মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখা

মুক্তিযুদ্ধে সাংবাদিকেরা আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন

অধ্যাপক রেহমান সোবহান
অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহানের আত্মজীবনী উতল রোমন্থন: পূর্ণতার সেই বছরগুলো। এতে উঠে এসেছে পূর্ব পাকিস্তান থেকে স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ হয়ে ওঠার ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহ। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে বইটি থেকে নির্বাচিত কিছু অংশ ধারাবাহিকভাবে ছাপা হচ্ছে। আজ পঞ্চম কিস্তি

পেছন ফিরে দেখলে মনে হয় বাংলাদেশের গল্পের সবচেয়ে বড় বিশেষত্ব ছিল জীবনে বহু ঘটনাপ্রবাহ দেখে কঠিন হয়ে যাওয়া এসব সাংবাদিকের অনেকে ঢাকায় শুধু খবরের গল্প খোঁজার সীমা পেরিয়ে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে আবেগতাড়িতভাবে যুক্ত হয়ে পড়েন। উলাকট, সিডনি শ্যানবার্গ, সেলিগ হ্যারিসন এবং সাইমন ড্রিংয়ের মতো পোড়খাওয়া সাংবাদিকেরা পেশাগত কর্তব্যের চাহিদার বাইরে গিয়ে তাঁদের পাঠকদের কাছে বাঙালিদের লড়াই তুলে ধরেছেন। লন্ডনে নিকোলাস টমালিনের সম্পর্কে একটা গল্প শুনেছিলাম। আমি যখন কেমব্রিজে ঢুকি, টমালিন তখন ট্রিনিটি হলের এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। পরে তিনি দ্য সানডে টাইমস-এর নামী সাংবাদিক হন এবং ভিয়েতনাম যুদ্ধের খবর করে খ্যাতি অর্জন করেন। বাংলাদেশের বিষয়ে কেমব্রিজে আয়োজিত একটা ঘরোয়া আলোচনায় ভাষণ দিতে গিয়ে টমালিন শ্রোতাদের বলেন যে ভিয়েতনাম যুদ্ধসহ তিনি বহু বড় রাজনৈতিক প্রতিবেদন লিখেছেন, কিন্তু কোনোটাই তাঁকে এতটা আবেগে জড়ায়নি, যেমনটি জড়িয়েছে বাংলাদেশের ঘটনাপ্রবাহ।

এই সাংবাদিকদের অনেকেই আমাকে তাঁদের পত্রিকায় কলাম প্রকাশের তাৎক্ষণিক প্রবেশাধিকার দিয়েছিলেন যখন আমি লন্ডন, নিউইয়র্ক এবং ওয়াশিংটনে আমাদের স্বাধীনতার পক্ষে প্রচার চালাচ্ছিলাম। ফলে আমি বাংলাদেশের যুদ্ধ সম্পর্কে দ্য টাইমস, দ্য গার্ডিয়ান এবং লন্ডনে নিউ স্টেটসম্যান এবং যুক্তরাষ্ট্রে দ্য নিউ রিপাবলিক এবং দ্য নেশন-এর মতো সংবাদপত্রে কলাম লিখে বিশ্ববাসীকে আমাদের কথা জানাতে পেরেছিলাম। প্রতিদান হিসেবে তাদের মধ্যে কেউ পাকিস্তানি শাসক শ্রেণিতে কী হচ্ছে, সেটা জানতে আমাদের মূল্যবান তথ্যসূত্র হিসেবে কাজ করেছিল। কামাল হোসেনের বাড়িতে মার্চ ১৯৭১-এ চা খেতে গিয়ে পিটার হ্যাজেলহার্স্ট জানিয়েছিলেন যে সম্প্রতি তিনি লারকানায় ভুট্টোর একটা সাক্ষাৎকার নিয়েছেন, যাতে ভুট্টো খুব অবজ্ঞাভরে তাঁকে বলেন বাংলাদেশের এই আন্দোলন হচ্ছে চায়ের কাপে তুফান, যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন শহরকেন্দ্রিক রাজনীতিকেরা, সশস্ত্র সংগ্রামের কিছুই যাঁরা জানেন না।

