স্বাধীনতা দিবস-২৬ মার্চ

একাত্তরের গণহত্যা ও জহির রায়হান

তিরিশ লাখ শহীদের রক্ত, পাঁচ লক্ষাধিক নারীর চরম ত্যাগ এবং কয়েক কোটি মানুষের অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশার বিনিময়ে বিশ্বের মানচিত্রে উদ্ভব ঘটেছে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের। স্বাধীনতার জন্য এত মূল্য বিশ্বের কোনো জাতি বা রাষ্ট্রকে দিতে হয়নি।

তিরিশ লাখ শহীদের রক্ত, পাঁচ লক্ষাধিক নারীর চরম ত্যাগ এবং কয়েক কোটি মানুষের অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশার বিনিময়ে বিশ্বের মানচিত্রে উদ্ভব ঘটেছে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের। স্বাধীনতার জন্য এত মূল্য বিশ্বের কোনো জাতি বা রাষ্ট্রকে দিতে হয়নি।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় দোসর, প্রধানত জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশে যে পরিকল্পিত ও বিস্তৃত গণহত্যা করেছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর অন্য কোথাও তা ঘটেনি। এই গণহত্যার লক্ষ্য ছিল: ১. আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি ও মুক্তিযুদ্ধরত রাজনৈতিক দল ও গণসংগঠনের নেতা-কর্মীরা; ২. সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায়, বিশেষভাবে হিন্দুধর্মাবলম্বীরা; ৩. ছাত্রও ও যুব সমাজ; ৪. প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবী নেতৃবৃন্দ; এবং ৫. অন্তিমে গোটা বাঙালি জাতি।

পাকিস্তানি সামরিক জান্তা এবং জামায়াতের শীর্ষ নেতৃত্বের এটি জানা ছিল যে, ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনের পর থেকে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত রাজনৈতিক নেতৃত্বের পাশাপাশি এ দেশের শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক সামগ্রিকভাবে বুদ্ধিজীবী ও বিভিন্ন পেশার নেতৃবৃন্দ বাংলাদেশের স্বাধীনতার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ভিত নির্মাণ করেছেন। এ কারণেই ১৯৭১-এ একদিকে নির্বিচারে গণহত্যার পাশাপাশি তালিকা প্রস্তুত করে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধকালে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকার সর্বশেষ নাম হচ্ছে এ দেশের প্রধানতম চিত্রনির্মাতা ও বরেণ্য কথাশিল্পী জহির রায়হান। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাংলাদেশ-ভারত যৌথ কমান্ডের নিকট আত্মসমর্পণ করলেও রাজধানী ঢাকার মিরপুর ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি পর্যন্ত হানাদারকবলিত ছিল। মুক্তিযুদ্ধের শেষ রণাঙ্গন মিরপুর হানাদারমুক্ত করার অভিযানে শতাধিক মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে জহির রায়হানও শহীদ হয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর দেশে ফিরেই ১৯৭১-এর বুদ্ধিজীবী হত্যা তদন্তের জন্য জহির রায়হান একটি নাগরিক কমিটি গঠন করে সংবাদ সম্মেলন করে বলেছিলেন, বুদ্ধিজীবীদের হত্যার জন্য প্রধানত দায়ী জামায়াতে ইসলামীর ঘাতক আলবদর বাহিনী।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করলেও পাকিস্তানি জামায়াতের দলীয় প্রকাশনা আলবদর গ্রন্থে বলা হয়েছে, ‘আলবদর’ বাহিনীর কোনো সদস্য আত্মসমর্পণ করেনি, তারা আত্মগোপন করেছিল; আন্ডারগ্রাউন্ডে থেকে যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনা করেছে, যত দিন পর্যন্ত বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল।

