মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখা

পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মম নিষ্ঠুরতা

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের উদ্যোগে বিভিন্ন অঞ্চলের স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীরা সংগ্রহ করেছিল মুক্তিযুদ্ধের গল্প। তাদের সংগ্রহ করা ও লেখায় মুক্তিযুদ্ধের সেসব না–জানা গল্প।

পাকিস্তানি গণহত্যার স্বাক্ষর

ঘটনা ১: আমি একদিন কাজ করে বাড়িতে ফেরার পথে দেখলাম, একজন লোক নৌকা বেঁধে রেখে বটবৃক্ষের নিচে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। হঠাৎ পাকিস্তানি বাহিনী ঠকঠক জুতা পায়ে এসে তাদের গাছের সঙ্গে বেঁধে, হাত উঁচু করে নির্মমভাবে গুলি করে মেরে ফেলল। আমি পাকিস্তানি বাহিনীকে দেখে পাশে বেতঝোপে লুকিয়ে রইলাম। তা না হলে মাঝির মতো হয়তো আমাকেও জীবন দিতে হতো। আমি সবই নীরবে চেয়ে চেয়ে দেখলাম। পাকিস্তানি বাহিনী চলে গেলে আমি বাড়িতে ফিরে আসি।

ঘটনা ২: আমি, তাহের, আলালদ্দি ও আলী—আমরা চারজন মিলে একসঙ্গে রিকশা চালাতাম। যুদ্ধ শুরু হওয়ায় আমরা পালিয়ে পালিয়ে থাকতাম। পাশের জঙ্গলে আমরা রিকশা রেখেছিলাম। হঠাৎ করে একসময় গাড়িতে করে পাকিস্তানি বাহিনী এসে পড়ে। আমরা চারজন পাশের জঙ্গলে লুকিয়ে সবকিছু দেখছিলাম। পাকিস্তানি বাহিনী এসে মেশিনগান ইত্যাদি ধরনের অস্ত্র চালাতে শুরু করল।

আমরা সব সময়ই ভাবতাম পাকিস্তানি বাহিনী কখনো কাঁচামাটিতে নামে না। তারপর পাকিস্তানি বাহিনী গাড়ি থেকে নেমে এসে মানুষের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিতে শুরু করে। এমন অবস্থা দেখে আলালদ্দি খুব চিন্তিত হলো। কারণ, তার ঘরে ট্রাংকের ভেতর ছিল বেশ কিছু টাকা। এমন অবস্থায় তার ঘরে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। এই ভেবে আলালদ্দি জঙ্গল থেকে বের হয়ে ঘরের পেছন দিয়ে আস্তে আস্তে ঘরের দরজার কাছে পৌঁছাল। এমন সময় পাকিস্তানি বাহিনী তাকে দেখে ফেলে। দেখামাত্র তাকে বলে, ‘দাঁড়া’। আলালদ্দি তার জীবন বাঁচানোর জন্য দৌড় দিল। পাকিস্তানি বাহিনী মেশিনগান দিয়ে মাথায় গুলিবিদ্ধ করে।

তখনো তার জ্ঞান ছিল। কোমর থেকে গামছা খুলে সে মাথায় বাঁধে। আলালদ্দি পাখির মতো লাফাতে লাফাতে পালানোর চেষ্টা করছিল। তখন পাকিস্তানি বাহিনী বলল, ‘বাঙালি মরতে নেহি।’ মেশিনগান দিয়ে তার বুকে আরেকটা গুলি করে। তারপরও সে মারা যায়নি, গড়াগড়ি দিতে শুরু করেছে। নিষ্ঠুর পাকিস্তানি বাহিনী তারপরও তার বুকে আরেকটি গুলি করে। গরু জবাই করলে যেমনভাবে রক্ত ছিটকে পড়ে, ঠিক তেমনিভাবে রক্ত বের হয় তার মাথা ও বুক থেকে। লাফাতে লাফাতে একসময় সে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল।

পাকিস্তানি বাহিনীর তারপরও সন্দেহ হচ্ছিল। এরপর আলালদ্দির লাশের কাছে পাকিস্তানি বাহিনী দেখতে গেল সে মরেছে নাকি জীবিত আছে। যখন দেখল যে আলালদ্দি মৃত্যুবরণ করেছে, তখন লাশে লাথি মেরে নিষ্ঠুর পাকিস্তানি বাহিনী চলে গেল।

তারপর আমি, তাহের ও আলী তিনজন মিলে আলালদ্দির লাশ উদ্ধার করি। নিষ্ঠুর পাকিস্তানি বাহিনীর উদ্দেশ্য ছিল এ দেশকে ধ্বংস করা, লন্ডভন্ড করে দেওয়া।

(বর্ণনাকারী: রতিকান্ত হালদার, গ্রাম: আঁধাকোঠা, ফরিদপুর; সম্পর্কে লেখকের দাদু)

সূত্র: ছাত্রছাত্রীদের সংগৃহীত মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শী-ভাষ্য, প্রথম পর্ব, সম্পাদনা: মফিদুল হক, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, জুন ২০১২