সামরিক বাহিনীর এক ঝলক ছররা যাতে ঢাকার কিছু বিক্ষোভকারী মারা যাবে, বাকিরা ভয় পাবে এবং বহু নেতাকে জেলে ভরা হবে। তার ফলে বিক্ষোভের বেগ কমবে এবং আরও যুক্তিপূর্ণ আপস আলোচনার আবহ তৈরি হবে। ভবিষ্যদ্বাণীর মতো এ ধরনের বিচক্ষণতা হয়তো লারকানা বৈঠকে ইয়াহিয়াকে ভাগ দিয়ে থাকবেন ভুট্টো; কারণ, এই ভ্রান্ত ধারণা থেকেই হয়তো ২৫ মার্চ ১৯৭১ সামরিক বাহিনীর অ্যাডভেঞ্চারের সূত্রপাত।

এই সময় নুরুল ইসলামের ধানমন্ডির বাসা, যেটা সে সময় বিদ্রোহী সরকারের সচিবালয় এবং সেই সঙ্গে মিডিয়া কেন্দ্র হিসেবে খ্যাতি কুড়িয়েছিল, সেটাকে ষড়যন্ত্রের আখড়া ভাবত সামরিক গোয়েন্দা বাহিনী। এর কারণ ছিল, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কর্নেল ইয়াসিন এবং এস হুদা যিনি তখন টেলিফোন অ্যান্ড টেলিগ্রাফ (টিঅ্যান্ডটি) বিভাগে কাজ করেন, নুরুল ইসলামের এই দুই আত্মীয়ের এই বাড়িতে নিয়মিত যাতায়াত ছিল। ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর সরবরাহের দায়িত্বে ছিলেন কর্নেল ইয়াসিন—খাদ্য সরবরাহকারীদের তালিকা তিনি তৈরি করতেন। এই তালিকা আমরা আওয়ামী লীগ নেতৃত্বকে দিতাম, যারা তাদের কর্মীদের নির্দেশ দিত ওই সব সরবরাহকারীর কাছে গিয়ে ক্যান্টনমেন্টে খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করার জন্য বোঝাতে। এই কৌশল খুব কাজে দিয়েছিল। খাদিম হোসেন রাজা তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, মার্চ মাসে টাটকা খাবারের জোগান সম্পূর্ণ ব্যাহত হওয়ার কারণে ক্যান্টনমেন্টের বাসিন্দারা খুব অসুবিধায় পড়ে।

এ ধরনের কার্যক্রমের দুর্ভাগ্যজনক পরিণতি হয়। ২৫ মার্চ সেনাবাহিনীর আক্রমণের পর কর্নেল ইয়াসিন এবং হুদা দুজনকেই গ্রেপ্তার করে সামরিক বাহিনী। হুদাকে ঢাকায় আটকে রেখে জেরা করা হয় এবং তাঁকে দিয়ে বাধ্যতামূলক স্বীকারোক্তি করানো হয় যে তিনি নুরুল ইসলাম এবং আমার সঙ্গে একযোগে আওয়ামী লীগের হয়ে ভারতের সঙ্গে টেলিযোগাযোগের ষড়যন্ত্র করেন। সম্পূর্ণ বানানো এই অভিযোগ পরে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে আনা ষড়যন্ত্রের চার্জশিটে যুক্ত হয়েছিল ১৯৭১ সালে, যে কারণে তাঁর বিচার হয়। কর্নেল ইয়াসিনের কপালে আরও দুর্ভোগ জোটে। তাঁকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, তবে লাহোর নিয়ে যাওয়া হয় শারীরিক নির্যাতন করে জেরা করার জন্য। উদ্দেশ্য ছিল বঙ্গবন্ধু এবং ব্রিগেডিয়ার মজুমদার, যিনি ২৫ মার্চের আগে চট্টগ্রামের ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারের কমান্ড্যান্ট ছিলেন—এই দুজনের বিচারে তাঁকে মিথ্যা সাক্ষী হিসেবে দাঁড় করানো। এর জন্য লাহোরে নির্যাতন করে আলাদা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল কর্নেল ইয়াসিনকে (সাংবাদিক রুহুল মতিনের সঙ্গে ব্রিগেডিয়ার মজুমদারের সাক্ষাৎকার, ১৯৯৯)।

