শহীদ বুদ্ধিজীবী
সিরাজুল হক খান
শহীদ বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক, পরশুরাম, ফেনী, চট্ট্রগ্রাম
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা গবেষণা কেন্দ্রের শিক্ষা প্রশাসন বিভাগের শিক্ষক ছিলেন ড. সিরাজুল হক খান।
স্কুল টেক্সট বুক বোর্ডের অনেক ইংরেজি, বাংলা ও ইতিহাসের পাঠ্যপুস্তক রচনা করেন তিনি। মুক্তবুদ্ধি ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষ ছিলেন।
একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর সকালে তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুলার রোডের ফ্ল্যাট বাসার নিচ থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এদেশীয় দোসর আলবদররা তাঁকে ধরে নিয়ে যায়। এরপর তাঁর আর খোঁজ পাওয়া যায়নি।
এ ঘটনা সম্পর্কে জানা যায় তাঁর বড় ছেলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক এনামুল হক খানের কাছ থেকে।
তিনি বলেন, ‘একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর সকাল ৯টা। বাবা হাতমুখ ধুয়ে নিচতলায় উদ্ভিদবিদ্যার অধ্যাপক ইসমাইল সাহেবের ফ্ল্যাটে যান।
এর কিছুক্ষণ পর কাদা মাখানো লাল রঙের একটি স্টেটবাস আমাদের দালানের সামনে এসে থামে।
সাত-আটজন মুখোশধারী বাস থেকে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হাতে নেমে সোজা চলে আসে চারতলায় আমাদের ফ্ল্যাটে।
দরজাতেই আমার চাচাকে পেয়ে তারা জানতে চায়, ড. সিরাজুল ইসলাম খান কোথায়? চাচা জানান, এ নামের কেউ এ ফ্ল্যাটে থাকেন না।
এরপর তারা জানতে চায়, এ ফ্ল্যাটে আইইআরের কোন শিক্ষক থাকেন? চাচা বলেন, তাঁর নাম সিরাজুল হক খান।
ঘাতকরা তখন বলে, ঠিকই আছে, তাকেই দরকার। তিনি কোথায়? চাচা ঠিক বুঝে উঠতে না পেরে বলেন, উনি নিচতলায় আছেন।
‘তারপর ঘাতকেরা নিচে নেমে যায় এবং রুমাল দিয়ে বাবার চোখ বেঁধে তাঁকে গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে যায়। তাঁর এ যাত্রাই ছিল শেষ যাত্রা।
পরে জানতে পারলাম, বাবার সঙ্গে সেই অভিশপ্ত গাড়িতে সহযাত্রী হিসেবে ছিলেন আমারই শিক্ষক গিয়াসউদ্দিন আহমদ, ড. আবুল খায়ের, সন্তোষ স্যার, ইংরেজির অধ্যাপক রশিদুল হাসান, বাংলার অধ্যাপক আনোয়ার পাশা, বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাক্তার গোলাম মর্তুজা, আইইআরে বাবার সহকর্মী ড. ফয়জুল মহী এবং পাকিস্তানিদের সহযোগী হিসেবে পরিচিত আরবির অধ্যাপক ড. মুস্তাফিজুর রহমানের শ্যালক।
শেষোক্তজন ছিল জামায়াতপন্থী সংবাদপত্র সংগ্রামের কর্মচারী। ঘাতকরা একমাত্র তাঁকেই ছেড়ে দেয়।
সেদিনই বাবার খোঁজ নেওয়ার জন্য আমি তাঁর কাছে যাই। অনেক অনুরোধ ও অনুনয়-বিনয় করেও তাঁর কাছ থেকে কিছু জানতে পারিনি।
‘বাবা ছিলেন প্রচণ্ড নৈতিক মনোবলের অধিকারী। একাত্তরের ২৫ মার্চের রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ প্রত্যক্ষ করে বাসার আমরা সবাই ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ি।
এমন পরিস্থিতিতেও তিনি মনোবল হারাননি। পরে সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের (তখন ইকবাল হল) উত্তর-পূর্ব কোনায় স্তূপীকৃত গুলিবিদ্ধ লাশগুলো দেখিয়ে বাবা আমাদের বলেন, “সশস্ত্র বিপ্লবের ক্ষেত্রে এ রকম হওয়াটাই স্বাভাবিক।
যে লাশের স্তূপ দেখছ, কিছুক্ষণ পর সেখানে হয়তোবা আমি তোমাদের লাশ দেখব। কিংবা তোমাদের আমার লাশ দেখতে হতে পারে।
সাহসের সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করার মানসিক প্রস্তুতি নাও।”’ (সাক্ষাৎকার, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫)।
সিরাজুল হক খানের জন্ম ফেনী জেলা পরশুরাম উপজেলার সাতকুনিয়া গ্রামে। ১৯২৪ সালের ১ জানুয়ারি।
বাবা চাঁদ মিয়া খান, মা ইজ্জাতননেছা। ফুলগাজী হাইস্কুল থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক (১৯৩৯), ফেনী কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে আইএ (১৯৪১), কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিস্টিংশনসহ বিএ (১৯৪৩)।
ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান অর্জন করে বিটি (১৯৪৯), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান পেয়ে এমএড।
পরে যুক্তরাষ্ট্রের নর্দান কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৯ সালে ডক্টরেট অব এডুকেশন ডিগ্রি গ্রহণ।
কর্মজীবনের প্রায় ১৭ বছর বিভিন্ন সরকারি স্কুলে শিক্ষকতা করার পর ১৯৬৮ সালের ১১ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা কেন্দ্রের সহকারী অধ্যাপক নিযুক্ত হন।
সিরাজুল হক খান পাঁচ ছেলে, তিন মেয়ের জনক। ছেলে এনামুল হক খান, একরামুল হক খান (স্থপতি), মাহমুদুল হক খান (প্রকৌশলী), মজিবুল হক খান (ফার্মাসিস্ট) ও মাহবুবুল হক খান (ব্যাংকার)।
মেয়ে সুলতানা খানম (ব্যাংকার), হামিদা খানম (প্রবাসী) ও সেলিনা খানম (প্রবাসী)। স্ত্রী সুরাইয়া খানম।
প্রতিকৃতি: শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক ডাকটিকিট (প্রথম পর্যায়) প্রকাশ উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকা (১৯৯১) থেকে।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
rashedtr@prothom-alo.info
সূত্র: ২০ ফেব্রুয়ারি , ২০১৫ সালে প্রথম আলোতে প্রকাশিত
Also Read
-
রাইসিকে বহনকারী হেলিকপ্টার থেকে সংকেত আসছিল না
-
আজিজ আহমেদের ভাই হারিছ, আনিসের সাজাও মাফ করেছিল সরকার
-
কক্সবাজারে ভোট শেষে চেয়ারম্যান প্রার্থীর সমর্থককে ছুরিকাঘাতে খুন
-
ভারতে নিখোঁজ বাংলাদেশি এমপি আনোয়ারুলের বিষয়ে অন্ধকারে কলকাতা পুলিশ
-
আজিজ আহমেদ বললেন, নিষেধাজ্ঞার ঘটনা সরকারকেও কিছুটা হেয় করে