অপারেশনে যাওয়ার আগে ব্রিফিং শুনছেন একদল মুক্তিযোদ্ধা
স্বাধীনতা দিবস-২৬ মার্চ

অবশেষে বিদ্রোহ

সে রাতে জনাদশেক এনসিও এবং জওয়ান পালা করে আমার টেন্ট পাহারা দেয়, যদিও হাবিলদাররা কখনো পাহারা দেয় না, সেটা সিপাইদের কাজ। কিন্তু আমি ওদের বারণ করতে পারলাম না।

২৫ মার্চ সন্ধ্যায় কুমিল্লা থেকে নির্দেশ এল, আরও লোক আসছে। তাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। আমরা সে অনুযায়ী ব্যবস্থা করলাম, কিন্তু জানতাম না কারা আসছে। রাত আটটার দিকে সিও কর্নেল মালিক খিজির হায়াত খান কুমিল্লায় অবস্থিত চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাকি কোম্পানিগুলো নিয়ে উপস্থিত হলেন। সিওর সঙ্গে এল ক্যাপ্টেন মতিন (পরে ব্রিগেডিয়ার অব.), ক্যাপ্টেন গাফফার (পরে লে. কর্নেল অব.), লে. আমজাদ সাইদ (পাকিস্তানি অফিসার) ও ডা. লে. আবুল হোসেন (পরে ব্রিগেডিয়ার)। ডা. আবুল হোসেন এসেছিল আখতারের বদলে টেম্পোরারি ডিউটিতে। আখতারের পোস্টিং অর্ডার নিয়ে এসেছিল সে। আখতারের পোস্টিং হয়েছিল আজাদ কাশ্মীরের একটি স্টেশনে। সিও বললেন, যুদ্ধ আসন্ন বলে ব্রিগেড কমান্ডার তাঁকে কুমিল্লা থেকে চতুর্থ বেঙ্গলের প্রায় সব সৈন্যকে দিয়েই পাঠিয়ে দিয়েছেন। ক্যান্টনমেন্টে তখন রয়েছে শুধু LOB (Left out of Battle) সেনাসদস্যরা, অর্থাৎ বয়স্ক, অবসর অত্যাসন্ন এমন, কিংবা অসুস্থ এবং পাহারায় নিয়োজিত অল্পসংখ্যক সৈন্য। রাত ১১টার দিকে সিও আমাকে শাজবাজপুরে আমার অবস্থানে চলে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। নির্দেশমতো রওয়া হয়ে গেলাম। ১২ মাইল দূরের গন্তব্যে পৌঁছালাম রাত তিনটার দিকে। তারপর তিতাস নদীর পাড়ে খোঁড়া ট্রেঞ্চে অবস্থান নিলাম আমরা। কিন্তু সকাল ছয়টাতেই (২৬ মার্চ) ব্রাহ্মণবাড়িয়া ফিরে যাওয়ার আদেশ এল। কী আর করা! ঘণ্টাখানেক পর আবার রওনা হলাম ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে। আশ্চর্য ব্যাপার, কিছুদূরে যেতেই দেখলাম রাস্তার ওপর পড়ে আছে বিশাল একটা গাছ। পড়ে আছে মানে কেটে ফেলে ব্যারিকেড দেওয়া হয়েছে আরকি! অথচ ঘণ্টা তিনেক আগেও রাস্তা ছিল একেবারে পরিষ্কার। বুঝতে পারলাম জনতা সেনাবাহিনীর গতিরোধ করার জন্যই এ কাজ করেছে। পরে জেনেছিলাম ২৫ মার্চের রাতে ঢাকায় পরিচালিত হত্যাযজ্ঞের খবর সেই রাতে পেয়েই বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য জনতা শেষ রাতের দিকে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে অনেকগুলো ব্যারিকেড তৈরি করে। যা-ই হোক, জওয়ানেরা গাড়ি থেকে নেমে গাছ কেটে রাস্তা থেকে সরানোর পর আবার যাত্রা শুরু করলাম। কিন্তু কিছুদূর যেতে না-যেতেই আবার ব্যারিকেড। ১২ মাইল পথে অন্তত ২০ জায়গায় এ রকম ব্যারিকেড সরিয়ে এগোতে হলো। রাস্তা একদম ফাঁকা। কোনো লোকজনের দেখা পাচ্ছিলাম না। ব্যারিকেডের কারণে ১২ মাইল রাস্তা পেরোতে ঘণ্টা তিনেক লেগে গেল। ১০টার দিকে ক্যাম্পে পৌঁছে দেখলাম, সাদেক নওয়াজ, ক্যাপ্টেন গাফফার, লেফটেন্যান্ট আমজাদ, লেফটেন্যান্ট আখতার, হারুন-এদেরকে নিয়ে সিও বসে আছেন। আমার সঙ্গে ছিল সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট কবির। সিও এবং অন্যদের বেশ গম্ভীর দেখাচ্ছিল। সিও আমাকে জানালেন, দেশে সামরিক আইন জারি করা হয়েছে। ক্যাপ্টেন মতিনের কোম্পানিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে পাঠানো হয়েছে সান্ধ্য আইন কার্যকর করার জন্য। তিনি আমাকে তখনই পুলিশ লাইনসে গিয়ে পুলিশদের নিরস্ত্র করার নির্দেশ দিলেন। আমি তাঁকে বললাম, পুলিশদের নিরস্ত্র করতে গেলে অহেতুক গোলাগুলি, রক্তপাত হবে। সিও অবশ্য প্রথমটায় চেয়েছিলেন সাদেক নেওয়াজ গিয়ে প্রয়োজন বোধে শক্তি প্রয়োগ করে পুলিশদের নিরস্ত্র করুক। রক্তপাত এড়ানোর জন্য আমি সিওকে পরদিন নিজে গিয়ে পুলিশের কাছ থেকে অস্ত্র নিয়ে আসার মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিলাম। আমার কথায় তখনকার মতো নিবৃত্ত হলেন তিনি।

