শহীদ বুদ্ধিজীবী

নূরুল আমিন খান

শহীদ বুদ্ধিজীবী, উপসচিব, ব্রাহ্মণবাড়িয়া,চট্টগ্রাম

নূরুল আমিন খান

একাত্তরের ২০ মে সকালে নূরুল আমিন খান অফিসে গিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন প্রাদেশিক সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয়ের উপসচিব।

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এক মেজর সেদিন তাঁকে ফোন করে ব্যক্তিগত রিভলভার নিয়ে আসার জন্য তাঁদের ক্যাম্পে যেতে বলেন।

এই যাওয়াই ছিল তাঁর শেষ যাওয়া। তার পর থেকে তাঁর আর খোঁজ পাওয়া যায়নি। এর আগে ২৩ এপ্রিল সেনাবাহিনী তাঁকে সপরিবারে আটক করে তাদের ক্যাম্পে নিয়েছিল।

কয়েক দিন আটক রাখার পর তাঁর ব্যক্তিগত তিনটি বন্দুক, একটি রিভলভার ও কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র রেখে সবাইকে ছেড়ে দিয়েছিল। ধারণা করা হয়, পাকিস্তানি সেনারা ২০ মে রাতেই তাঁকে হত্যা করে।

এ সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায় তাঁর স্ত্রী হুমায়রা আমিনের রচনায়। তিনি লিখেছেন, ‘আমাদের বাসা ধানমন্ডির ১৯ নং রোডে।

সার্বক্ষণিক নজর রাখা হতো বাসার ওপর। এই সময় আমিন সাহেব গভীরভাবে চিন্তা করছিলেন কোনোক্রমে ভারতে যাওয়া যায় কি না।

কিন্তু আমাকে, ছোট দুটি বাচ্চাকে নিয়ে যাওয়া প্রায় অসম্ভব ছিল। তারপর আমার আম্মা, বড় ভাই ও বোনেরা তখন পর্যন্ত আটক ছিল।...২০ মে যথারীতি আটটার দিকে উনি অফিসে গেলেন।

১২টার দিকে ফোন করে বললেন, মেজর (গোলাম মোহাম্মদ) তাঁকে তাদের ক্যাম্পে যেতে বলেছে রিভলভার ফিরিয়ে আনতে। আরও বললেন, দুপুরে বাসায় ফিরে এসে খাবেন।

আমি দুইটা থেকে তাঁর জন্য অপেক্ষা করতে থাকলাম। অপেক্ষা করতে করতে যখন চারটা বেজে গেল, তখন আমার সন্দেহ জাগতে লাগল।

আমি তাড়াতাড়ি সেই মেজরকে ফোন করলাম। দেখি ফোনটা ডেড। তখন আমার সন্দেহ আরও গাঢ় হলো। আমাদের বাসার মোড়েই ছিল পিস কমিটির চেয়ারম্যানের বাসা। তিনি আমাদের দেশি ও পূর্বপরিচিত। তাঁকে খবর পাঠাই।

তিনি বলে পাঠালেন চিন্তার কোনো কারণ নেই।...মাগরিবের সময় হয়ে এল। কোনোমতে নামাজটা পড়লাম।

আমার তখন ভীষণ ভয় করতে লাগল।... সে রাতটা যে আমার কীভাবে কেটেছিল, তা এখন প্রকাশ করতে সত্যি আমি একেবারেই অক্ষম।

পরের দিন খোঁজ পাবার অনেক চেষ্টা করলাম। তৎকালীন চিফ সেক্রেটারি সাহেবের সাথেও দেখা করলাম।

তাঁরাও আমাকে আশ্বাস দিলেন যে খোঁজ নেওয়ার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু সব চেষ্টাই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলো।’ (স্মৃতি ১৯৭১, প্রথম খণ্ড প্রথম প্রকাশ ১৯৮৮, সম্পাদনা রশীদ হায়দার)।

নূরুল আমিন খান ১৯৬১ সালে পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে যোগ দেওয়ার পর এসডিও (মহকুমা প্রশাসক) হিসেবে প্রথম নিযুক্তি পান সাতক্ষীরায়।

পঁয়ষট্টি সালে ময়মনসিংহে এডিসি (জেনারেল) নিযুক্ত হন। ছেষট্টি সালে শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে বদলি হন।

আটষট্টি সালের সেপ্টেম্বরে ‘গভর্নমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট’ বিষয়ে পড়াশোনার জন্য ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ডে যান।

পড়াশোনা শেষে ঊনসত্তর সালে অর্থ মন্ত্রণালয়ে উপসচিব হিসেবে যোগ দেন। সত্তর সালের প্রথমার্থে বরিশালের ডেপুটি কমিশনার হন।

ওই বছরের শেষে তাঁকে ঢাকায় কৃষি মন্ত্রণালয়ে উপসচিব পদে বদলি করা হয়।

নূরুল আমিন খানের পৈতৃক নিবাস ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবায়। তাঁর জন্ম ভারতের আসামের তিনসুকিয়ায়। ২২ নভেম্বর ১৯৩৫।

বাবা মোহাম্মদ সোলেমান খান। কুমিল্লার ইউসুফ স্কুল, ঢাকার নবাবপুর স্কুল, ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেন।

স্কুলে ছাত্রাবস্থায় ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার অপরাধে তাঁকে কারাবরণ করতে হয়। ইংরেজি সাহিত্যে এমএ করেন ১৯৬০ সালে।

স্কেচ: শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক ডাকটিকিট (তৃতীয় পর্যায়) প্রকাশ উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকা (১৯৯৪) থেকে।

গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান

সূত্র: ২৪ ডিসেম্বর, ২০১৪ সালে প্রথম আলোতে প্রকাশিত