জহির রায়হানের বুদ্ধিজীবী হত্যা তদন্ত কমিটি শুধু তথ্য-বিবরণই সংগ্রহ করেনি, বুদ্ধিজীবী হত্যার জন্য দায়ী আলবদরের কয়েকজন নেতাকে খুঁজে বের করে পুলিশের হাতে সোপর্দ করেছিল, যাদের অন্যতম জামায়াতের ঢাকা শহরের তৎকালীন এবং জহির রায়হানের অগ্রজ বরেণ্য লেখক সাংবাদিক শহীদুল্লা কায়সারের হত্যাকারী খালেক মজুমদার।

ছাত্রজীবনে জহির রায়হান অগ্রজ শহীদুল্লা কায়সারের প্রভাবে কমিউনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে ১৪৪ ধারা ভেঙে ছাত্রদের প্রথম যে দলটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ থেকে বেরিয়ে রাস্তায় নেমেছিল, সেই দলে ছিলেন তিনি এবং গ্রেপ্তারও হয়েছিলেন। জহির রায়হানের রাজনৈতিক বিশ্বাস এবং সমাজ ও মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা তাঁর বিভিন্ন লেখা ও ছবিতে বিধৃত হয়েছে। ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানের পটভূমিতে নির্মিত তাঁর কালজয়ী ছবি জীবন থেকে নেয়া বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ভিত নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। রবীন্দ্রনাথের অমর সৃষ্টি ‘আমার সোনার বাংলা’ বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে ঘোষিত হওয়ার এক বছর আগে জহির রায়হান এই গানটি ব্যবহার করেছেন জীবন থেকে নেয়া ছবিতে, যার চিত্রায়ণও ছিল অনবদ্য। সত্যজিৎ রায় ও ঋত্বিক ঘটকের মতো আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চিত্রনির্মাতারা জহির রায়হানের জীবন থেকে নেয়ার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন।

জহির রায়হানকে হত্যা করা হয়েছিল ঘাতকদের মুখোশ উন্মোচন ও বিচারের দাবির জন্য। স্বাধীন বাংলাদেশে নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে তিনিই প্রথম একাত্তরের গণহত্যাকারী ও বুদ্ধিজীবী হত্যাকারীদের বিচার দাবি করেছিলেন। ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশে তাঁর হত্যাজনিত ক্ষোভ মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের পরিবারের সদস্যদের একত্র করেছিল। ফেব্রুয়ারিতে তাঁরা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সমবেত হয়ে গণহত্যাকারীদের বিচারের ছবিতে সমাবেশ ও মিছিল করেছিলেন। এই সমাবেশে শহীদজননী জাহানারা ইমামও ছিলেন, যাঁর নেতৃত্বে ২০ বছর পরে সূচিত হয়েছিল একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে অভূতপূর্ব নাগরিক আন্দোলন। এর পরিণতি ঘটেছে মুক্তিযুদ্ধের ৪০ বছর পর আনুষ্ঠানিকভাবে গণহত্যাকারী ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মাধ্যমে।

জহির রায়হানের প্রথম প্রকাশিত লেখা ছিল ‘ওদের জানিয়ে দাও’ শিরোনামের একটি কবিতা। কলকাতার সম্ভ্রান্ত সাময়িকী নতুন সাহিত্য-এ যখন এই কবিতা প্রকাশিত হয়, তখনো জহির রায়হান স্কুলের গণ্ডি অতিক্রম করেননি। এই কবিতার বিষয় ছিল গণহত্যার প্রতিবাদ। জহির রায়হানের শেষ সাহিত্যকর্ম ‘আর কতদিন’ এবং অসমাপ্ত চলচ্চিত্র লেট দেয়ার বি লাইট-এর বিষয়বস্তুও ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে আরম্ভ করে প্যালেস্টাইন, কঙ্গো ও ভিয়েতনাম পর্যন্ত বিস্তৃত গণহত্যা। ধর্ম, বর্ণ ও জাতিসত্তার নামে চলমান এই গণহত্যার প্রতিবাদে বাংলাদেশের গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধ আরম্ভের ছয় মাস আগে জহির রায়হান লেট দেয়ার বি লাইট-এর চিত্রগ্রহণ আরম্ভ করেছিলেন। এটি ছিল তাঁর স্বপ্নের ছবি। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তান সামরিক জান্তার ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে ভয়ংকর গণহত্যার সূচনা জহির রায়হান প্রত্যক্ষ করেছেন ঘটনাস্থলের কেন্দ্রে অবস্থান করে। জহির রায়হানের পৈতৃক বাড়ি কায়েতটুলী থেকে জগন্নাথ হলের বধ্যভূমিতে পায়ে হেঁটে যেতে ১০ মিনিটও লাগে না। এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহেই তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার জন্য ঢাকা ছেড়েছিলেন।

ভারতে যাওয়ার আগের সপ্তাহে জহির রায়হান ছিলেন আমাদের মহাখালীর বাড়িতে। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট শেষ না করলেও আমি তাঁর দুটি ছবিতে সহকারী হিসেবে কাজ করেছি। মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার আগে তিনি তাঁর স্বপ্নের কথা বলেছিলেন। কীভাবে সংস্কৃতি ফ্রন্টে যুদ্ধ চালাতে হবে, তার রূপরেখাও দাঁড় করিয়েছিলেন। প্রথমে একা গিয়েছেন তিনি। আমাকে বলেছিলেন, তাঁর চিঠি পাওয়া মাত্র আমি যেন যাই। স্ত্রী ও সন্তানদের নেওয়ার কথা ভেবেছেন আরও অনেক পরে।

কলকাতায় গিয়ে জহির রায়হান প্রথমে খুঁজে বের করেছেন বাংলাদেশের শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীদের—যাঁরা মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছেন। একই সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন কলকাতার সমমনা শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে। সবার সম্মিলিত উদ্যোগে গঠিত হয় ‘বাংলাদেশ লিবারেশন কাউন্সিল অব ইন্টেলিজেনশিয়া’। এর সভাপতি ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক এ আর মল্লিক এবং সাধারণ সম্পাদক ছিলেন জহির রায়হান। মুক্তিযুদ্ধকালে তাঁর বয়স ছিল মাত্র ৩৫ বছর।

একাত্তরের গণহত্যার বিভিন্ন দিক এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের যৌক্তিকতা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে তুলে ধরার জন্য জহির রায়হান চারটি প্রামাণ্যচিত্র প্রযোজনা করেছিলেন। এর ভেতর স্টপ জেনোসাইডআ স্টেট ইজ বর্ন-এর পরিচালকও ছিলেন তিনি। অপর দুটি লিবারেশন ফাইটার্স ইনোসেন্ট মিলিয়নস পরিচালনা করেছেন তাঁর সুহৃদ ও সহকারী আলমগীর কবির ও বাবুল চৌধুরী।

স্টপ জেনোসাইড-এ জহির রায়হান অত্যন্ত সীমিত বাজেট ও রসদে যেভাবে বাংলাদেশের গণহত্যার ভয়াবহতা তুলে ধরার পাশাপাশি এটিকে অন্যান্য দেশের গণহত্যার সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন, যে নান্দনিকতা এ ছবির প্রতিটি ফ্রেমে ও সম্পাদনায় মূর্ত হয়েছে, বহু চিত্র সমালোচক বলেছেন, এই একটি ছবিই জহির রায়হানকে এ দেশের চলচ্চিত্রশিল্পের ইতিহাসে অমর করে রাখবে।

স্টপ জেনোসাইড-এর সেন্সর ছাড়পত্র পেতে বিঘ্ন ঘটেছিল। মুজিবনগর সরকারের কিছু কর্মকর্তা এ ছবিতে লেনিনের উদ্ধৃতির ব্যবহার নিয়ে আপত্তি করেছিলেন। বিষয়টি ভারতের তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় পর্যন্ত গড়িয়েছিল। তখন ভারতের তথ্যমন্ত্রী ছিলেন নন্দিনী সৎপতি। তিনি প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে এ ছবি দেখিয়ে ছাড়পত্র আদায় করেছিলেন। নন্দিনী সৎপতির পিতা ছিলেন ওড়িয়া সাহিত্যের প্রধান লেখক কালিন্দীচরণ পাণিগ্রাহী, যিনি বাম আন্দোলনের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন।

