মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখা

স্বাধীনতা ও মুক্তি শব্দের মর্মার্থ

স্বাধীন ও সার্বভৌম বহুজাতিক রাষ্ট্রের সব প্রদেশ ও অঞ্চলই স্বাধীন। বিভিন্ন জাতিসত্তা, ভাষা, ধর্ম, বর্ণ ও গোত্রের মানুষ সে রাষ্ট্রের নাগরিক। তবে অনেক স্বাধীন দেশের সব শ্রেণির মানুষ সমান স্বাধীন ও মুক্ত নয়। যেমন, ১৯৭১ সালের আগে পাকিস্তান ছিল স্বাধীন ও সার্বভৌম, কিন্তু তার সব নাগরিক স্বাধীন ও মুক্ত ছিল না। পূর্ব পাকিস্তানে আমরা কি তাহলে কারারুদ্ধ ছিলাম? না, তা-ও ছিলাম না। আমরা হাঁটা-চলাফেরা করেছি, হাটবাজার করেছি, কিন্তু মুক্ত বলতে যা বোঝায় তা ছিলাম না। ‘স্বাধীন’ ও ‘মুক্ত’, ‘স্বাধীনতা’ ও ‘মুক্তি’—শব্দগুলো হুবহু সমার্থক নয়।

একাত্তরের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে ‘স্বাধীনতা’ শব্দটি উচ্চারণ করেছেন একবার, কিন্তু ‘মুক্ত’ ও ‘মুক্তি’ শব্দ উচ্চারণ করেছেন কয়েকবার। তিনি বলেছেন, ‘দেশের মানুষ অর্থনীতি, রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক মুক্তি’ চায়। সে জন্য সংগ্রাম করতে হবে এবং যতক্ষণ ‘দেশের মুক্তি না হচ্ছে’, ততক্ষণ সংগ্রাম চলবে। তিনি উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেছেন ন্যায়সংগত সংগ্রামের মাধ্যমে ‘এই দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব, ইনশা আল্লাহ।’ প্রদেশের মানুষ ভালো রাস্তা-সেতু চায়, তবে শুধু সেগুলো বানানোর জন্য কেন্দ্রীয় সরকার বেশি বরাদ্দ চায় না; তিনি বলেছেন, ‘বাংলার মানুষ অধিকার চায়।’ বাংলাদেশের মানুষ সেই গণতান্ত্রিক অধিকার চায়, যা তার ন্যায়সংগতভাবে প্রাপ্য। কোনো দেশের রাস্তাঘাট, বড় বড় স্থাপনা বা অবকাঠামো নির্মাণের জন্য সীমাহীন রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জনের প্রয়োজন হয় না। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বলা হয়, ‘বাংলাদেশের জনগণের জন্য সমতা, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে’ বর্তমান মুক্তিযুদ্ধ।

স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে গৃহীত বাংলাদেশের সংবিধানে বলা হয়েছিল, ‘জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রামের’ মাধ্যমে জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যথার্থই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল ‘জাতীয় মুক্তি’র বিষয়কে। পরবর্তী সময়ে সংবিধান সংশোধন করে ওই জায়গায় বলা হয়, ‘জাতীয় স্বাধীনতার জন্য ঐতিহাসিক যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত করিয়াছি।’ এই যে ‘মুক্তির জন্য’র জায়গায় ‘স্বাধীনতার জন্য’ এবং ‘ঐতিহাসিক সংগ্রামের’ জায়গায় ‘ঐতিহাসিক যুদ্ধের’ কথা, তা শুধু শব্দের হেরফের নয়, দ্যোতনা ও মর্মার্থেরও পরিবর্তন।

‘স্বাধীনতার জন্য ঐতিহাসিক যুদ্ধ’ বললে শুধু একাত্তরের ৯টি মাসের যুদ্ধ বোঝায়, কিন্তু ‘জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রাম’ বললে একাত্তরের ৯ মাসের প্রতিরোধযুদ্ধসহ জাতির মুক্তির লক্ষ্যে অতীতের সব ঐতিহাসিক আন্দোলন-সংগ্রাম-বিদ্রোহকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। দীর্ঘকাল একটি জনগোষ্ঠী অন্যায়-অবিচার, শোষণ-বঞ্চনা থেকে মুক্তি পেতে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে। তার মধ্যে স্বশাসিত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা জন্মেছে। তাকে চিরতরে দমন করতে ২৫ মার্চ থেকে শুরু হয় গণহত্যা। জনগণ গড়ে তোলে তার বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ। এ দেশের মানুষের মুক্তিসংগ্রামের সর্বশেষ অধ্যায়ে হয় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ।

৭ মার্চের ভাষণে ‘বাংলার মানুষ অধিকার চায়’ বলার মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু বুঝিয়েছিলেন সব ধরনের গণতান্ত্রিক ও মানবিক অধিকার। যে রাষ্ট্রের জনগণ তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বঞ্চিত, তার রাজনৈতিক স্বাধীনতা অসম্পূর্ণ। তার জনগণ স্বাধীন দেশের নাগরিক হলেও মুক্তির স্বাদ থেকে বঞ্চিত। গত কয়েক শ বছরে ইউরোপে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মাধ্যমে ভাষাভিত্তিক যেসব জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেগুলো দীর্ঘ যুদ্ধবিগ্রহের ভেতর দিয়ে হয়েছে। ইউরোপের মতো এত যুদ্ধ ও রক্তপাত পৃথিবীর আর কোনো অঞ্চলে হয়নি। ইউরোপের অসংখ্য যুদ্ধের প্রতিটির আলাদা আলাদা নাম আছে। যেমন একটি যুদ্ধের নাম ‘হানড্রেড ইয়ার্স ওয়ার’—শতবর্ষের যুদ্ধ।

১৩৩৮ থেকে ১৪৫৩ পর্যন্ত ফ্রান্সের সঙ্গে ইংল্যান্ডের যুদ্ধ হয়েছে। দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের ভেতর দিয়েই ফরাসি জাতীয়তাবাদী চেতনার জন্ম হয়। অবশ্য সব দেশের জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম এক রকম নয়। প্রায় সব ক্ষেত্রে জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে রক্তের বন্যা বয়ে গেছে ইউরোপের দেশে দেশে। ইউরোপে বিপুল রক্তপাতের ভেতর দিয়ে জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলেও তার অনেকগুলোতেই রাজতন্ত্র বিলুপ্ত করা হয়নি। রাজতন্ত্র রেখেই সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা হয়। যে শাসনব্যবস্থায় জনগণের মতামত প্রাধান্য পায়, সেটাই গণতান্ত্রিক শাসন। সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকদের ইচ্ছায় সরকারের পরিবর্তন ঘটবে, সংখ্যাগরিষ্ঠের ইচ্ছায় সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে। সেটাই গণতন্ত্র, তবে সব দেশের গণতান্ত্রিক পদ্ধতি এক রকম নয়।

তাহলে কি সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের সমর্থিত সরকার যা খুশি তা-ই করতে পারে? সে ক্ষমতা বা অধিকার কি তার আছে? না, তা নেই। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী যেন একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী না হয়, সে জন্য ভারসাম্য বা জবাবদিহির, অর্থাৎ চেক অ্যান্ড ব্যালান্সের ব্যবস্থা থাকে। পার্লামেন্ট এবং বিচার বিভাগ তো আছেই, রয়েছে আরও স্বনিয়ন্ত্রিত সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। নির্বাচন কমিশন, কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল, দুর্নীতি দমন কমিশন প্রভৃতি সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান নির্বাচিত সরকারকে স্বৈরাচারী হতে বাধা দেয়। যে গণতন্ত্রে এসব সংস্থা অকার্যকর অথবা দুর্বল, সেখানে গণতন্ত্রও দুর্বল ও অকার্যকর। রাষ্ট্র শক্তিশালী হয় এবং অন্য দেশের মানুষের চোখে মর্যাদাবান হয়ে ওঠে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দক্ষতার কারণে। যেসব দেশে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের কর্তারা সরকারের ভৃত্যের ভূমিকা পালন করেন, সেখানে জনগণের মুক্তি নেই।

ইউরোপে দেখা গেছে পার্লামেন্ট ও বিচার বিভাগের মতোই আরেকটি প্রতিষ্ঠান জাতিরাষ্ট্রের গণতন্ত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তা হলো বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। তাদের কাজ স্বাধীনভাবে বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা করা। রাষ্ট্র পরিচালনায় সেখান থেকে আসে দিকনির্দেশনা। সেখানে হয় সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান, ইতিহাস প্রভৃতির চর্চা। বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাধীন চিন্তার অধিকারের যদি কেউ অপব্যবহার করেন, সীমা লঙ্ঘন করেন, তাঁকে নিপীড়ন ও বলপ্রয়োগে দমন করার দরকার নেই, আপনা-আপনিই তিনি বর্জিত হবেন। বিশ্ববিদ্যালয়কে সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলে রাষ্ট্রই অকার্যকর হয়ে পড়ে।

স্বাধীনতাসংগ্রামে যাঁরা নেতৃত্ব দেন এবং ভূমিকা রাখেন, ইতিহাসে তাঁরা উতরে যান। তাঁদের দায়িত্ব শেষ। জনগণের মুক্তির জন্য কাজ করতে হয় প্রজন্মের পর প্রজন্মের। স্বাধীনতাসংগ্রামী ও মুক্তিযোদ্ধাদের চেয়ে তাদের দায়িত্ব কম নয়। তাদের ব্যর্থতা ও সফলতার ওপর নির্ভর করে রাষ্ট্রের ব্যর্থতা ও সাফল্য।

সৈয়দ আবুল মকসুদ লেখক ও গবেষক

সূত্র: ২৬ মার্চ ২০১৯, ১২ চৈত্র ১৪২৫, মঙ্গলবার, প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।