যুদ্ধের পূর্বাভাস

দুপুরের দিকে সিগন্যাল জেসিও নায়েব সুবেদার জহির তার ওয়্যারলেস সেট র​্যানডম স্ক্যান করার সময় কিছু অর্থপূর্ণ মেসেজ ইন্টারসেপ্ট করে। মেসেজগুলোকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে সে আমাকে তা জানাতে এল। পাকিস্তানি আর্মির দুটো স্টেশনের মধ্যে উর্দু ও ইংরেজিতে কথাবার্তাগুলো ছিল এ রকম-আরও ট্যাংক অ্যামুনিশন দরকার... হেলিকপ্টার পাঠানোর ব্যবস্থা করো। আমাদের অনেক ক্যাজুয়ালটি হচ্ছে...ইবিআরসির (ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট সেন্টার) অর্ধেক সৈন্য অস্ত্রসহ অথবা অস্ত্র ছাড়া বেরিয়ে গেছে ইত্যাদি। বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লাম। যুদ্ধ কি তাহলে শুরু হয়ে গেল! হারুন, কবির আর আখতারকে নিয়ে পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করতে বসলাম। মেসেজগুলো পেয়ে ওরা খুব উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল। পরিস্থিতি যে গুরুতর, সে বিষয়ে সবাই একমত হলো। বিশ্বস্ত জেসিও, এনসিওদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে তাদের মনোভাব বোঝার চেষ্টা করলাম। দেখলাম আমাদের চেয়ে তারা এক ধাপ এগিয়ে। জেসিও-এনসিওরা জানাল, তারা পুরোপুরি প্রস্তুত রয়েছে, কেবল আদেশের অপেক্ষা। একটু আশ্বস্ত হলাম। বিকেল পাঁচটা নাগাদ দেখতে পেলাম শত শত লোক ঢাকার দিক থেকে পালিয়ে আসছে। নারী-পুরুষ আর শিশুদের ওই সব দলকে জনস্রোত বললেই বোধ হয় দৃশ্যটার সঠিক বর্ণনা দেওয়া হয়। তাদের মুখে আতঙ্ক, অনিশ্চয়তা আর পথশ্রমের ছাপ। কেউ আসছে গোকর্ণঘাট হয়ে, অনেকে আসছে ঢাকা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেললাইন ধরে স্রেফ হাঁটাপথে। পালিয়ে আসা লোকগুলোর সঙ্গে আগে কথা বলার চেষ্টা করলাম। আর্মির পোশাক দেখে অনেকেই ভয়ে রাস্তা ছেড়ে মাঠ দিয়ে হাঁটা শুরু করল। আমরা বাংলায় কথা বলছি দেখে সাহস করে যে দু-একজন এল, তাদের কাছ থেকে জানলাম, ঢাকায় গতকাল অর্থাৎ ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি আর্মি সাধারণ মানুষের ওপর ট্যাংকসহ ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হামলা করেছে। বহু লোক মারা গেছে। কথা বলার মতো মানসিক অবস্থাও অনেকের ছিল না। তারা শুধু বলেছিল, আগুন...গুলি...ঢাকা...শেষ...লাখ লাখ লোক মারা গেছে-এ রকম অসংলগ্ন কথা। এরপর আর বুঝতে বাকি রইল না কিছু। বুঝলাম আর দেরি নয়, এবার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পালা। জওয়ানদের মনোভাব এর মধ্যেই জানা হয়ে গিয়েছিল।

