মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখা

সাত মুক্তিযোদ্ধার জীবনের রক্ষক

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের উদ্যোগে বিভিন্ন অঞ্চলের স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীরা সংগ্রহ করেছিল মুক্তিযুদ্ধের গল্প। তাদের সংগ্রহে ও লেখায় মুক্তিযুদ্ধের সেসব না-জানা গল্প।

আমার আব্বা বললেন, পাকিস্তানি সেনারা যখন লোক মারতে লাগল, তখন এক রাতে শেখ মণি ও তোফায়েল আহমেদ পালিয়ে আমাদের বগুড়ার গ্রামে এসে উপস্থিত হন। তাঁরা ভারতে চলে গেলে আমার বড় ভাই শাহজাহান ও আমার চাচা সুলতান মাহমুদ আমাকে বললেন, ‘চলো, আমরাও ভারতে চলে যাই। পাকিস্তানি বাহিনী আমাদের কাউকে বাঁচতে দেবে না।’ এপ্রিল
মাসে আমরা হিলি বর্ডার পার হয়ে ভারতের শরণটিলা গিয়ে উপস্থিত হই। সেখানে ভারতের সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা একটি ক্যাম্প তৈরি করেছিলেন।

বগুড়া, পাবনা, রাজশাহী ও রংপুর এলাকার লোকেরা পাকিস্তানি বাহিনীর অত্যাচারে দলে দলে ভারতে যাচ্ছিলেন। শরণটিলায় তাঁদের একত্র করা হয়। সেখানে কিছুদিন থাকার পর আমাদের মতো ছেলেদের নিয়ে ট্রেনিং শুরু হয়। তখন আমার বয়স খুবই কম, এইচএসসি প্রথম বর্ষে পড়ি। ট্রেনিংয়ের সময় আমাকে এসএলআর দেওয়া হয়। এসএলআরের ওজন বহন করা আমার পক্ষে কঠিন হতো। ৯ এমএম এসএমজি ও গ্রেনেড নিক্ষেপের ট্রেনিং করি। একদিন শুনতে পাই, সারা দেশে পাকিস্তানি বাহিনী বাঙালিদের মেরে শেষ করে দিচ্ছে। বাড়িঘর পুড়িয়ে দিচ্ছে। যাঁদের ছেলেরা ভারতে গেছে, তাঁদের গুলি করে মারছে। এসব শুনে বাংলাদেশে আমি ফিরে আসতে অস্থির হয়ে পড়লাম। তখনো পুরোপুরিভাবে ট্রেনিং শেষ হয়নি। ক্যাম্প থেকে আদেশ হলো, পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে লিপ্ত হতে হবে।

একদিন আমাদের মধ্য থেকে ৫০-৬০ জন মুক্তিযোদ্ধাকে ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। সেখানে তুমুল যুদ্ধ হয়। সেই যুদ্ধে আমাদের মাত্র ২০ জনের মতো মুক্তিযোদ্ধা ফিরে আসেন। বাকিরা সব শহীদ হন। এভাবে যুদ্ধ চলতে থাকে। আমাদের এলাকায় তখন বেশ কিছু রাজাকার তৈরি হয়েছে। তাদের কাজ ছিল পাকিস্তানি বাহিনীকে সাহায্য করা। যাঁরা মুক্তিযুদ্ধে গেছেন, তাঁদের পিতামাতা, আত্মীয়স্বজনদের নির্মমভাবে হত্যা করা।

আমাদের পাশের গ্রামে একজন ডাক্তার ও তার ছেলেরা ছিল রাজাকার। সাতজনের একটা গ্রুপ করে আমাদের পাঠানো হলো। আমাদের প্রথম উদ্দেশ্য ছিল তাদের হত্যা করা। আমরা তা-ই করেছিলাম। হিলি সীমান্ত থেকে একটু দক্ষিণের ছায়া ঢাকা জায়গা দিয়ে আমরা বাংলাদেশে ঢুকি। কিছুদূর এসে দেখি পাকিস্তানি বাহিনী সীমান্তের দিকে এগোচ্ছে। আমরা লুকানোর স্থান খুঁজে পাচ্ছিলাম না। আমাদের অস্ত্র দিয়ে সম্মুখযুদ্ধ করাও সম্ভব ছিল না। এমন সময় দেখি একটি ছনের ঘর। তাড়াতাড়ি সেখানে গিয়ে ঢুকলাম। সেখানে ছিলেন একজন অন্ধ মহিলা। উনি বললেন, তোমরা কি মুক্তিযোদ্ধা? আমরা বললাম, জি, মা। বৃদ্ধ মা আমাদের চৌকির নিচে যেতে বলে একটি কোরআন শরিফ নিয়ে দরজায় পাটি বিছিয়ে পড়তে থাকলেন।

পাকিস্তানি বাহিনীর কিছু সৈনিক প্রতিটি ঘরে ঢুকে চেক করতে লাগল। কিন্তু বৃদ্ধ মহিলার ঘরটিতে আর ঢুকল না। পাকিস্তানি বাহিনী অনেক দূরে চলে গেলে বুড়িমা বললেন, ‘বাবারা, তোমরা কাছে এসো।’ আমরা বুড়িমার পা ধরে কান্না শুরু করলাম। সম্মানের সঙ্গে তাঁকে সালাম করলাম। ওই বৃদ্ধ মা সাতজন মুক্তিযোদ্ধার জীবন রক্ষাকারী। সেদিন তাঁর নাম-ঠিকানা না রেখে কী যে ভুল করেছিলাম! আল্লাহ যেন ওই মাকে বেহেশতবাসী করেন।

জায়গাটি ছেড়ে আমরা লক্ষ্যস্থলের দিকে চলে যাই। এরপর থেকে শুরু হয় পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর হালকা আক্রমণ। বগুড়ার জেলেপাড়া থেকে সাতগ্রাম পাকা রাস্তায় পাকিস্তানি বাহিনী টহল দেওয়ার সময় আমরা দূর থেকে তাদের ওপর এসএলআর-এলএমজি দিয়ে গুলিবর্ষণ করি। পাকিস্তানি বাহিনী রাস্তার ডানে-বাঁয়ে পালাতে থাকে। বগুড়া থেকে আরও পাঁচ-ছয় ট্রাক পাকিস্তানি সেনা ওই এলাকায় এসে বাড়িঘর সব তছনছ করে দেয়। তখন থেকে আমরা যুদ্ধের নিয়ম কিছুটা পরিবর্তন করি। এরপর থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর ছোট ছোট ক্যাম্পের ওপর অতর্কিতে হামলা চালাতে থাকি। এভাবেই চলে ৯টি মাস।

(বর্ণনাকারী নূর মোহাম্মদ, গ্রাম: কেন্দুয়া, জামালপুর; সম্পর্কে সংগ্রহকারীর বাবা)

সূত্র: ছাত্রছাত্রীদের সংগৃহীত মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শী—ভাষ্য, তৃতীয় পর্ব, সম্পাদনা: মফিদুল হক, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর