মুক্তিবাহিনী
বাহিনী পরিচিতি
বিমানবাহিনী
২৮ সেপ্টেম্বর ভারতের ডিমাপুরে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী জন্মলাভ করে। ৯ জন বৈমানিক এবং ৫৭ জন বিমান ক্রুর সমন্বয়ে গড়ে ওঠে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর কিলো ফ্লাইট। বাংলাদেশ বিমানবাহিনীতে একটি হেলিকপ্টার, একটি যুদ্ধবিমান ও একটি পরিবহন বিমান ছিল। মুক্তিযুদ্ধে তারা প্রায় ৩৬টি অভিযান পরিচালনা করেন। বিমানবাহিনীর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি অভিযান হলো চট্টগ্রাম তেল শোধনাগার ও নারায়ণগঞ্জ তৈলাধার ধ্বংস ও কুশিয়ারা নদীতে শত্রু নৌযান ধ্বংস।
নৌবাহিনী
১০ নভেম্বর ৪৭ জন নৌসেনা নিয়ে বাংলাদেশ নৌবাহিনী গঠিত হয়। এই বাহিনীতে দুটি গানবোট—পদ্মা ও পলাশ ছিল। পদ্মা ও পলাশ চালনা-মংলা এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে। তাদের অভিযানে পাকিস্তানের কয়েকটি জাহাজ ধ্বংস হয় এবং মংলা বন্দর অকার্যকর হয়ে যায়। এ ছাড়া পাকিস্তানিদের জন্য সাহায্যসামগ্রী নিয়ে আসা জাহাজসহ কয়েকটি বিদেশি জাহাজকে গন্তব্য পরিবর্তন করে কলকাতা বা অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য করে।
নৌ কমান্ডো
ভারতীয় বাহিনীর তত্ত্বাবধানে প্রায় ৫০০ মুক্তিযোদ্ধাকে প্রশিক্ষণ দিয়ে নৌ কমান্ডো দল গঠন করা হয়। পশ্চিমবঙ্গের পলাশীসংলগ্ন ভাগীরথী নদীতে তাঁদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। আগস্ট মাস থেকে নৌ কমান্ডোদের অভিযান শুরু হয়। তারা চট্টগ্রাম, মংলা, নারায়ণগঞ্জ, দাউদকান্দি ও চাঁদপুর বন্দরসহ বিভিন্ন বন্দরে অভিযান পরিচালনা করেন। তাঁদের অভিযানে পাকিস্তানি বাহিনীর ছোট–বড় ২৩টি নৌযান এবং প্রায় ২০ হাজার টন সম্ভার ধ্বংস হয়।
মুজিব বাহিনী
আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের কর্মীদের নিয়ে মুজিব বাহিনী গঠন করা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে এর নামকরণ করা হয়। এই বাহিনীকে বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স বা সংক্ষেপে বিএলএফ বলা হতো। এই বাহিনী গঠনের পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল। ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল উবানের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে মুজিব বাহিনীর প্রায় ১০ হাজার সদস্যকে দেরাদুনে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। শেখ ফজলুল হক মনি, তোফায়েল আহমদ, সিরাজুল আলম খান ও আবদুর রাজ্জাক এই বাহিনীর যৌথ অধিনায়ক ছিলেন। তাঁরা পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গন এবং ঢাকার আশপাশে বেশ কিছু অভিযান পরিচালনা করে।
কাদেরিয়া বাহিনী
আনোয়ারুল আলম শহীদ, আবদুল লতিফ সিদ্দিকী ও আবদুল কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তমের নেতৃত্বে টাঙ্গাইলে এই বাহিনী সংগঠিত হয়। কাদের সিদ্দিকী মুক্তিযুদ্ধের আগে কিছু দিন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন। এই বাহিনীর বেসামরিক প্রধান ছিলেন আনোয়ারুল আলম শহীদ এবং সামরিক প্রধান ছিলেন আবদুল কাদের সিদ্দিকী। পরবর্তী সময়ে এই বাহিনী কাদেরিয়া বাহিনী নামে পরিচিতি পায়। বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ছিল প্রায় ১৭ হাজার। টাঙ্গাইল ও আশপাশের ১ হাজার ৫০০ বর্গকিলোমিটার এলাকায় তাঁরা অভিযান পরিচালনা করত। কাদেরিয়া বাহিনী প্রায় ৭৩টি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। তাদের উল্লেখ্যযোগ্য যুদ্ধ হলো মাটিকাটা যুদ্ধ, পাথরঘাটা যুদ্ধ, মাকরাই যুদ্ধ, ধলাপাড়া যুদ্ধ ও কাস্তার যুদ্ধ।
