স্বাধীনতা দিবস-২৬ মার্চ
নীতিনির্ধারকদের নানা মত
বিপুলসংখ্যক শরণার্থীর স্রোত সামলানোর জন্য ইন্দিরা গান্ধী একটি স্বতন্ত্র বিভাগ খোলার নির্দেশ দেন। এর দায়িত্ব দেন ভারত সরকারের তৎকালীন পুনর্বাসনসচিবকে।
১৯৭১ সালের মে মাসের মধ্যভাগে পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে আসা শরণার্থীর সংখ্যা মারাত্মক পর্যায়ে চলে যায়। মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহে শরণার্থীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৫৫ থেকে ৭০ লাখের মধ্যে। পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরার জনসংখ্যার ওপর চাপ পড়ে। চাপ পড়ে এসব রাজ্যের সম্পদের ওপরও। ভারত পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক লক্ষ্যের প্রতি সাধারণ সমর্থন জানালেও স্বাধীনতাসংগ্রামের সমর্থনে বৃহৎ পরিসরে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক পদক্ষেপ নেওয়ার ব্যাপারে সতর্ক ছিল। ভারত মুজিবনগর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রতিষ্ঠায় নানাভাবে সহযোগিতা করলেও এবং প্রতিরোধ আন্দোলনকে সাধারণভাবে সমর্থন জানালেও এই সরকারকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়নি।
বিপুলসংখ্যক শরণার্থীর স্রোত সামলানোর জন্য ইন্দিরা গান্ধী একটি স্বতন্ত্র বিভাগ খোলার নির্দেশ দেন। এর দায়িত্ব দেন ভারত সরকারের তৎকালীন পুনর্বাসনসচিবকে।
ভারত পূর্ব পাকিস্তানের বিষয়টিকে প্রথমত শরণার্থী সমস্যা হিসেবে জাতিসংঘে উত্থাপন করে। নিউইয়র্কে জাতিসংঘের দপ্তর ও জেনেভায় নিযুক্ত ভারতীয় দূতকে নির্দেশ দেওয়া হয়, যাতে তাঁরা ইকোসোক (ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল কাউন্সিল) ও ইউএনএইচসিআরসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোতে পূর্ব পাকিস্তানের সহিংস পরিস্থিতি ও তার নেতিবাচক পরিণতি হিসেবে ভারতের সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলোকে যে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও জনসংখ্যাগত চাপ সহ্য করতে হচ্ছে, সে-বিষয়ক তথ্য-উপাত্ত পেশ করেন। একই সঙ্গে বিভিন্ন দেশে অবস্থিত ভারতের দূতাবাসগুলোকে সংশ্লিষ্ট দেশের সমর্থন লাভের নির্দেশ দেওয়া হয়। প্রাথমিকভাবে পরিস্থিতিটা ছিল এ রকমই। কিন্তু কীভাবে এ সংকট মোকাবিলা করা হবে, তা নিয়ে ভারত সরকারের উচ্চপর্যায়ে নানা মতবিরোধ ছিল। ফলে ইন্দিরা গান্ধী এ সমস্যা মোকাবিলায় তাঁর উপদেষ্টাদের মূল দলের মধ্য থেকে কয়েকজনকে দায়িত্ব দেন। এঁদের মধ্যে ছিলেন ভারত সরকারের পলিসি প্ল্যানিং কমিটির চেয়ারম্যান ডি পি ধর, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব পি এন হাকসার, পররাষ্ট্রসচিব টি এন কল, রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইংয়ের পরিচালক আর এন কাও এবং প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের সচিব পি এন ধর। মন্ত্রীদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন শরণ সিং, ওয়াই বি চ্যাভন ও জগজীবন রাম।
পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যা কীভাবে মোকাবিলা করা হবে, তা নিয়ে ভারত সরকারের ভেতরে যে চিন্তাভাবনা চলছিল, সে বিষয়ে আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নেই। আমি মূলত ডি পি ধর ও টি এন কলের কাছ থেকে যে নির্দেশনা পেতাম, তাই স্মৃতি থেকে লিখছি। আমি তখন ছিলাম জাতিসংঘের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়-বিষয়ক বিভাগের উপসচিব, আমার কাজ ছিল জাতিসংঘের বিশেষায়িত সংস্থাগুলোর কাজ তদারক করা। এই সূত্রেই পূর্ব পাকিস্তানের সংকটের সঙ্গে আমি জড়িয়ে পড়ি। ভারত পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থী সমস্যাটির প্রচারণা দিয়ে জাতিসংঘের বিভিন্ন স্তরে উত্তেজনা সৃষ্টির সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, ফলে মধ্যম পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে আমাকে এর সমন্বয়কারী কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। ১৯৭১ সালের জুনের শেষের দিকে আমি জাতিসংঘ বিভাগ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি। এ সময় পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যা মোকাবিলায় একটি বিশেষ ইউনিট বা ব্যুরো গঠন করা হয়। আমি মূলত পজিশন পেপার ও বেসিক পলিসি নোটস নিয়ে কাজ করছিলাম আর সংকটের হালনাগাদ অবস্থা লিপিবদ্ধ করছিলাম। ডি পি ধর ও টি এন কল যেসব বৈঠকে অংশ নিচ্ছিলেন, আমাকে নির্দেশনা দিচ্ছিলেন তার ভিত্তিতে। ফলে পূর্ব পাকিস্তানের বিকাশমান পরিস্থিতি-সংক্রান্ত ভারতীয় নীতির ব্যাপারে যে মতভেদ রয়েছে, তার কিছু দিক সম্পর্কে আমি জানতে পারি।
ইন্দিরা গান্ধী স্বাভাবিকভাবেই মনে করতেন, স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়া উচিত এবং তাদের স্বাধীনতাসংগ্রামে পূর্ণাঙ্গ সামরিক সহায়তাও দেওয়া প্রয়োজন। তাঁর প্রাথমিক চিন্তাও ছিল এটি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিংও মনে করতেন, ভারতকে শেষমেশ হয়তো তা-ই করতে হবে; কিন্তু তার আগে ভারতের কাজের বিশ্বাসযোগ্যতা ও রাজনৈতিক যথার্থতা নিশ্চিত করতে হবে, যাতে এ নিয়ে কেউ প্রশ্ন করতে না পারে। শরণ সিং ভেবেছিলেন, ভারতকে যেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো পরাশক্তিসহ জাতিসংঘের চাপ সহ্য করতে না হয়। অর্থাৎ ভারত পাকিস্তান ভেঙে ফেলা ও তার ভৌগোলিক সীমানা ধ্বংস করার লক্ষ্যে সেখানকার অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে নাক গলাচ্ছে
—সম্ভাব্য এমন অভিযোগের ভিত্তিতে যেন কেউ তার ওপর চাপ দিতে না পারে। যত দূর মনে পড়ে, পি এন হাকসার এই মত পোষণ করতেন। অন্যদিকে ডি পি ধর তাৎক্ষণিকভাবে পাকিস্তানে হামলার পক্ষপাতী ছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম ও সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল (পরবর্তীকালে ফিল্ড মার্শাল) মানেক শর পরামর্শ নিয়েছিলেন। শোনা যায়, তখন তাঁরা বলেছিলেন, ভারত সামরিক অভিযানে যেতে পারে, কিন্তু গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালে তাড়াহুড়া করে সামরিক আক্রমণ শুরু করলে কিছু সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। এতে অভিযানের সফলতা পেতে দেরি হবে। জেনারেল মানেক শ বলেন, যুদ্ধের প্রস্তুতির জন্য তাঁকে পর্যাপ্ত সময় দিতে হবে। কারণ, তিনি ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন, পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানের দুটি ফ্রন্টেই তাঁদের যুদ্ধ করতে হবে। ইন্দিরা গান্ধীর উপদেষ্টারাও এ মত দেন যে ভারতের উদ্যোগের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সমর্থন না পাওয়া পর্যন্ত চীনের ব্যাপারটা বিবেচনা করতে হবে। এমন সম্ভাবনা আছে যে চীন পাকিস্তানকে সামরিক ও রাজনৈতিক সমর্থন দিতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সহায়তার বাইরেই পাকিস্তান চীনের সহায়তা পেতে পারে। ফলে ভারত এক বিবর্তনমূলক অবস্থান নেয়, অর্থাৎ অন্তর্বর্তীকালীন পদক্ষেপ নেওয়ার পরও যদি পূর্ব পাকিস্তানের সংকট মোকাবিলা করা না যায়, তাহলে সামরিক হস্তক্ষেপ করারও সুযোগ থাকবে। ভারতের নীতিগত অবস্থানের মূল বিষয়গুলো ছিল এ রকম:
১. পাকিস্তান যদি সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল এবং জনগণের, বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের আইনসম্মত রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়নের নিশ্চয়তা দেয়, তাহলেই শুধু পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যার সমাধান হতে পারে।
২. এই লক্ষ্য অর্জনে পাকিস্তানের সামরিক সরকারের উচিত হবে, অবিলম্বে শেখ মুজিবুর রহমানকে ছেড়ে দেওয়া, যাতে তিনি ঢাকা ফিরতে পারেন এবং তাদের সঙ্গে রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনা শুরু করতে পারেন।
৩. পাকিস্তানের উচিত হচ্ছে, সব শরণার্থীর ঘরে ফেরা নিশ্চিত করা। একই সঙ্গে, তাদের নিরাপত্তা, সম্মান ও অর্থনৈতিক কল্যাণ নিশ্চিত করা।
৪. অবিলম্বে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ওপর নির্যাতন বন্ধ করা। পাকিস্তানি সেনাদের ব্যারাকে ফিরিয়ে নেওয়া।
৫. আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত হবে, পাকিস্তানকে চাপ দিয়ে ও প্রভাবিত করে শান্তিপূর্ণ উপায়ে পূর্ব পাকিস্তান সংকটের সমাধান করা। এই চাপ নিশ্চিত করতে হবে জাতিসংঘ ও দ্বিপক্ষীয় কূটনৈতিক সম্পর্কের মধ্য দিয়ে।
৬. পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক আক্রমণের কারণে যেসব মানুষ ঘরছাড়া হয়ে ভারতে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়েছে, তাদের পুনর্বাসনে জাতিসংঘ ও তার সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে। তারপর পাকিস্তান সরকারকে চাপ দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে গণতন্ত্রের পুনর্জাগরণ ঘটাতে হবে।
ভারতের এই নীতির পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তান সেই পরিচিত দোষারোপের রাজনীতি শুরু করে। তারা অভিযোগ করে, ভারত পাকিস্তানে নাক গলিয়ে দেশটি ভাঙার ষড়যন্ত্র করছে। শেখ মুজিবকে নিঃশর্তভাবে ছেড়ে দেওয়া বা তাঁর সঙ্গে পুনরায় আলোচনা শুরু করার ব্যাপারে পাকিস্তান কোনো আভাস দেয়নি। পাকিস্তান এ কথাও প্রচার করতে শুরু করে, ভারতে যে শরণার্থীরা আশ্রয় নিয়েছে তারা আসলে বিদ্রোহী ও ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী দুষ্কৃতকারী’, ধর্মীয় পরিচয়ের দিকে থেকে যাদের সিংহভাগই হিন্দু। তারা অভিযোগ করে, ভারত বাংলাদেশের নির্বাসিত সরকার ও তাদের বিরোধী শক্তিকে সমর্থন দিচ্ছে।
এদিকে জুলাই মাসের মধ্যে ভারতে আগত বাংলাদেশি শরণার্থীর সংখ্যা ৮০ লাখ হয়ে যায়। পাকিস্তান যে তার যুদ্ধংদেহী অবস্থান থেকে সরে আসবে, তেমন লক্ষণও দেখা যাচ্ছিল না। ফলে ভারত সরকারের মনে ক্রমেই এ প্রত্যয় সৃষ্টি হতে থাকে যে বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে সামরিকভাবে জড়িয়ে পড়া ছাড়া তাদের আর কোনো উপায় নেই।
লিবারেশন অ্যান্ড বিয়ন্ড বই থেকে অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন
জে এন দীক্ষিত: ১৯৭১ সালে ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপসচিব; পরবর্তীকালে পররাষ্ট্রসচিব।
সূত্র: ২৬ মার্চ ২০১৬ প্রথম আলোর "স্বাধীনতা দিবস" বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত
Also Read
-
ট্রাম্প ৯৯, কমলা ২৭
-
অভিনেত্রী শমী কায়সার গ্রেপ্তার
-
মার্চ-এপ্রিলে নির্বাচনের দাবিতে কর্মসূচি শুরুর চিন্তা বিএনপির
-
চট্টগ্রামে ফেসবুক পোস্টকে ঘিরে সংঘর্ষ, ফাঁকা গুলি, সাত পুলিশ সদস্য আহত
-
সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা এখনো আক্রমণের মুখে: সম্পাদক পরিষদ