সেই সময় হরতালের জন্য যখন বেশির ভাগ যান চলাচল বাতিল হয়েছিল, আমি আমার ভক্স ওয়াগন চালিয়ে স্বাধীনভাবে ঘোরাঘুরি করতে পারতাম কারণ, ফোরামের সম্পাদক হওয়ার সুবাদে আমার গাড়িতে সুবিধাপ্রাপ্ত সাংবাদিকের স্টিকার লাগানো ছিল। ফলে একজন পার্টটাইম অর্থনৈতিক প্রশাসক এবং ফুলটাইম সম্পাদক ও পাশাপাশি ফোরামের মাঠ সাংবাদিক ও উপসম্পাদকীয় লেখক—এভাবে আমার দিন ভাগ করে নিতাম। হামিদা এবং আমি দুজনে মিলে সেনাবাহিনীর নির্যাতন শুরুর সময় পর্যন্ত জার্নালের কিছু ক্ষুরধার সংস্করণ প্রকাশ করি।

নিরবচ্ছিন্ন হরতালের জন্য সেই দিনগুলোতে বস্তুত কেউ কাজ করত না। বেশির ভাগ সময় ব্যয় হতো প্রতিবেশীদের সঙ্গে সাদামাটা দেখা–সাক্ষাতে, সবাই যেখানে আসন্ন বিপদ নিয়ে জল্পনা করত। মার্চের প্রথম দিকে এই উৎকণ্ঠা, বিশেষ করে গুলশান-বনানীর অবাঙালি ও অভিজাত বাঙালিদের মধ্যে নিষ্ক্রিয় থেকেছে, যেহেতু বাংলাদেশের অধিকাংশ এলাকাই অত্যন্ত শান্ত ছিল। অবাঙালিরা ততটা আশ্বস্ত ছিল না, তারা তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত ছিল। বাড়িতে আমাদের বিশেষ চিন্তা ছিল সালমার ছোট বোন নাজ, তার স্বামী এস এম আশরাফ এবং তাদের সদ্যোজাত কন্যা আমিনাকে নিয়ে। ১৯৫০-এর দশক থেকে আশরাফ কানাডার নাগরিক। সেখানে সে সরকারি কর্মী ছিল। ঢাকায় এক বিদেশি সংস্থার সিনিয়র এক্সিকিউটিভের চাকরি জোগাড় করে নাজ এবং তার সদ্যোজাত মেয়েকে নিয়ে অক্টোবর ১৯৭০-এ ঢাকায় চলে আসে আশরাফ।

১ মার্চের পর পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন আশরাফ পরিবারের মানসিক ধাক্কার কারণ হয়েছিল। স্বভাবসুলভভাবে দারুণ রসিক আশরাফ বুঝতে পারে, পরিস্থিতি মোটেই স্বস্তিকর নয়। মার্চ মাসে সংকট ঘনীভূত হলে এবং সম্ভাব্য যুদ্ধের আশঙ্কা দেখা দেওয়ায় বিদেশি নাগরিকদের ঢাকা থেকে দেশে ফিরিয়ে নিতে থাকে তাদের সংশ্লিষ্ট দূতাবাসগুলো। ঢাকার কানাডিয়ান দূতাবাসের সৌজন্যে আশরাফ ব্যাংকক হয়ে করাচিতে নিজের ও তাঁর পরিবারের প্রত্যাবাসনের ব্যবস্থা করতে পেরেছিল। আশরাফের সুন্দর রসবোধ একেবারে হারিয়ে যায়নি। সে দেশলাই জ্বালানো প্রত্যক্ষ করেছিল, এরপর অগ্নিকাণ্ডের শেষ পর্যায়ে করাচিতে ভারতীয় বিমানবাহিনী বোমাবর্ষণের সময় বন্ধুমহলে ঠাট্টা করে বলত, ‘আমিই বেগম ইকরামুল্লাহর একমাত্র ভালো জামাই; প্রিন্স হাসান তো আইনের ঊর্ধ্বে, আর রেহমান সোবহান আইনের চোখে অপরাধী।’

স্বাধীনতার প্রস্তুতি: মার্চ ১৯৭১। দেশী বিদেশী সাংবাদিকরা খবর সংগ্রহ করছেন

যতক্ষণ বাংলাদেশজুড়ে সক্রিয় কর্তৃত্ব চালিয়েছেন বঙ্গবন্ধু, আইনশৃঙ্খলা জারি রেখেছে হয় আওয়ামী লীগ কর্মীরা অথবা সাধারণ নাগরিকদের দল। সাধারণ মানুষ নিজেরাই সাড়া দিয়ে ব্যাপারটাকে সহজতর করেছিল। দেখা গেল তারা অনেক বেশি আইন মেনে চলছে। মাঝেমধ্যে অবাঙালিদের ওপর আক্রমণের খবর এসেছে, বিশেষ করে চট্টগ্রামে। কিন্তু এ ধরনের ঘটনা কম ঘটেছে, যেগুলোকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পরে অতিরঞ্জিত করেছিল তাদের পরবর্তী বাঙালি নিধন সমর্থনে।