হেমায়েত বাহিনী
হাবিলদার হেমায়েত উদ্দিনের নাম অনুসারে হেমায়েত বাহিনীর নামকরণ করা হয়। তিনি মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে জয়দেবপুরে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে কর্মরত ছিলেন। তাঁর রেজিমেন্টে বিদ্রোহ করলে তিনি কিছু বাঙালি সেনা নিয়ে ফরিদপুরে চলে যান। ২৯ মে হেমায়েত বাহিনীর যাত্রা শুরু হয়। হেমায়েত বাহিনীতে পাঁচ হাজার মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। এই বাহিনী গোপালগঞ্জ, বরিশাল, ফরিদপুর, মাদারীপুর এবং যশোরের কিছু অংশে যুদ্ধ পরিচালনা করে। এই বাহিনীর উল্লেখযোগ্য যুদ্ধ ছিল কোটালীপাড়া থানা আক্রমণ, যশোরের গুদাম আক্রমণ, কুরপাড়া কমিউনিটি সেন্টার যুদ্ধ, গোপালগঞ্জ মাদ্রাসা যুদ্ধ।
লতিফ বাহিনী
মির্জা আবদুল লতিফ ছিলেন লতিফ বাহিনীর প্রধান। তিনি রাজনৈতিক কর্মী ছিলেন। লতিফ বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ছিল ৮ থেকে ১০ হাজার। এই বাহিনী বগুড়া, নাটোর, রাজশাহী, পাবনা, সিরাজগঞ্জে অভিযান পরিচালনা করে। এই বাহিনীর উল্লেখযোগ্য যুদ্ধ হচ্ছে কাশিনাথপুর ডাববাগান যুদ্ধ, ঘাটনা যুদ্ধ, তাড়াশ যুদ্ধ, সাঁথিয়া এবং গুরুদাসপুর থানা আক্রমণ।
আফসার ব্যাটালিয়ন
ল্যান্স নায়েক আফসার উদ্দিন ছিলেন আফসার ব্যাটালিয়নের প্রধান। আফসার উদ্দিন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন। তিনি ময়মনসিংহের ভালুকা থানার মল্লিকাবাড়ী গ্রাম থেকে মুক্তিযুদ্ধ শুরু করেন। এই বাহিনীতে ৪ হাজার ৫০০ মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। ময়মনসিংহ জেলার দক্ষিণ অংশ, ঢাকা এবং গাজীপুর জেলার কিছু অংশে আফসার ব্যাটালিয়ন তাদের অভিযান পরিচালনা করত। এই বাহিনীর উল্লেখযোগ্য যুদ্ধ ছিল ভালুকা যুদ্ধ, গফরগাঁও যুদ্ধ, ত্রিশাল যুদ্ধ, শ্রীপুর যুদ্ধ, মির্জাপুর যুদ্ধ ও মুক্তাগাছা যুদ্ধ।
হালিম বাহিনী
ক্যাপ্টেন আবদুল হালিম চৌধুরী ছিলেন হালিম বাহিনীর প্রধান। তিনি মুক্তিযুদ্ধের আগে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি ৩৬টি ৩০৩ রাইফেল জোগাড় করে নিজ গ্রামে চলে যান এবং ছাত্র ও তরুণদের যুদ্ধের জন্য সংগঠিত করেন। তাদের যুদ্ধের সীমানা ছিল মানিকগঞ্জের উপকণ্ঠ, মুন্সিগঞ্জ এবং ঢাকা। তাদের উল্লেখযোগ্য যুদ্ধের মধ্যে সুতালক্ষ্মী গ্রামের প্রতিরোধ, গুলাইডানাগা যুদ্ধ, পাটুরিয়া থানা অ্যামবুশ, সেওতা ব্রিজ, বায়নলিপুর আক্রমণ এবং মানিকগঞ্জ জেলা আক্রমণ অন্যতম।
আকবর বাহিনী
১৯৭১ সালে আকবর বাহিনীর প্রধান আকবর হোসেন মিয়া মাগুরার শ্রীপুর থানার শ্রীপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করে ৮০০ মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে আকবর বাহিনী গঠন করেন। এই বাহিনী মাগুরা এলাকায় যুদ্ধ পরিচালনা করে। এই বাহিনীর উল্লেখযোগ্য যুদ্ধ ছিল আক্কেলপুর ও শ্রীপুরের যুদ্ধ, ঈশাখাদা রাজাকার ক্যাম্প ও মাগুরা আনসার ক্যাম্প আক্রমণ এবং মাগুরা যুদ্ধ।
