেন। বাংলাদেশ সে দাবি মেনে নিতেও বাধ্য হলো। আশ্চর্যের বিষয় হলো, ভুট্টো নিজে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কথা নীতিগতভাবে মেনে নিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, পাকিস্তান নিজে তার জাতীয় আইনের ভিত্তিতে তাদের বিচার করবে। কিন্তু দিল্লি চুক্তির ফলে প্রতিটি যুদ্ধাপরাধী দেশে ফিরে গেলেন। তাদের বিচার নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপনের আর কোনো সুযোগ থাকল না। যারা ছাড়া পেলেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন ঢাকায় পাকিস্তান বাহিনীর প্রধান জেনারেল নিয়াজি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হোক বলে যারা বিশ্বাস করতেন দিল্লি চুক্তিতে তারা বিস্মিত হয়েছিলেন সন্দেহ নেই। ২ মে, ১৯৭৪ নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় লেখা এক চিঠিতে রঞ্জন বোড়া ক্ষোভ প্রকাশ করে লেখেন, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হয়েছে, সে কথা জানার পরও বাংলাদেশ ও ভারত পাকিস্তানি চাপের মুখে যুদ্ধাপরাধী পাক সৈন্যদের বিনা শর্তে মুক্তি দিল, তাদের এই সিদ্ধান্ত কোনোক্রমেই গ্রহণযোগ্য নয়। বাংলাদেশের ভেতরেও যে অনেকে সে কথাই ভেবেছিল, তাতেও কোনো সন্দেহ নেই।

সার্বভৌম সমতার দাবি পূরণ বাংলাদেশের জন্য একটি বড় অর্জন ছিল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। মুজিব সরকার সে সময় যে প্রবল অর্থনৈতিক সংকটের মুখে ছিল, তা থেকে উদ্ধারে এটি একটি পথ বলে তারা ভেবে থাকবেন। পাকিস্তানের স্বীকৃতি অর্জিত হলে এবং ইসলামিক সম্মেলনে যোগ দিলে অধিকাংশ ইসলামি দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবে, এ রকম একটি প্রতিশ্রুতি ঢাকাকে দেওয়া হয়েছিল। আরব দেশসমূহ তাকে ব্যাপক অর্থনৈতিক সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, এ কথা ভাবারও যথেষ্ট কারণ আছে। শুধু ইসলামি দেশ নয়, চীনও বাংলাদেশ প্রশ্নে তার অবস্থান পরিবর্তন করবে, তার সঙ্ষ্ট ইঙ্গিত ঢাকা পেয়েছিল। ফলে যেভাবেই হোক পাকিস্তানের সঙ্গে এক ধরনের সমঝোতায় আসার জন্য যে ক্রমবর্ধিত চাপ, তা সহ্য করার ক্ষমতা সে মুহূর্তে বাংলাদেশের ছিল বলে মনে হয় না।

কিন্তু এ কথা ঠিক যে, যুদ্ধাপরাধী বিচারের দাবি ত্যাগ করে যে ক্ষতি বাংলাদেশকে স্বীকার করতে হলো, তা ছিল অপূরণীয়। পাকিস্তানের ও বিভিন্ন মুসলিম দেশের কাছ থেকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি বাংলাদেশ পেল বটে, কিন্তু পাকিস্তানের সঙ্গে সমের্ক যে নৈতিক শ্রেষ্ঠত্ব তার ছিল, সেই ‘মরাল হাইগ্রাউন্ড’টুকু সে হারাল। পাকিস্তানের ভেতরে বাংলাদেশ-পাকিস্তানের পারসিরক স্বীকৃতিকে ব্যাখ্যা করা হলো এই বলে যে, উপমহাদেশের দুই ইসলামি দেশের মধ্যে সমর্ঙ্ক পুনরায় স্থাপিত হওয়ায় ভারতীয় সমঙ্রসারণবাদ রোখা সম্ভব হবে। অন্য কথায়, পাকিস্তানি কূটনীতির রণকৌশল হিসেবেই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। সেটা পাকিস্তানের জন্য বিজয় বৈ আর কিছু নয়। অন্য দিকে ভুট্টো সকল যুদ্ধবন্দি দেশে ফিরিয়ে আনাতে নিজেকে দেশের ভেতরে ত্রাতা বলে জাহির করেই ক্ষান্ত হলেন না, ইসলামি বিশ্বের চোখে ‘মহান রাষ্ট্রনায়ক’ বলেও নিজেকে স্থাপন করলেন। লাহোর সম্মেলনে ইসলামি নেতাদের সামনে তিনি প্রকাশ্যেই বললেন, বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে তিনি মোটেই খুশি নন। ‘বুকভরা ব্যথা নিয়ে’ তাকে সে সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে শুধু ইসলামি বিশ্বের ঐক্যের খাতিরে। উপস্থিত মুসলিম নেতাদের অনুরোধের প্রতি সম্মান দেখিয়েই তিনি এ কাজটি করেছেন বলে জানালেন। বলাই বাহুল্য, তার সে মন্তব্য উপস্থিত মুসলিম নেতাদের কাছে বিপুলভাবে অভিনন্দিত হয়।