অবাঙালিদের দুর্দশার মাত্রা যা–ই হয়ে থাক, তাদের মধ্যে সচ্ছলদের পশ্চিম পাকিস্তানে দলবদ্ধ প্রস্থান লক্ষ করা গেল ১ মার্চের পর। একটা সময় আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব আশঙ্কিত হয়ে পড়েছিল যে ঢাকা ছেড়ে যাওয়া কিছু অবাঙালি তাদের অস্থাবর সম্পদ, টাকাপয়সা এবং সোনাদানা নিয়ে পালাচ্ছে। অনুমোদন ছাড়াই কিছু আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছাসেবী যেসব গাড়ি বিমানবন্দরগামী মনে হয়েছে তাদের থামিয়ে তল্লাশি করেছে। আওয়ামী লীগ প্রশাসন এ ধরনের কাজ নিরুৎসাহিত করে আদেশ জারি করতে বাধ্য হয়, যেহেতু এগুলো আতঙ্ক ছড়াচ্ছিল এবং অবাঙালিদের আরও বিচ্ছিন্ন করছিল। যারা বাংলা বলতে পারে না, তাদের বিরুদ্ধে হিংসাত্মক ঘটনার গুজব অবাঙালিদের আতঙ্ক বাড়িয়ে দিয়েছিল।

খবর ছিল যে বিভিন্ন ছাত্রগোষ্ঠী সামরিক প্রশিক্ষণ নিচ্ছে, কিন্তু দেখা গেল ছাত্ররা কেবল কাঠের রাইফেল নিয়ে সামরিক কুচকাওয়াজ করছে। আমরা শুনেছিলাম, কিছু থ্রি নট থ্রি রাইফেল অফিসের সশস্ত্র প্রহরীদের থেকে চুরি হয়েছে সম্ভাব্য যুদ্ধের জন্য এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিস্ট্রি ল্যাবরেটরি থেকে রাসায়নিক চুরি করা হচ্ছে বিস্ফোরক তৈরি করার জন্য। আমাদের যুবকদের এই অপেশাদারি প্রচেষ্টা অবশ্য এমন কোনো আস্থা তৈরি করেনি যে আমরা সশস্ত্র লড়াইয়ের জন্য বিন্দুমাত্র প্রস্তুত হয়েছি।

আমাদের সংস্কৃতি এবং ইতিহাসের প্রতীকের সঙ্গে সংগতি রেখে আমাদের সহকর্মী আনিসুর রহমান শিল্পী কামরুল হাসানের সঙ্গে তার বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাপার্টমেন্টে সংস্কৃতিকর্মীদের সভা আয়োজন করে গণসংগীতের সেশন করে এই গোষ্ঠীর মনোবল বজায় রাখতে। আনিস ঠিকই আশঙ্কা করেছিল যে গণহত্যা আসন্ন, এবং সে তার বিদেশি শিক্ষাবিদ বন্ধুদের চিঠি লেখে, এ রকম একটা ঘটনার বিরুদ্ধে তাদের নিজ নিজ দেশে জনমত গড়ে তোলার জন্য বিশ্বজুড়ে প্রচার শুরুর আবেদন জানিয়ে।

মার্চের মাঝামাঝি সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধানের একটা সম্ভাবনা তৈরি করে ইয়াহিয়ার ঢাকা সফর। মুজিবের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান চায় বলে তিনি দাবি করেন। কয়েক দিন পর ভুট্টোও ঢাকায় আসেন এই আলোচনায় অংশ নিতে, যদিও কারও কারও ধারণা, তাঁর ঢাকা আগমনের উদ্দেশ্য ছিল মুজিব ও ইয়াহিয়ার মধ্যে যেকোনো দ্বিপক্ষীয় সমাধানের সম্ভাবনা বানচাল করা।

UNTRANQUIL RECOLLECTIONS: The Years of Fulfilment

বাংলা অনুবাদ—উতল রোমন্থন: পূর্ণতার সেই বছরগুলো। সেজ পাবলিকেশন, ভারত। ২০১৮