বাতেন বাহিনী
কাদেরিয়া বাহিনী থেকে আলাদা হয়ে খন্দকার আবদুল বাতেন চৌধুরীর নেতৃত্বে দক্ষিণ টাঙ্গাইলে বাতেন বাহিনী গঠিত হয়। বাতেন বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ছিল ৩ হাজার ৫০। তাঁদের যুদ্ধক্ষেত্র ছিল দক্ষিণ টাঙ্গাইল, ঢাকা, গাজীপুর, মানিকগঞ্জ এবং পাবনা ও সিরাজগঞ্জ এলাকাজুড়ে। এই বাহিনীর উল্লেখযোগ্য যুদ্ধ ছিল দৌলতপুর থানা, চৌহানি থানা ও ঘিওর থানা আক্রমণ এবং মির্জাপুরের ধল্লা সেতুর যুদ্ধ।
কুদ্দুস বাহিনী
কুদ্দুস বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন আবদুল কুদ্দুস। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর আবদুল কুদ্দুস
কিছু অবসরপ্রাপ্ত সামরিক সদস্য এবং কিছু স্থানীয় ব্যক্তিকে নিয়ে বরিশালের মুলাদীতে কুদ্দুস বাহিনী গঠন করেন। এই বাহিনী মেহেন্দীগঞ্জ, মুলাদী, হিজলা এবং বৃহত্তর বরিশালের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান পরিচালনা করেন।
গফুর বাহিনী
মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই গফুর বাহিনী গঠিত হয়। আবদুর গফুর, মহিউদ্দিন মানিক এবং বেনিলাল দাশগুপ্ত পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে বরিশালের দক্ষিণাঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করেন। ধীরে ধীরে বাহিনীর নাম হয়ে যায় গফুর বাহিনী। এই বাহিনী বানারীপাড়া, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, স্বরূপকাঠি এবং আশপাশের অঞ্চলে তাদের অপারেশন সীমাবদ্ধ রাখেন। দেশের দক্ষিণে একটি সাব–সেক্টর গঠিত হলে এই বাহিনী ক্যাপ্টেন শাহজাহানের সঙ্গে এক হয়ে যায়। এই বাহিনী মুজিব বাহিনীর সঙ্গেও বেশ কিছু অপারেশন করে।
ন্যাপ–সিপিবি–ছাত্র ইউনিয়ন গেরিলা বাহিনী
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ছাত্র ইউনিয়নের (মতিয়া) কর্মীরা ত্রিপুরার আগরতলায় প্রশিক্ষণশিবির প্রতিষ্ঠা করেন। এই শিবিরে তাঁদের সঙ্গে ন্যাশনাল আওয়ামী লীগ (মোজাফ্ফর) ও কমিউনিস্ট পার্টির কর্মীরাও প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। নভেম্বর মাস পর্যন্ত এই শিবিরে কয়েক হাজার মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
সূত্র: 1971 Resistance, Resilience and Redemption, Major General Md Sarwar Hossain, Bangla Academy. বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস ১৮৩০ থেকে ১৯৭১, ড. মোহাম্মদ হাননান, আগামী প্রকাশনী; মুক্তিযুদ্ধে হেমায়েত বাহিনী, লেফটেন্যান্ট কর্নেল এস আই এম নূরুন্নবী খান বীর বিক্রম, কলম্বিয়া প্রকাশনী।
Also Read
-
অভিনেত্রী শমী কায়সার গ্রেপ্তার
-
মার্চ-এপ্রিলে নির্বাচনের দাবিতে কর্মসূচি শুরুর চিন্তা বিএনপির
-
চট্টগ্রামে ফেসবুক পোস্টকে ঘিরে সংঘর্ষ, ফাঁকা গুলি, সাত পুলিশ সদস্য আহত
-
সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা এখনো আক্রমণের মুখে: সম্পাদক পরিষদ
-
প্রাথমিক ভোট গণনার ফল যে কারণে বিভ্রান্তিকর হতে পারে