শহীদ বুদ্ধিজীবী
শহীদ লুৎফুন নাহার হেলেনা
শহীদ বুদ্ধিজীবী, শিক্ষিকা,মাগুরা, খুলনা
একাত্তরের ৫ অক্টোবরের রাত। সেদিন ছিল পবিত্র শবে বরাত। এই রাতে পাকিস্তানি সেনারা অমানবিক ও নির্মম শারীরিক নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করে লুৎফুন নাহার হেলেনাকে।
রাজাকাররা তাঁকে মাগুরা জেলার মহম্মদপুর উপজেলার এক গ্রাম থেকে শিশুপুত্রসহ দিনের বেলা আটক করে।
পরে মাগুরা শহরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করে। হত্যার পর পাকিস্তানি সেনারা তাঁর মরদেহ জিপের পেছনে বেঁধে টেনে নিয়ে যায় শহরের অদূরে নবগঙ্গা নদীর ডাইভারশন ক্যানেলে। ওই ক্যানেলে তাঁর ক্ষতবিক্ষত মরদেহ ফেলে দেয়।
মর্মান্তিক এ ঘটনার বিবরণ পাওয়া যায় তাঁর স্বামী আলী কদরের রচনায়। তিনি লিখেছেন, ‘হেলেনের মৃত্যুঘটনা ছিল করুণ ও মর্মান্তিক।
[...] মহম্মদপুর থানার এক গ্রামে অবস্থানকালে রাজাকার ও ঘাতক দালালদের গুপ্তচরের সহায়তায় হেলেন ২ বছর ৫ মাস বয়স্ক শিশু পুত্র দিলীরসহ রাজাকারদের হাতে ধরা পড়ে গেলে তাকে তারা সরাসরি নিয়ে আসে মাগুরা শহরে।
এরপর পাকিস্থান বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে তাকে সোপর্দ করা হয় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য।
হেলেনের এই দুঃসংবাদে তার বৃদ্ধ পিতা ও কতিপয় আত্মীয়স্বজন দুগ্ধপোষ্য শিশুর মাতা হেলেনের মুক্তির জন্য শত অনুরোধ সত্ত্বেও জামাতপন্থি ঘাতক দালালরা তার মুক্তির ব্যাপারে সব চাইতে বেশি বাধা সৃষ্টি করে।
আলোচনায় পাকবাহিনী কর্মকর্তাকে জানায় যে, হেলেন মাগুরার বামপন্থি নেতা মাহফুজুল হক সাহেবের বোন এবং মহম্মদপুর এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের বাহিনী প্রধান বামপন্থি নেতা আলী কদরের স্ত্রী। সুতরাং তার মুক্তির প্রশ্নই ওঠে না।
‘...হেলেনের মৃত্যু হয় ১৯৭১-এর ৫ অক্টোবর রাত্রিবেলায়। ঐ রাত ছিল সকল মুসলমানদের এক পবিত্র রাত শব-ই-বরাত।
ঐ রাতেই তারা হেলেনের শিশু পুত্র দিলীরের করুণ-কান্নাকে উপেক্ষা করে তাকে মায়ের কোল থেকে বিচ্ছিন্ন করে পাঠিয়ে দেয় নানা বাড়িতে।
তারপর অমানবিক নির্মম শারীরিক নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করে হেলেনকে।’ (স্মৃতিঃ ১৯৭১, অষ্টম খণ্ড, প্রথম প্রকাশ ১৯৯৫, সম্পাদনা রশীদ হায়দার)।
লুৎফুন নাহার হেলেনা হেলেন নামেও পরিচিত ছিলেন।
পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের মাগুরার আঞ্চলিক শাখার নেত্রী এবং মাগুরা কলেজের ছাত্রী সংসদের মহিলা কমনরুম সম্পাদিকা ছিলেন তিনি।
মুক্তিযুদ্ধকালে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাগুরা শহর থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের সহযোগীদের কর্মসূচির সংবাদ জেনে তাঁর মুক্তিযোদ্ধা স্বামীর কাছে পাঠাতেন।
সেপ্টেম্বরে সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধের কাজ করার জন্য মহম্মদপুর এলাকায় যান। সেখানে নারীদের বিশেষত ভূমিহীন গরিব কৃষক পরিবারের নারীদের অনুপ্রাণিত করেন।
পাশাপাশি স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের খাওয়া-দাওয়া, দেখাশোনা ও অসুস্থদের সেবাযত্নে সাহায্য-সহযোগিতা করতেন।
লুৎফুন নাহার হেলেনার জন্ম ১৯৪৭ সালের ২৮ ডিসেম্বর মাগুরা শহরে। বাবা মুহাম্মদ ফজলুল হক। মা মোসাম্মৎ ছফুরা খাতুন।
তাঁরা ছিলেন পাঁচ ভাই ও নয় বোন। বোনদের মধ্যে তিনি ছিলেন ষষ্ঠ। তিনি মেধাবী ছাত্রী ছিলেন। বাবার হাত ধরে পান বই পড়ার অভ্যেস।
পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি নানা ধরনের বই পড়ে তাঁর জ্ঞান ও চেতনার বিকাশ ঘটান তিনি।
১৯৬৮ সালে বিএ পাস করে মাগুরা গার্লস হাইস্কুলে (বর্তমানে সরকারি গার্লস হাইস্কুল) সহকারী শিক্ষিকা হিসেবে যোগ দেন।
শিক্ষকতার পাশাপাশি মাগুরার বাম রাজনীতিতেও তিনি সক্রিয় ছিলেন।
স্কেচ: শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক ডাকটিকিট (চতুর্থ পর্যায়) প্রকাশ উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকা (১৯৯৫) থেকে।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
সূত্র: ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৪ সালে প্রথম আলোতে প্রকাশিত
Also Read
-
স্লোভাকিয়ার প্রধানমন্ত্রীকে হত্যাচেষ্টার পেছনে কি রাজনৈতিক কারণ
-
পাঠ্যবই থেকে আলোচিত ‘শরীফার গল্প’ বাদ দিতে সুপারিশ বিশেষজ্ঞ কমিটির
-
ফোর্বসের এশিয়ার তরুণ উদ্যোক্তাদের তালিকায় ৯ বাংলাদেশি
-
নিবন্ধন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ নারীর লাশ উদ্ধার, অকৃতকার্য স্বামী পলাতক
-
দুবাইয়ে ৫৩২ জন বাংলাদেশির বাড়ি-ফ্ল্যাট আছে