সন্ধ্যার দিকে জহিরের সিগন্যাল সেট দিয়ে শমশেরনগরে মেজর খালেদ মোশাররফের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। ঢাকাইয়া বাংলায় ইন্টারসেপ্টেড মেসেজগুলো শুনিয়ে তার মতামত জানতে চাইলাম। বললাম, পুরো ব্যাটালিয়ন এখন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। পাকিস্তানি সৈন্যদের হামলার শিকার হয়ে লোকজন যে ঢাকা থেকে পালিয়ে আসছে, তাও জানালাম। খালেদ মোশাররফকে বললাম আমরা তৈরি। তাকে তাড়াতাড়ি কোম্পানি নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আসার অনুরোধ করলাম। আমাদের কথোপকথনের সময় সাদেক নেওয়াজ, আমজাদ এবং সিও খিজির হায়াত খান খুব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমাকে লক্ষ্য করছিলেন বলে বেশি কথা বলা সম্ভব হয়নি। খালেদ মোশাররাফও শমশেরনগর থেকে বেশি কথা বলেননি। সব শুনে তিনি একটি মাত্র কথা বললেন, ‘আমি রাতের অপেক্ষায় আছি।’ মেজর খালেদের এই একটি কথা থেকেই বুঝে নিলাম, কী বলতে চাইছেন তিনি। বুঝলাম, তিনি বিদ্রোহের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন এবং আজ রাতেই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উদ্দেশে রওনা হচ্ছেন। ২৭ মার্চ বেলা তিনটা নাগাদ তাঁর সঙ্গে দেখা হওয়ার আগ পর্যন্ত আমাদের মধ্যে আর যোগাযোগ হয়নি। শমশেরনগর যাওয়ার পর তাঁর withdrawal route অর্থাৎ পশ্চাদপসরণের রাস্তা পাকিস্তানিরা ৩১ পাঞ্জাবের এক কোম্পানি সৈন্য দিয়ে বন্ধ করে রেখেছিল। তাই তিনি চা-বাগানোর ভেতর দিয়ে বিকল্প রাস্তা ধরে পরদিন অর্থাৎ ২৭ মার্চ বেলা প্রায় তিনটার দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া এসে পৌঁছান।

শাফায়াত জামিল

অফিসার ও জওয়ানদের মধ্যে উত্তেজনা

খালেদ মোশাররফের সঙ্গে কথা হওয়ার পর থেকেই জুনিয়র অফিসাররা দ্রুত কিছু একটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য আমাকে চাপ দিচ্ছিল। সন্ধ্যায় ইয়াহিয়া খানের বেতার ভাষণ শুনে তারা আরও উত্তেজিত হয়ে পড়ে। তখনই অস্ত্র তুলে নেওয়ার নির্দেশদানের জন্য তারা আমাকে পীড়াপীড়ি করতে থাকে। আমি ব্যাটালিয়নের অন্য কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ জুনিয়র অফিসারের চূড়ান্ত মতামতের অপেক্ষা করছিলাম। কারণ, সিদ্ধান্ত গ্রহণে সামান্য ভুল কিংবা সিদ্ধান্ত সময়োপযোগী না হলে সব পণ্ড হয়ে যাবে এবং অপ্রয়োজনীয়ভাবে লোক ক্ষয় ঘটবে। দ্বিধাগ্রস্ত একজন অফিসার ও জ্যেষ্ঠ একজন জেসিওকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য সারা রাত সময় দিলাম।

সন্ধ্যার একটু পর আমার কোম্পানির সৈন্যদের দেখতে টেন্টে গেলাম। সঙ্গে কবির, আখতার, হারুন ছাড়াও বেলায়েত, শহীদ, মুনীর, ইউনুস, মইনুলসহ কয়েকজন বিশ্বস্ত এনসিও। পাকিস্তান আর্মিতে অফিসার ও সাধারণ সৈন্যদের মধ্যে একটা সামাজিক দূরত্ব ছিল। তাই সৈন্যরা কেউ অফিসারদের কাছ খোলামেলাভাবে মনের কথা বলত না। যা-ই হোক, সৈন্যরা এই সময় বসে তাস খেলছিল। আমাকে দেখে তারা উঠে দাঁড়াল। একজন আমার কাছে এসে বলল, ‘স্যার, বাংলাদেশে যে কী হইতাছে, তা তো জানেন। আমরাও সব বুঝি, জানি এবং খেয়াল রাখি। সময়মতো ডিসিশন দিয়া দিয়েন, না দিলে আমগোরে পাইবেন না। যার যার অস্ত্র নিয়া যামুগা।’ জওয়ানেরাও আমাদের মতো করে ভাবছে দেখে গর্বিত ও আশান্বিত হলাম আমি। কিন্তু কোনো মন্তব্য না করে কেবল পিঠ চাপড়ে দিয়ে আশ্বস্ত করতে চাইলাম তাকে। এতক্ষণে পুরোপুরি নিশ্চিত হলাম, তারা আমাদের ইঙ্গিতের অপেক্ষায় রয়েছে মাত্র। জাতির দুর্ভাগ্য, সামরিক অফিসারদের সবাই এদের মতো চেতনা, সতর্কতা এবং দায়িত্ববোধসম্পন্ন ছিলেন না, তাই সঠিক সময়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। পারলে হয়তো পাকিস্তানিদের পক্ষে মাত্র ৪০০ থেকে ৫০০ সৈন্য দিয়ে চট্টগ্রামে বিভিন্ন ধরনের অস্ত্রধারী আমাদের দুই হাজার যোদ্ধাকে কাবু করা সম্ভব হতো না এবং যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, সেটাও হতো না। চট্টগ্রাম মুক্তাঞ্চল হিসেবে আমাদের অধিকারে থাকলে বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগের সুবিধাসহ সমগ্র অঞ্চল মুক্তিযুদ্ধের প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠতে পারত। শুধু শুভপুর (ফেনী)-সীতাকুণ্ড এলাকাটি দখলে রাখতে পারলে এর দক্ষিণে পুরো চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামজুড়ে বিস্তীর্ণ মুক্তাঞ্চল প্রতিষ্ঠা করা যেত। দ্বিতীয় ও চতুর্থ বেঙ্গল এবং তিনটি আংশিক ব্যাটালিয়নের (প্রথম, তৃতীয় ও অষ্টম) সহায়তায় এটা করা অসম্ভব ছিল না। আর তাহলে হয়তো মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সমর্থনের জন্য কোনো একটি রাষ্ট্রের ওপর আমাদের নির্ভরশীলতাও বহুলাংশে হ্রাস পেত।

