শহীদ বুদ্ধিজীবী

মাশুকুর রহমান

শহীদ বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাবিদ ও মুক্তিযোদ্ধা, যশোর

মাশুকুর রহমান

শহীদ মাশুকুর রহমান ছিলেন তুখোড় মেধাবী ছাত্র, রাজপথের তরুণ ছাত্রনেতা, মুক্তিযুদ্ধে রণাঙ্গনের সাহসী যোদ্ধা। শিক্ষা শেষ করে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেছিলেন। কিন্তু তাঁর মেধা ও প্রতিভার পূর্ণ বিকাশের সুযোগ হয়নি। দেশের স্বাধীনতার জন্য উৎসর্গ করেছেন জীবন। রাজাকাররা নির্মমভাবে হত্যা করেছে তাঁকে।

মাশুকুর রহমানের জন্ম ১৯৪২ সালে যশোর শহরতলির এক রাজনৈতিক পরিবারে। বাবা আইনজীবী হবিবর রহমান ছিলেন যশোর জেলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সহসভাপতি। যশোর জিলা স্কুল থেকে ১৯৫৬ সালে মাধ্যমিক, ১৯৫৮ সালে যশোর এমএম কলেজ থেকে ঢাকা বোর্ডে সম্মিলিত মেধা তালিকায় ষষ্ঠ স্থান অধিকার করে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। ১৯৬৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিদ্যা এবং অঙ্কশাস্ত্রে স্নাতক ডিগ্রি নেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ছাত্র ইউনিয়নের সক্রিয় কর্মী ছিলেন। ১৯৬২ সালের ঐতিহাসিক শিক্ষা আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ছিলেন সামনের সারির নেতাদের অন্যতম।

১৯৬৪ সালে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। কেন্দ্রীয় কারাগারে থেকেই তিনি স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় অংশ নিয়ে প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হন। অল্পকাল তিনি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করে অ্যাপ্লায়েড ম্যাথমেটিকসে উচ্চশিক্ষার জন্য লন্ডন যান। একাত্তরে লন্ডন থেকে ফিরে পরিবারের কাউকে কিছু না জানিয়ে মাশুকুর ভারতে গিয়ে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিয়ে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। বাংলা একাডেমির শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ গ্রন্থে মাশুকুর রহমানকে শিক্ষাবিদ ও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে উল্লেখ করে সংক্ষিপ্ত জীবনী ছাপা হয়েছে। আগামী প্রকাশনীর শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষেও তাঁর পরিচিতি রয়েছে। মাশুকুর রহমান অকৃতদার ছিলেন।

যশোরের বীর মুক্তিযোদ্ধা নূর মোহাম্মদের লেখা যশোরে পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল)-এর বীরত্বপূর্ণ লড়াই বইয়ে মাশুকুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের বিবরণ রয়েছে। নূর মোহাম্মদ মাশুকুরের ভগ্নিপতি ও রণাঙ্গনের সহযোদ্ধা। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, যশোর-সাতক্ষীরা-খুলনার ডুমুরিয়া অঞ্চলে প্রতিরোধযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন মাশুকুর রহমান, যশোর জেলার ১১ দফা আন্দোলনের আহ্বায়ক আসাদুজ্জামান আসাদ, জেলা ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি আহসান উল্লাহ খান, জেলা কৃষক সমিতির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম ও সেনাবাহিনীর সাবেক সৈনিক ফজলু দফাদার।

একাত্তরের ২৩ অক্টোবর তাঁরা সাতক্ষীরা থেকে যশোর শহরে প্রবেশের জন্য রওনা হন। পথে আসাদ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁরা মনিরামপুর উপজেলার চিনেটলা এলাকায় এক ব্যক্তির বাড়িতে আশ্রয় নেন। তাঁদের আশ্রয় নেওয়ার খবরটি রাজাকাররা জানতে পারে। অস্ত্রে সজ্জিত একদল রাজাকার ওই বাড়ি ঘিরে ফেলে তাঁদের ধরে নিয়ে যায়। গ্রামের পাশেই নদীর তীরে তাঁদের বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে ও গুলি করে হত্যা করে লাশ ফেলে যায়। পরে স্থানীয় ঋষি সম্প্রদায়ের লোকজন ওই লাশগুলো মাটিচাপা দিয়ে রাখে। প্রতিবছর ২৩ অক্টোবর এই বীর শহীদদের স্মরণে স্থানীয়ভাবে স্মরণানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।

গ্রন্থনা: মনিরুল ইসলাম, যশোর