শহীদ বুদ্ধিজীবী
কাজী মোহাম্মদ মসরুর আহমেদ
শহীদ বুদ্ধিজীবী, আইনজীবী, সাতক্ষীরা
একাত্তরের মার্চ, বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পর সারা দেশ উত্তাল। সাতক্ষীরার মুক্তিকামী বাঙালিরা প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের জন্য। গোপনে প্রশিক্ষণ নিতে থাকেন অনেকেই। তাঁদের সহায়তা করছিলেন আইনজীবী কাজী মোহাম্মদ মসরুর আহমেদ। এ খবর পেয়ে ২১ এপ্রিল তাঁকে গুলি করে হত্যা করে পাকিস্তানি হানাদার সেনারা।
কাজী মসরুর আহমেদ এলাকায় ‘ক্যাপ্টেন কাজী’ নামেই পরিচিত ছিলেন। সাতক্ষীরা জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্য ছিলেন, সক্রিয় ছিলেন সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে। হানাদার বাহিনী গণহত্যা শুরু করলে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ ও অন্যান্য তথ্য সংগ্রহের জন্য কাজী মসরুর ঘন ঘন ভারতে যান। উৎসাহী তরুণদের সঙ্গে এসব নিয়ে আলোচনা করে হানাদারদের প্রতিরোধের পরিকল্পনা করতে থাকেন।
শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সম্পর্কে তথ্য চেয়ে প্রথম আলোতে বিজ্ঞাপন ছাপা হলে সাতক্ষীরার সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক সিরাজুল ইসলাম কাজী মসরুরের ছবি ও তথ্য পাঠান। সেই সূত্র ধরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কাজী মসরুর আহমেদের জন্ম ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলার বারাসাত মহকুমার কাজীপাড়ায় ১৯৩৪ সালে। বাবা কাজী মাওলানা আহমেদ, মা মোছা. হামিদুন্নেছা। তিনি চার ভাইবোনের মধ্যে দ্বিতীয়। বারাসাত থেকে মাধ্যমিক পাস করে তিনি কলকাতার রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ কলেজ থেকে স্নাতক ও পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএল ডিগ্রি নিয়ে বারাসাত আদালতে আইন ব্যবসা শুরু করেন। ১৯৬৪ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পর কাজী মসরুর ভারত থেকে সপরিবার সাতক্ষীরায় এসে শহরের কাছারিপাড়ায় বসবাস শুরু করেন এবং সাতক্ষীরা আদালতে আইনজীবী হিসেবে কাজ শুরু করেন।
কাজী মসরুরের বড় ছেলে কাজী রওনাক আহমেদ জানান, তাঁর বাবা আইন পেশার পাশাপাশি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর মা রোকেয়া বেগম ও তিন ভাই এক বোনকে ভারতের বারাসাতের নেহালপুরে খালার বাড়িতে রেখে আসেন। সাতক্ষীরার কাছারিপাড়ায় তাঁর বাবা ও ছোট মামা শেখ মাসুদুর রহমান থাকতেন। তাঁর বাবা প্রায়ই বারাসাতে গিয়ে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতেন।
পাকিস্তানি হানাদার সেনারা ২০ এপ্রিল সন্ধ্যার দিকে সাতক্ষীরায় এসে টাউন হাইস্কুলে ক্যাম্প করে। পরদিন সকালে তারা কাজী
মসরুরের খোঁজে তাঁর বাড়িতে যায়। তারা বাড়ি থেকে মসরুরকে তুলে স্থানীয় রেজিস্ট্রি অফিসের সামনে এনে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ক্ষতবিক্ষত করতে থাকে। তাঁর ছোট শ্যালক দশম শ্রেণির ছাত্র শেখ মাসুদুর রহমান এ অবস্থা দেখে তাঁকে বাঁচাতে আকুতি জানাতে থাকে। হানাদার সেনারা তখন তাঁদের দুজনকেই গুলি করে হত্যা করে। এরপর কাজী মসরুরের বাড়িটি ডিনামাইট দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়।
কাজী রওনাক জানান, সাতক্ষীরা জেলা বার সমিতির তৎকালীন সভাপতি এস এম হায়দার এ এলাকার প্রথম শহীদ হিসেবে তাঁর বাবার প্রত্যয়নপত্র দিয়েছেন। জেলা প্রশাসন থেকে প্রকাশিত জেলার ইতিহাস-ঐতিহ্যবিষয়ক সংকলন ব্যাঘ্রতট পরিক্রমণ-এ স্থানীয় শহীদদের তালিকায় তাঁর নাম রয়েছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের ১৯৯৮ সালে প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধে শহীদ আইনজীবীদের সংকলনগ্রন্থে কাজী মসরুরকে সাতক্ষীরার প্রথম শহীদ হিসেবে উল্লেখ রয়েছে। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের ২০০৩ সালের গেজেটে সাতক্ষীরার বেসামরিক শহীদদের তালিকায় ২১১১ নম্বরে তাঁর নাম রয়েছে।
গ্রন্থনা: কল্যাণ ব্যানার্জি, সাতক্ষীরা
Also Read
-
রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ দাবি: রাজনৈতিক সমঝোতায় সমাধান খুঁজছে সরকার
-
ওডিশা ও পশ্চিমবঙ্গের উপকূলে আছড়ে পড়েছে ঘূর্ণিঝড় দানা
-
উৎকৃষ্ট গণতন্ত্র চাইলে শুধু নির্বাচন দিলে হবে না
-
সাংবিধানিক পথে যাত্রা ভুল হলে সেটা এই আন্দোলনে থাকা সবার ভুল: আসিফ নজরুল
-
ছেলেদের লিগে মেয়েদের দল: ‘দুঃসাহসী’ রামসবটম ক্রিকেট ক্লাবের গল্প