রাতে আমরা কয়েকজন টেন্টের সামনে ক্যাম্প চেয়ারে বসে আছি। এমন সময় দেখলাম, সিও খিজির হায়াত এস এম ইদ্রিস মিয়া আরও কযেকজন জেসিওকে নিয়ে সৈন্যদের টেন্টের কাছাকাছি ঘোরাঘুরি করছেন। সৈন্যদের টেন্ট ছিল আমাদের থেকে খানিকটা দূরে। সিওর গতিবিধি দেখে সবাই চিন্তিত হয়ে পড়লাম। ব্যাপারটা আমার কাছে সুবিধার মনে হচ্ছিল না। এ সময় এনসিও বেলায়েত, শহীদ, মনির আমাকে বলল, ‘স্যার, আজ রাতে আমরা আপনার টেন্ট পাহারা দেব। পাঞ্জাবিদের মতিগতি ভালো নয়। রাতে কোনো পাঞ্জাবি অফিসার অস্ত্র হাতে কাছে এলে সোজা গুলি চালাব। আপনাকে আমাদের প্রয়োজন।’

সে রাতে জনাদশেক এনসিও এবং জওয়ান পালা করে আমার টেন্ট পাহারা দেয়, যদিও হাবিলদাররা কখনো পাহারা দেয় না, সেটা সিপাইদের কাজ। কিন্তু আমি ওদের বারণ করতে পারলাম না। মেজর সাদেক নেওয়াজ এবং লে. আমজাদও সারা রাত আমার তাঁবুর ১০০-১৫০ গজ দূর থেকে আমার ওপর নজর রাখে। পাঞ্জাবি অফিসার দুজন সারা রাত জেগে ছিল।

চিন্তাক্লিষ্ট মন নিয়েই গভীর রাতে কোনো এক সময় ঘুমিয়ে পড়ি। শেষ রাতের দিকে একটা ফোন এল। কোম্পানীগঞ্জ পিসিও থেকে একজন অপারেটর আমাদের এখানকার সিনিয়র বাঙালি অফিসারের সঙ্গে কথা বলতে চাইছিল। আমি ফোন ধরলে সে বলল, ‘স্যার, আমি একজন সামান্য সরকারি কর্মচারী। একটা খবর দেওয়া অতি জরুরি মনে করে এত রাতে ফোন করে আপনার ঘুমে ব্যাঘাত ঘটালাম। একটু আগে পাকিস্তানি আর্মির ১২টা ট্রাক ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে রওনা হয়েছে। মিনিট পাঁচেক আগে তারা কোম্পানীগঞ্জ ত্যাগ করেছে।’ বুঝতে পারলাম, পাকিস্তানিরা পরিকল্পনা অনুযায়ী আমাদের অস্ত্র সমর্পণ করাতে আসছে।

অবশেষে বিদ্রোহ

২৭ মার্চ ভোর হতেই সিও খবর পাঠালেন, তাঁর অফিসে সকাল নয়টায় অফিসারদের মিটিং হবে। অবশ্য এরই মধ্যে চরম সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি আমি। সোয়া সাতটায় অফিসার্স মেসের দিকে রওনা হলাম। সঙ্গে কবির ও হারুন এবং বেলায়েত, শহীদ, মুনিরসহ কয়েকজন জওয়ান। সবাই সশস্ত্র। আমাদের বের হতে দেখেই অন্য জওয়ানেরা অ্যামুনিশনের বাক্স খুলে যার যার অস্ত্র লোড করা শুরু করল। অফিসার্স মেসে গিয়ে সিও, সাদেক নওয়াজ, আমজাদ, গাফফার, আখতার আর আবুল হোসেনকে দেখলাম। আমরা নাশতার টেবিলে বসলাম। ওয়েটার অর্ডার নিতে এল। সিও নাশতা করছিলেন। তাঁর পাশে বসা আমজাদ আর সাদেকের খাওয়া শেষ। খেতে খেতে সাদেকের সঙ্গে কথা বলছিলেন সিও। একটু দূরে সোফায় বসা আখতার আর আবুল হোসেন। এমন সময় একজন জ্যেষ্ঠ জেসিও এসে সিওকে বলল, সাদেক নওয়াজের কোম্পানিতে একটা সমস্যা হয়েছে, তাই তাকে এক্ষুনি সেখানে যেতে হবে। কথাটা শোনা মাত্র সিও তার সঙ্গে যেতে উদ্যত হলেন। আমজাদ আর সাদেকও উঠে দাঁড়াল। আমার সন্দেহ হলো, সিওকে সরিয়ে নিয়ে বিদ্রোহ বানচাল করার চেষ্টা করা হচ্ছে না তো? দ্রুত উঠে সিওকে বাধা দিলাম আমি। বললাম, পরিস্থিতি না জেনে এভাবে যাওয়া ঠিক হবে না, আগে সবাই অফিসে যাই। তারপর কথাবার্তা বলে কোম্পানিতে যাওয়া যাবে। তা ছাড়া কোম্পানির কমান্ডার হিসেবে সাদেক নওয়াজ আছে, আমি আছি। তাই তার এত ব্যস্ত হওয়ার প্রয়োজন নেই। সিও আমার কথা মেনে নিলেন। সাদেক নওয়াজ তখন তার স্টেনগানটা আনার জন্য রুমে যেতে চাইল। আমি তাকে বাধা দিয়ে বললাম, চাইলে আমার স্টেনগানটা নিতে পারে সে। এতে আশ্বস্ত হলো সাদেক। এরই আগে এক ফাঁকে আখতারকে সাদেকের রুমে পাঠিয়েছিলাম তার স্টেনগানটা সরিয়ে রাখার জন্য। এখন সাদেক তার ঘরে গেলে আখতার ধরা পড়ে যাবে। তাই কৌশলে ঠেকালাম ওকে। আখতার সাদেকের ঘরে গিয়ে আটটা ম্যাগাজিনসহ তার স্টেনগানটা নিয়ে নেয়। আমি সময় নষ্ট করতে চাইছিলাম না। পাকিস্তানি কনভয় আসার খবর তো পেয়েছিলামই, তা ছাড়া এখানকার পরিস্থিতি যথেষ্ট উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল (পরে জেনেছিলাম, সকালের দিকে পাকিস্তানি কনভয় ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের মাইল দুয়েকের মধ্যে পৌঁছানোর পর সম্ভবত আমাদের বিদ্রোহের খবর পেয়ে ফিরে যায়)। যা-ই হোক, সবাইকে নিয়ে অফিসে গেলাম। অফিসটা ছিল একটা তাঁবুতে। পাকিস্তানি অফিসার তিনজন তাঁবুতে ঢুকে চেয়ারে বসামাত্রই সশস্ত্র কবির আর হারুন দুই পাশে দাঁড়াল এবং আমি সিও ও অন্য দুজনকে বললাম, ‘You have declared war aginst the unarmed people of our country. You have perpetrated genocide on our people. Under the circumstances, we owe our allegiance to the people of Bangladesh and the elected representatives of the people. You all are under arrest. Your personal safety is my responsibility. Please do not try to influence others.’

বিদ্রোহ ঘটে গেল। এতক্ষণ ছিল একরকম পিনপতন নীরবতা। হঠাৎ দেখলাম ওয়াপদার তিনতলা কোয়ার্টার থেকে পাজামা-পাঞ্জাবি পরা এক বৃদ্ধ হাতে একটা দোনালা বন্দু নিয়ে ‘জয় বাংলা’ বলে চিৎকার আর ফাঁকা গুলি করতে করতে ক্যাম্পের দিকে ছুটে আসছে। গুলির আওয়াজ আর ‘জয় বাংলা’ শুনেই যেন সবার মধ্যে সংবিৎ ফিরে এল। ক্যাম্পে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে দিল জওয়ানেরা। সামরিক বাহিনীর কঠোর শৃঙ্খলার মধ্যে কখন আর কোত্থেকেই বা ওরা পতাকাটা পেল, তখন আমার মাথায় সেটা ঢুকছিল না। বন্দী পাকিস্তানি অফিসার তিনজনকে সিওর টেন্টে কঠোর পাহারায় রেখে বাইরে বেরিয়ে আসতেই আমাকে দেখে জওয়ানেরা ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে উঠল। একসঙ্গে পাঁচ-ছয় শ জওয়ানের মুখে জয় বাংলা স্লোগান শুনে সারা দেহ রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল আমার। কয়েকজন উল্লাসে সমানে ফাঁকা গুলি ছুড়ে যাচ্ছিল। আমি চিৎকার করে বললাম, কেউ যেন এখন একটা গুলিও বাজে খরচ না করে। বলতে গেলে গালিগালাজ করেই জওয়ানদের মধ্যে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনলাম। সাময়িকভাবে ব্যাটালিয়নের অধিনায়কত্ব গ্রহণ করলাম আমি।

গুলির আওয়াজ আর জয় বাংলা ধ্বনি শুনে কয়েক মিনিটের মধ্যেই শহর এবং আশপাশের গ্রামগুলো থেকে পিল পিল করে অসংখ্য লোক এসে হাজির হলো ক্যাম্পে। অনেকের হাতে বল্লম, মাছ মারা কোচ-এসব দেশি অস্ত্র। এমনকি কয়েকটা মরচেপড়া তলোয়ারও দেখলাম। জনতা শুধু পাকিস্তানি অফিসারদের চায়। ওই উন্মত্ত লোকদের হাতে পড়লে পাকিস্তানি অফিসারদের অবস্থা কী দাঁড়াবে, সেটা সহজেই অনুমেয়। কথা দিয়েছি, তাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব আমার, তাই উত্তেজিত লোকজনকে অনেক কষ্টে নিবৃত্ত করলাম। পাঞ্জাবি পরা বৃদ্ধটি পাকিস্তানিদের হত্যা করার জন্য বন্দুক নিয়ে তেড়ে আসছিলেন। তাঁকে আমি স্টেনগানের বাঁট দিয়ে ঠেকালাম। সবাইকে বললাম, এরা POW অর্থাৎ Prisoner of War। সুতরাং এদের হত্যা করা যাবে না। আমরা এদের প্রতি জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী আচরণ করতে বাধ্য। তারপর প্রটেকশনের জন্য বন্দী পাকিস্তানি অফিসার তিনজনকে আখতারের তত্ত্বাবধানে স্থানীয় থানা হাজতে পাঠিয়ে দিলাম। আখতার গিয়ে সিআইকে বলে, ‘এদের নিরাপত্তার দায়িত্ব আপনার। মেজর শাফায়াত বলেছেন, বন্দীদের কোনো ক্ষতি হলে আপনার রক্ষা নেই।’ এর আগে কয়েক শ সৈন্যের কণ্ঠে জয় বাংলা স্লোগান শুনে কয়েকজন পাকিস্তানি সৈন্য ও বিহারি পালিয়ে যেতে চেষ্টা করে, কিন্তু কিছুদূর যেতেই তারা জনতার হাতে ধরা পড়ে নিহত হয়।

বিদ্রোহের প্রাথমিক উত্তেজনা স্তিমিত হয়ে এলে জওয়ানদের আশপাশের গ্রামগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে অবস্থান নেওয়ার নির্দেশ দিলাম। কারণ, পাকিস্তানি বাহিনী বিমান হামলা চালাতে পারে। একজন অফিসারকে একদল জওয়ানসহ কুমিল্লার দিক থেকে পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণ ঠেকানোর জন্য শহরের দক্ষিণে অ্যান্ডারসন খালের পাশে অবস্থান নিতে পাঠালাম। বেলা তিনটার দিকে মেজর খালেদ মোশাররফ তাঁর সেনাদল নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া এসে পৌঁছালে আমি চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের দায়িত্ব তাঁর হাতে অর্পণ করলাম।

শাফায়াত জামিল: স্বাধীনতার পর কর্নেল। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে বিদ্রোহ করে যাঁরা মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন, তাদের অন্যতম ছিলেন তিনি।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, রক্তাক্ত মধ্য-আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর (সাহিত্য প্রকাশ, সপ্তম মুদ্রণ ২০১৯) গ্রন্থ থেকে