স্বাধীনতা দিবস-২৬ মার্চ

নীল রঙে নীলনকশা

একাত্তরের মধ্য ফেব্রুয়ারিতে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ও সামরিক আইন প্রশাসক লে. জে. সাহেবজাদা ইয়াকুব খান পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে একটি পরিকল্পনা তৈরি করেন। এর নাম দেওয়া হয়েছিল অপারেশন ব্লিটৎস। কিন্তু বাঙালি দমনে সামরিক শক্তি প্রয়োগে তিনি রাজি ছিলেন না। ৫ মার্চ তিনি পদত্যাগ করেন। দুই দিন পরই তাঁর উত্তরসূরি হিসেবে যোগ দেন বেলুচিস্তানের কসাইখ্যাত জেনারেল টিক্কা খান।

১৬ মার্চ জেনারেল রাও ফরমান আলী ও জেনারেল খাদিম হোসেন রাজাকে নতুন নীলনকশা তৈরির নির্দেশ দেন। ১৮ মার্চ সকালে তাঁরা অপারেশন সার্চলাইটের বিস্তারিত পরিকল্পনা করেন।জেনারেল রাও অপারেশনের পরিধি, সাফল্যের শর্ত ইত্যাদি বিষয় আর জেনারেল খাদেম হোসেন রাজা বিভিন্ন ব্রিগেড ও ইউনিটের দায়িত্ব ও করণীয় নির্ধারণ করেন। এই অপারেশনের মৌলিক বিষয়গুলো ছিল:সব গুরুত্বপূর্ণ শহরে একত্রে আক্রমণ পরিচালনা করা হবে। আক্রমণ রাতে পরিচালনা করা হবে। যেহেতু পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থিত সৈনিকদের প্রায় ৬০ শতাংশ বাঙালি, তাই অপারেশনের বিষয়টি যত দূর সম্ভব শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত গোপন রাখা হবে। পাকিস্তানের সঙ্গে বহির্বিশ্বের সব ধরনের গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগ (আকাশ, নৌপথসহ) বিচ্ছিন্ন করা হবে।

বেতারব্যবস্থার নিয়ন্তণ গ্রহণ করা হবে এবং সব অনুষ্ঠান মার্শাল ল কর্তৃপক্ষ পরিচালনা করবে। গুরুত্বপূর্ণ আওয়ামী লীগ নেতাদের গ্রেপ্তার করা হবে।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসগুলো দুষ্কৃতকারী ও অস্ত্রের জন্য তল্লাশি করা হবে।পূর্ব পাকিস্তানে সব বেসামরিক প্রশাসন অচল ও অস্তিত্বশূন্য হয়ে পড়ায় সামরিক অপারেশন বেসামরিক প্রশাসনের সাহায্যার্থে পরিচালিত হবে না, বরং গৃহযুদ্ধ বিবেচনায় সরাসরি সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে এই অপারেশন পরিচালনা করা হবে।বিভিন্ন সেনানিবাসে অবস্থিত বাঙালি সৈনিকদের নিরস্ত্র করা হবে।এই পরিকল্পনা লেখার জন্য দুই জেনারেল হালকা নীল রঙের অফিশিয়াল প্যাড ব্যবহার করেন আর লেখার কাজটি কাঠপেনসিল দিয়ে সারেন। পাঁচ পৃষ্ঠাব্যাপী এই পরিকল্পনায় মোট ১৬টি অনুচ্ছেদ ছিল।

পরিকল্পনার ক্রোড়পত্রে ১৬ ব্যক্তির নাম উল্লেখ ছিল, যাঁদের গ্রেপ্তার করতে হবে।১৯ মার্চ জেনারেল টিক্কা খান এই নীলনকশা অনুমোদন করেন। ২৪ মার্চ ইয়াহিয়া নিশ্চিত হন যে শেখ মুজিব বাঙালির ন্যায্য অধিকারের প্রশ্নে কোনো ছাড় দিতে রাজি নন। তাই তিনি অপারেশন সার্চলাইট কার্যকর করার চূড়ান্ত অনুমোদন দেন। ২৫ মার্চ সন্ধ্যা ছয়টায় সব ফরমেশন জানানো হয়, অপারেশন ওই রাত একটার পর কোনো একসময় শুরু হবে। রাত আটটায় ইয়াহিয়া নিঃশব্দে ঢাকা ত্যাগ করেন। ভুট্টো তখনো হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে। রাত ১১টায় সেনাবাহিনী শহরে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। গুলির শব্দে মাঝরাতে ঘুম ভাঙে ঢাকাবাসীর। ঘুমের মধ্যেই শহীদ হয়ে যায় হাজারো নিরপরাধ মানুষ। শুরু হয় পাকিস্তান দ্বিখণ্ডিত হওয়ার শেষ দৃশ্য বা বাংলাদেশ জন্মগ্রহণের প্রসববেদনা।

অব. লে. কর্নেল মুহাম্মদ লুৎফুল হকের নিবন্ধ থেকে