মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখা

সুহৃদ ও সাহসী কূটনীতিক আর্চার কে ব্লাড

আর্চার ব্লাড

একাত্তরে যুক্তরাষ্ট্র আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। বিশেষ করে নিক্সন-কিসিঞ্জার জুটি সরাসরি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পক্ষ নেন।

এই প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও যে মার্কিন কূটনীতিক বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছিলেন, তিনি আর্চার কে ব্লাড। তিনি তখন ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের কনসাল জেনারেল। ষাটের দশকের শুরুতেও একবার এখানে কূটনৈতিক দায়িত্ব পালন করেছিলেন তিনি। সেই সূত্রে বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে তাঁর সখ্য গড়ে ওঠে।

মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকায় কর্মরত মার্কিন কনসাল জেনারেল আর্চার কে ব্লাড ও তাঁর সহকর্মীদের সই করা টেলিগ্রাম মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য সারোয়ার আলীর কাছে হস্তান্তর করেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা স্টিফেনস ব্লুম বার্নিকাট l ছবি: প্রথম আলো

একাত্তরে আর্চার ব্লাডের সামনে এল কঠিন পরীক্ষা। সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি মেনে চলতে বাধ্য। আবার একজন বিবেকবান মানুষ হিসেবে মানবতার লাঞ্ছনা মেনে নিতে পারেননি তিনি। শেষ পর্যন্ত বিবেকই জয়ী হলো। ৬ এপ্রিল আর্চার ব্লাড মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরে টেলিগ্রাম পাঠালেন, ‘আমাদের সরকার গণতন্ত্র দমনকে নিন্দা করতে ব্যর্থ হয়েছে। আমাদের সরকার গণহত্যার নিন্দা করতে ব্যর্থ হয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত সরকার যখন পূর্ব পাকিস্তানে দমনপীড়ন চালাচ্ছে, তখন আমাদের সরকার নাগরিকদের রক্ষায় কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে। পেশাদার সরকারি কর্মচারী হিসেবে আমরা সরকারের (আমেরিকান) বর্তমান নীতির সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করছি এবং আমরা আশা করছি আমাদের সৎ ও স্থায়ী স্বার্থ রক্ষিত হবে এবং আমাদের নীতির পরিবর্তন ঘটবে।’ ওই টেলিগ্রামে সই করেছিলেন কনসাল অফিসের অধিকাংশ কর্মকর্তা। পরে ব্লাড মন্তব্য করেছিলেন, মার্চের ঘটনাবলি তাঁর জন্য ছিল ‘ভয়াবহ অভিজ্ঞতা।’

স্বাভাবিক কারণেই মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর ব্লাডের এই বার্তাকে সুনজরে দেখেনি। তাঁকে একপর্যায়ে ঢাকা থেকে ওয়াশিংটনে ফিরিয়ে নেওয়া হয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে। কিন্তু ব্লাড মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে যে ধাক্কা দিয়েছিলেন, তা নিক্সন-কিসিঞ্জার চক্রের জন্য ছিল চপেটাঘাত। ব্লাড সেই সময়ে মার্কিন প্রশাসনের কোপানলে পড়লেও পরবর্তীকালে নন্দিত হয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাঁকে ক্রিশ্চিয়ান এ হার্টার অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত করে। ঢাকায় আমেরিকান সেন্টারের লাইব্রেরির নামও রাখা হয় তাঁর নামে: আর্চার কে ব্লাড লাইব্রেরি।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তাঁর স্মৃতিচারণামূলক বই দ্য ক্রুয়েল বার্থ অব বাংলাদেশ প্রকাশিত হয় ২০০২ সালে।

সূত্র: ৮ ডিসেম্বর ২০১৮, শনিবার , প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।