যোগ-বিয়োগের খেলায় বাংলাদেশ যে পুরোপুরি ঠকে গেছে, সে কথা সঙ্ষ্টভাবে ধরিয়ে দেয় লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকা এক সমঙ্াদকীয় নিবন্ধে। এই পত্রিকার ভাষায়, পারসিরক স্বীকৃতির মাধ্যমে ‘মি. ভুট্টো, তার তাবত্ বুক চাপড়ানি সত্ত্বেও, সর্বক্ষেত্রে জয়ী হয়েছেন, ঠকেননি কোথাও।’ বাংলাদেশের কথা বলতে গিয়ে পত্রিকাটি লেখে, ‘মুজিব ঠকেছেন, কারণ দেশের ভেতরে নেতা হিসেবে তার দক্ষতা সত্ত্বেও তিনি আসলে একজন নেহায়েতই ভালো ও সত্ মানুষ। ভুট্টো প্রতিটি পদক্ষেপে মুজিবের কোমল প্রকৃতিকে নিজের স্বার্থে ব্যবহারে সক্ষম হন।’

কোনো কোনো ভাষ্যকার এমন ইঙ্গিত করেছেন যে, শেখ মুজিব ও তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী পাকিস্তানি স্বীকৃতির প্রশ্নে অতটা বেচয়ন না হলেও পারতেন। ভারতীয় কূটনীতিক জে এন দিক্ষিত মন্তব্য করেছেন, যেখানে প্রায় ১০০টির মতো দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে, সেখানে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন মহলের আচার-আচরণ দেখে মনে হতে পারে যে, পাকিস্তান স্বীকৃতি না দিলে যেন দেশটির অস্তিত্ব আইনগতভাবে স্বীকৃত হবে না। দীক্ষিত ইসলামিক সম্মেলনে মুজিব তার দেশের ইসলামিক উত্স ও চেতনার ওপর গুরুত্বারোপ করে যে ভাষণ দেন, তারও সমালোচনা করেছেন। ইসলামিক দেশসমূহের আদর্শগত মূলধারার প্রতি তার দেশের আনুগত্য প্রকাশে তিনি মনে হয় বড়ই উদগ্রীব ছিলেন (দেখুন : দীক্ষিত, লিবারেশন অ্যান্ড বিয়োন্ড, ইউনিভার্সিটি প্রেস, ঢাকা, ১৯৯৯, পৃ. ১৮৪)।

ভাগ্যের পরিহাস হচ্ছে এই যে, যে সুবিধার কথা ভেবে পাকিস্তানের সঙ্গে সমঝোতার পথে পা বাড়ান মুজিব ও তার সরকার, তার কোনো সুফলই তারা পাননি। সে বছরই এক নজিরবিহীন দুর্ভিক্ষের মুখে পড়ে বাংলাদেশ। কিন্তু নামমাত্র সাহায্য ছাড়া ইসলামি দেশগুলো কেউই বাংলাদেশের সেই সংকটে পাশে এসে দাঁড়ায়নি। ১৯৭৪ সালের জুন-জুলাই মাসে ঢাকায় সরকারি সফরে আসেন জুলফিকার ভুট্টো। সে সফরকালে বাংলাদেশ ও তার জনগণের প্রতি যে প্রবল ঔদ্ধত্য প্রকাশ করেন তিনি, তা থেকেও কারো কোনো সন্দেহ থাকে না যে, ভুট্টো বা পাকিস্তানের অধিকাংশ মানুষ বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশকে সম্মানের সঙ্গে কখনোই গ্রহণ করেনি।

৩০ বছর পর আজ যখন আমরা পেছন ফিরে তাকাই, এ কথায় কোনো ভুলই থাকে না যে, সেদিন বাংলাদেশ সত্যি ঠকে গিয়েছিল। তার মাশুল আমরা আজও বহন করে চলেছি।

১৫ মার্চ, ২০০৪

নিউইয়র্ক

সূত্র: ২৬ মার্চ ২০০৪ প্রথম আলোর "স্বাধীনতা দিবস" বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত