স্বাধীনতা দিবস-২৬ মার্চ

গণিতজ্ঞ

গণনা শিখিতেছি। আমি তোমাকে গণনা করি, আমি আমাকেও গণনা করি

খেলাচ্ছলে আমি মার্বেল গুনি, আকাশে ফেরেশতারা মার্বেল খেলিতেছেন

একটি হীরার টুকরা মার্বেল আমার সামনে ভূতলে পড়িয়া ভাঙিল

ভাঙিয়া টুকরা টুকরা হইল নশ্বর ব্রহ্মাণ্ডে ধাতব কার্বনও শেষাবধি ভঙ্গুর।

আমি আমার আঙুলগুলি পরীক্ষা করি, উহারা পাঁচ ভাগে বিভক্ত

আঙুল আছে বলিয়া পাঁচ হইল, নাকি পাঁচ আছে বলিয়া পাঁচ গুনিলাম?

আমি আকাশ, বাতাস, আগুন, মাটি ও পানিকে গণনা করিলাম

সকলেই গণিত হইল, আশ্চর্য, সকল বস্তুতত্ত্বেই পাক পাঞ্জাতনের খবর আছে।

অথচ কেহই পাঁচ গণিতে সক্ষম নহে, আমরা পাঁচের মধ্যে একের নামতা ভুলিয়াছি

আমরা কেবলি সংখ্যা শিখি এবং সংখ্যা মাত্রই বহু, বিভিন্ন, বিচিত্র এবং অনন্ত।

তথাপি সত্য যে একেশ্বর এক বলিয়াই আহাদ নন, বহু বলিয়াই তিনি এক হইলেন-

যিনি সেই এককে গণিতে জানেন, তিনি তৌহিদের মুর্শিদ, আমি তাঁহারই দাসী।

আমি বিশ্বব্রক্ষাণ্ডকে এক গণনা করিতে চাই কিন্তু তাহা বহু গ্রহ-নক্ষত্রে ভঙ্গুর

অতঃপর জগত্সংসার এক ভাবিলাম, কিন্তু তাহারা বহুজাতি হইয়া জাতিসংঘ হইল।

আমি মানুষকে অদ্বিতীয় ভাবিলাম, কিন্তু মানুষ বহুপরিচয়ে বিভক্ত ও সহিংস

কীভাবে তাহলে আমি গণনা শিক্ষা করিব? আমাকে কি তুমি নামতা পড়াইবে না?

অতঃপর আয়নায় নিজেকে দেখিয়া ভাবিলাম আমিই তাহা হইলে এক ও অদ্বিতীয়

কিন্তু তুমি আয়নার পেছনে দাঁড়াইয়া রহিলে কেন? এতে লুকাছাপা কিসের?

আয়নার পেছনে যাই, শুধু পারদ, আয়নার সামনে নিজেকে আবার খুঁজি

তুমি আয়নার ভেতরে পলাইয়া যাও, অথচ আমাকে প্রবেশের অধিকার দাও না।

হায়, আজ অবধি আমি আমার মুখ দেখিলাম না, আয়নায় কার ছায়া কে জানে?

তুমি কেন আমাকে নিজের মুখ নিজে সরাসরি দেখিবার জন্য পয়দা করিলে না?

আমি আমার অপর হইয়া থাকি, তুমিও অপর হইয়া আমার আমি হইতে চাহিতেছ

অথচ যতবারই গণনা করি আমি আর তুমি কেবলি দ্বিখণ্ডিত হইয়া বহিয়া যাইতেছি।

তাহলে কি এক ও অদ্বিতীয় কথাটির কোনোই অর্থ নাই, চিরবিরহই কি আমার নিয়তি?

তাহলে জায়নামাজে আমি নিরানব্বই বার খামাখাই কেন তোমাকে গণনা করিয়া আসিতেছি?

তবুও দেখো বিরহ শোকে আমার চোখের জল হইয়া একটি তসবিহদানা খসিয়া পড়িল

প্লাস্টিকের তৈরি দানা ফ্লুরিসেন্ট রঙে উজ্জ্বল, মসৃণ ও গোল-নকল অশ্রুও গড়াইয়া যায়।

মানুষ প্লাস্টিকে ফ্লুরিসেন্ট আলো মিশাইয়া দিয়াছে, মানুষ ইটের মসজিদকে ধর্মস্থান গণ্য করে

মানুষের কেরামতিতে তসবিহদানাও দেখো অন্ধকারে কেমন হলুদ হইয়া জ্বলিতেছে।

অথচ আমি গণনা শিখিতে চাই, কেরামতিতে আমার বিশেষ কাজ নাই, আমাকে ধর্ম দাও।

যদি এই জীবনে তোমাকে না পাই তবে এই জীবশরীরে প্রাণ খুলিয়া যেন আমি কাঁদিতে পারি।

গণনা শিখিতেছি। আমি তোমাকে গণনা করি, আমি আমাকেও গণনা করি

একদা আয়নার পেছনে পারদ খসিবেই খসিবে, তোমাকে আমি দেখিব, তুমিও আমাকে।

আপন-পর ভেদ দূর হইলে কাচের ঘর ভাঙিয়া যায়, প্রেমের ঘর আলোকিত হইয়া ওঠে।

ঘর আর বাহিরের পর্দা খসিয়া গেলে মানুষের ঘরই মসজিদ

কিংবা মসজিদই মানুষের ঘর হইয়া ওঠে-

সেই দিন আসিতেছে। আমি অতীত গণিয়াছি, বর্তমান গণিতেছি, ভবিষ্যত্ও গণিতে পারি-

শোন, গণিতের যুগ আসিতেছে, সেই যুগে আমিই এক ও অদ্বিতীয় গণিতজ্ঞ পরিগণিত হইব।

৬ চৈত্র ১৪১০, শ্যামলী

সূত্র: ২৬ মার্চ ২০০৪ প্রথম আলোর "স্বাধীনতা দিবস" বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত