শহীদ বুদ্ধিজীবী

রইচ উদ্দিন শিকদার

শহীদ বুদ্ধিজীবী, চিকিৎসক, কুড়িগ্রাম

রইচ উদ্দিন শিকদার

স্বাধীনতার ৪৮ বছর পর প্রথম আলো পড়ে শহীদ চিকিৎসক রইচ উদ্দিন শিকদারের সমাধি খুঁজে পায় তাঁর পরিবার। কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরীর চণ্ডীপুর এলাকায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে ১৭ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। তাঁদের সঙ্গে সেখানেই সড়কের পাশের বধ্যভূমিতে রইচ উদ্দিন শিকদার শায়িত আছেন।

শহীদ রইচ উদ্দিন শিকদারের মেয়ে রওশন-ই-ফেরদ্দৌস প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্বাধীনতার পর থেকে বাবাকে খুঁজছি। কেউ কোনো সন্ধান দিতে পারছিল না। ২০১৯ সালের ১৫ মার্চ প্রথম আলোর প্রথম পাতায় “শ্রদ্ধা জাগানো নামফলক” শিরোনামে নাগেশ্বরী ভিতরবন্দ স্নাতক মহাবিদ্যালয়ের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী নাজমুন নাহারের একটি লেখা ছাপা হয়। এই লেখা পড়ে আমরা সেখানে ছুটে যাই। নাগেশ্বরীর চণ্ডীপুর এবং দক্ষিণ ব্যাপারীর হাটের মাঝখানে সড়কের পাশে স্মৃতিসৌধ। এখানে ১৭ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা শায়িত আছেন। সৌধের নামফলকে তিন নম্বরে আমার বাবার নাম রয়েছে। নাগেশ্বরী উপজেলার তরফ থেকে সরকারি উদ্যোগে এ বধ্যভূমি সংস্কার ও নামফলক স্থাপন করা হয়েছে। তবে বাবার নামের আগে চিকিৎসক পরিচয়টি উল্লেখ করা হয়নি। এই পরিচয়টি উল্লেখ করার আবেদন জানাচ্ছি।’

শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সম্পর্কে তথ্য চেয়ে প্রথম আলোতে বিজ্ঞাপন ছাপা হলে চিকিৎসক রইচ উদ্দিন সম্পর্কে তথ্য পাঠান তাঁর মেয়ে রওশন–ই–ফেরদ্দৌস। তিনি এবং তাঁর বোন মিনারা ফেরদ্দৌস জানান, ১৯৩২ সালে কুড়িগ্রাম জেলার ভূরুঙ্গামারী উপজেলার মানিক কাজী গ্রামে রইচ উদ্দিন শিকদারের জন্ম। তাঁর বাবা কাজিম উদ্দিন শিকদার গৃহস্থ ও মা রহিমা খাতুন গৃহিণী। চার ভাইবোনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয় ছিলেন।

মানিক কাজী গ্রামটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দিনহাটা থানার সীমান্তসংলগ্ন। সে কারণে রইচ উদ্দিন দিনহাটা থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। এরপর ১৯৫৭ সালে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ থেকে এলএমএফ পাস করে সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। এরপর ১৯৬৫ সালে ঢাকা মিটফোর্ড মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেন। তিনি ছিলেন একজন মানবদরদি সুচিকিৎসক। ১৯৫৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে গাইবান্ধার পলাশবাড়ী হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক তহসিন চৌধুরীর মেয়ে তসলিমা চৌধুরীর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। তাঁদের দুই ছেলে, তিন মেয়ে। দুই ছেলে ইন্তেকাল করেছেন। তসলিমা চৌধুরী বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছেন।

মুক্তিযুদ্ধের সময় রইচ উদ্দিন শিকদার রাজশাহীতে বিভাগীয় প্রধান ম্যালেরিয়া উচ্ছেদ কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত ছিলেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে বিনোদপুর বাজারের পাশে ছিল তাঁর সরকারি বাসা। কাছেই ছিল পাকিস্তানি হানাদার সেনাদের ক্যাম্প। তারা রইচ উদ্দিনকে ক্যাম্পে ডেকে নিয়ে তিন দিন আটকে রেখে নির্যাতন করে। ক্যাম্প থেকে ছাড়া পেয়ে তিনি পরিবার নিয়ে রাজশাহী থেকে কুড়িগ্রামের পথে রওনা দেন। অনেক বাধাবিঘ্ন পেরিয়ে গাইবান্ধা আসেন। সেখানে শ্বশুরবাড়িতে স্ত্রী–সন্তানদের রেখে রইচ উদ্দিন কুড়িগ্রামে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন।

দেশ স্বাধীনের পর তসলিমা শিকদার কুড়িগ্রামে এসে জানতে পারেন, সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন তাঁর স্বামী। তবে তাঁর আর কোনো সন্ধান পাননি। ভূরুঙ্গামারীর বীর মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুর রহমান প্রথম আলোকে জানান, রইচ উদ্দিন ৬ নম্বর সেক্টরে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। রইচ উদ্দিনের সহযোদ্ধা আখতারুজ্জামান মণ্ডলের উত্তর রণাঙ্গনে বিজয় বইয়ে রইচ উদ্দিনের শহীদ হওয়ার কথা উল্লেখ রয়েছে। এ বই থেকে জানা যায়, একাত্তরের ২৭ মে পাটেশ্বরী এলাকায় হানাদার সেনাদের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে ১৭ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। তাঁদের মধ্যে চিকিৎসক রইচ উদ্দিন শিকদারও ছিলেন। সেখানেই তাঁদের গণকবর দেওয়া হয়।

২০১৯ সালে উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে গণকবরটি সংরক্ষণ করে শহীদদের নামফলক নির্মাণ করা হয়। এ নিয়ে প্রথম আলোয় লেখা ছাপা হলে পরিবার শহীদ রইচ উদ্দিনের সমাধি খুঁজে পায়।

গ্রন্থনা: সফি খান, কুড়িগ্রাম।