জহির রায়হান এক বস্ত্রে যোগ দিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে। এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে তাঁর চিঠি পাওয়ার পর আমি লেট দেয়ার বি লাইট-এর চিত্রনাট্যের সঙ্গে তাঁর জন্য দু প্রস্থ প্যান্ট-শার্ট নিয়ে কলকাতা গিয়েছিলাম মে মাসের প্রথম সপ্তাহে। নিজের স্বাচ্ছন্দ্যের প্রতি কখনো মনোযোগী ছিলেন না তিনি। পাকিস্তানের প্রথম রঙিন ছবি সঙ্গম-এর অভূতপূর্ব ব্যবসায়িক সাফল্যের পর ১৯৬০-এর দশকের মধ্যভাগে তাঁকে গণ্য করা হতো দেশের অন্যতম ধনী চিত্রনির্মাতা হিসেবে। ১৯৬৮ সালে বড়দি নাফিসা কবির তাঁকে লন্ডন থেকে মরিস অক্সফোর্ড গাড়ি কিনে দিয়েছিলেন দুই লাখ টাকায়; যখন মরিস মাইনর, অস্টিন, ভক্স ওয়াগন পাওয়া যেত ১৫-২০ হাজার টাকায়। একাত্তরের মার্চে বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ আন্দোলনের সময় ভাসানী ন্যাপের নেতা কাজী জাফর তাঁকে বলেছিলেন মাওলানা ভাসানীর চলাফেরার জন্য একটি গাড়ি জোগাড় করে দিতে। জহির রায়হান তাঁর বিলাসী গাড়ি মরিস অক্সফোর্ড কাজী জাফরকে দিয়েছিলেন, যেটি আর ফেরত পাননি।

১৯৬০-এর দশকের মধ্যভাগে সোভিয়েত-চীন মহাবিতর্কে এ দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলন দ্বিধাবিভক্ত হয়েছিল। বড়দা শহীদুল্লা কায়সার ছিলেন মস্কো শিবিরে, অন্যদিকে বড়দি নাফিসা কবির ছিলেন পিকিং শিবিরে। জহির রায়হান এ বিভক্তি কখনোই মেনে নিতে পারেননি। কোনো পক্ষই তাঁর সহযোগিতা থেকে কখনো বঞ্চিত হয়নি। তাঁর আ স্টেট ইজ বর্ন প্রামাণ্যচিত্রে স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় নীতি কী হবে, এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের পাশাপাশি মাওলানা ভাসানী ও মণি সিংহের বক্তব্যও ছিল।

মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রচণ্ড আর্থিক অনটনে ছিলেন জহির রায়হান। তখন বাংলাদেশের এক চিত্রপ্রদর্শক জীবন থেকে নেয়ার একটি কপি কলকাতায় নিয়ে গোপনে বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছিলেন। জহির রায়হান জানতে পেরে তাঁর কলকাতার বন্ধুদের সহায়তায় তা উদ্ধার করেন। তিনি এ ছবি বিক্রি করেছিলেন প্রায় দেড় লাখ টাকায়। এর অর্ধেক দিয়েছিলেন মুজিবনগর সরকারকে। বাকি অর্ধেক দিয়েছিলেন বাংলাদেশের চলচ্চিত্রশিল্পী ও কলাকুশলীদের সংগঠনকে, যাঁরা বিভিন্নভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। অথচ সেই সময় তাঁর স্ত্রী সুচন্দা এবং পুত্র অপু-তপুর চিকিৎসার ব্যয়নির্বাহ দূরে থাক, দুবেলা খাওয়ার নিশ্চয়তাও ছিল না। সেই দুঃসময়ে কলকাতার সাহিত্য, সংবাদপত্র ও চিত্রজগতে জহির রায়হান ও শহীদুল্লা কায়সারের বন্ধুরা তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, যাঁদের ভেতর কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়, চিত্রনির্মাতা হরিসাধন দাশগুপ্ত ও কথাশিল্পী দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

স্বাধীন বাংলাদেশের সংস্কৃতির রূপরেখা, চলচ্চিত্রশিল্পের জাতীয়করণ প্রভৃতি বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধকালেই তাঁর নীতিনির্ধারণী লেখা কলকাতার গণমাধ্যম ও মুক্তাঞ্চল থেকে প্রকাশিত স্বাধীন বাংলার বিভিন্ন সংবাদপত্রে বেরিয়েছিল। চলচ্চিত্রনির্মাতা হিসেবে জহির রায়হান ছিলেন সোভিয়েত চিন্তাধারায় বিশ্বাসী। আইজেনস্টাইন ছিলেন তাঁর গুরু। মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে লন্ডনে বাংলাদেশ-বিষয়ক একটি আন্তর্জাতিক

সম্মেলনে অংশগ্রহণের জন্য ড. এনামুল হক আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন জহির রায়হান ও আমাকে। জহির রায়হান আয়োজকদের বলেছিলেন, তাঁর টিকিট যেন এয়ারোফ্লোতে মস্কো হয়ে পাঠানো হয়। আয়োজকেরা তা-ই করেছিলেন। মস্কোর ভিসা পেতে দেরি হওয়ায় নভেম্বরে তাঁর যাওয়া হয়নি। ডিসেম্বরে তো যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না, কারণ বিজয়ের জন্য আমরা তখন মুহূর্ত গুনছিলাম।

অগ্রজ শহীদুল্লা কায়সারের আদর্শে বেড়ে উঠেছেন জহির রায়হান। বড়দার আদর্শ শুধু নয়, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের প্রতিও সর্বক্ষণ সজাগ ছিলেন তিনি। বড়দা দৈনিক সংবাদ-এর নির্বাহী সম্পাদক ছিলেন। তাঁর বেতনের অর্ধেক যেত পার্টি তহবিলে। বিয়ের পর বড়দার ভবিষ্যৎ ভেবে গুলশানে তাঁর নামে জমি কিনেছিলেন। কায়েতটুলীর পৈতৃক বাড়িতে বড়দা থাকবেন বলে একতলাকে দোতলা করেছিলেন। অথচ নিজের কিংবা দুই স্ত্রী সুমিতা-সুচন্দা বা চার সন্তানের জন্য কিছুই রেখে যাননি। বঙ্গবন্ধুর সরকার সুমিতা ভাবির জন্য মোহাম্মদপুরে অবাঙালিদের একটি পরিত্যক্ত বাড়ি বরাদ্দ করেছিলেন। ২০০১ সালে খালেদা-নিজামীদের জোট সরকার জহির রায়হানের পরিবারকে সেই বাড়ি থেকে উৎখাত করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুই বছর আগে মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছেন জহির রায়হানের চার সন্তানের জন্য একটি বাড়ি বরাদ্দ করতে। দুই বছর ধরে বিপুল, পার্থ, অপু, তপু মন্ত্রণালয়ের এক দপ্তর থেকে আরেক দপ্তরে ঘুরছে, কিছুই হয়নি।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য জহির রায়হান তাঁর সবকিছু উৎসর্গ করেছিলেন। অথচ তাঁর সন্তানদের আজ মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই। স্বাধীন বাংলাদেশে মৌলবাদী ঘাতকদের হাতে নিহত লেখক হুমায়ুন আজাদের ভাষায় বলতে হয়, আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম?

সূত্র: ২৬ মার্চ ২০১৬ প্রথম আলোর "স্বাধীনতা দিবস" বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত