শহীদ বুদ্ধিজীবী

মোহাম্মদ সাদেক

শহীদ বুদ্ধিজীবী, সেনাবাহিনী, ভোলা, বরিশাল

শহীদ মোহাম্মদ সাদেক

একাত্তরের ২৫ মার্চ গভীর রাত থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঢাকায় মেতে ওঠে পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ নগরের বিভিন্ন জায়গায় নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালাতে থাকে তারা। ফজরের নামাজের সময় (ঘড়ির কাঁটা অনুসারে তখন ২৬ মার্চ) ঘাতক পাকিস্তানি সেনারা মোহাম্মদ সাদেকের ১১ নম্বর ফুলার রোডের বাসার দরজায় ক্রমাগত লাথি মারতে থাকে। তিনি বিপদ হতে পারে জেনেও নিজেই দরজা খুলে দিয়েছিলেন। ঘাতকেরা তাঁর দিকে রাইফেল তাক করলে তিনি নির্ভয়ে ইংরেজিতে তাদের বলেন, ‘নিরস্ত্র জনসাধারণের ওপর এভাবে আক্রমণ করা যায় না।’ বলাবাহুল্য, মোহাম্মদ সাদেকের এই যুক্তি ঘাতকদের কাছে কোনো যুক্তিই নয়। তাঁর অপরাধ শুধু বাঙালি হওয়াই নয়; ৭ মার্চ থেকে তাঁর বারান্দায় স্বাধীন বাংলাদেশ ও ২৩ মার্চ থেকে কালো পতাকা উড়ছিল। এটাই তাঁর প্রধান অপরাধ। সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাদের অস্ত্র গর্জে ওঠে। তিনি লুটিয়ে পড়েন মেঝেতে।

মোহাম্মদ সাদেকের দুই হাতে গুলি লেগেছিল। তখনো তাঁর জ্ঞান ছিল। সেনারা যাওয়ার সময় মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য তাঁর গলায় বেয়নেট চার্জ করে। তিনি মৃত্যুকে বরণ করেছিলেন বীরোচিতভাবে।

এ ঘটনার বর্ণনা আছে তাঁর ছেলে কামরুল হাসানের রচনায়। তিনি লিখেছেন, ‘...ঘাতকদের প্রচণ্ড পদাঘাতে আমাদের প্রধান ফটক ভেঙে যাবার উপক্রম হয়। বাবা বললেন, “ওরা দরজা ভেঙে ঢুকলে সবাইকে হত্যা করবে।” বাবা সিদ্ধান্ত নিলেন যুক্তির মাধ্যমে ওদেরকে মোকাবিলা করার জন্য। তাই তিনি আমাদের শত নিষেধ সত্ত্বেও দরজা খুলতে গেলেন।...

‘বাবা দরজা খুলে মুখোমুখি দাঁড়ালেন একদল হিংস্রÊহায়েনার।...

‘মারণাস্ত্র গর্জে উঠল। গুলি বিদ্ধ হলো বাবার দুটি হাতে। বাবা মেঝেতে লুটিয়ে পড়লেন।...

‘ফেরার সময় বাবার গলায় বেয়নেট চার্জ করল তারা। হত্যাকারীর দল চলে যাবার পর আমরা সকলে দৌড়ে গেলাম বাবার নিকট। রক্তস্নাত মেঝেতে বাবা পড়ে ছিলেন। বাবাকে ধরাধরি করে বিছানায় শোয়ানো হলো। তখনও তিনি জীবিত। আমার মা বাবাকে তখন হাসপাতালে নিয়ে যেতে চাইলেন। কিন্তু তার পূর্বেই বাবা শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন।’ (‘আমার বাবা’, কামরুল হাসান; স্মৃতি: ১৯৭১, ৫ম খণ্ড, প্রথম প্রকাশ ১৯৯২, সম্পাদনা রশীদ হায়দার)।

কামরুল হাসানের রচনা থেকে আরও জানা যায়, মোহাম্মদ সাদেক তাঁর স্ত্রীর শাড়ির কাপড় ছিঁড়ে একটি কালো পতাকা তাঁকে বানিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি এ দেশের জনগণের মুক্তির স্বপ্ন দেখতেন। পেশাগত জীবনে নির্লোভ, দৃঢ়চেতা, সৎ ও নিষ্ঠাবান শিক্ষক ছিলেন। তাঁর মরদেহ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাতেই (ফুলার রোড) সমাহিত করা হয়।

মোহাম্মদ সাদেকের জন্ম ভোলা জেলার দক্ষিণ ইলিশা গ্রামে, ১৯৩৯ সালের ৩১ মে। ভোলা সরকারি বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক (১৯৫৪) পাস করার পর ভর্তি হন বরিশালের বিএম কলেজে। এখান থেকে ইন্টারমিডিয়েট (১৯৫৬) ও বিএ (১৯৫৮) পাস করেন। এরপর ময়মনসিংহ টিচার্স ট্রেনিং কলেজে ভর্তি হন। এখান থেকে ১৯৬১ সালে বিএড ও ১৯৬২ সালে এমএড ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমএ পাস করেন।

তাঁর কর্মজীবন শুরু হয় ১৯৫৮ সালে, ভোলার পরাণগঞ্জ হাইস্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে। ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত এখানে চাকরি করেন। ১৯৫৯-৬০ পর্যন্ত ভোলা জেলার ব্যাংকের হাট কো-অপারেটিভ হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। ১৯৬৫ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ল্যাবরেটরি স্কুলে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। কিছুদিন এই স্কুলের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্বও পালন করেছিলেন তিনি।

স্কেচ: শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক ডাকটিকিট (তৃতীয় পর্যায়) প্রকাশ উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকা (১৯৯৪) থেকে।

গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান

<rashedtr@prothom-alo.info>

সূত্র: ২৮ ডিসেম্বর, ২০১৪ সালে প্রথম আলোতে প্রকাশিত