শহীদ বুদ্ধিজীবী

আমিনুল হক

শহীদ বুদ্ধিজীবী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, সৈয়দপুর, নীলফামারী

আমিনুল হক

আমিনুল হকের চোখ উপড়ে ফেলে অবাঙালি নরঘাতকেরা। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় তিনি আর্তনাদ করতে থাকলে পিশাচের দল আরও উল্লসিত হয়ে ওঠে। ধারালো অস্ত্র দিয়ে তাঁর হাতের আঙুল, হাত-পা কেটে টুকরা টুকরা করে ফেলা হয়। এখানেই শেষ নয়, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আমিনুল হকের শরীরের খণ্ডিত অংশগুলো পাটকলের ‘জুটপ্রেস’ নামের যন্ত্র দিয়ে পিষে ফেলে তারা।

বাবার এই নির্মম পরিণতির বর্ণনা দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন শহীদ আমিনুল হকের ছেলে নীলফামারীর সৈয়দপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মহসিনুল হক। তিনি বলেন, সৈয়দপুর তখন ছিল অবাঙালিপ্রধান শহর। আর তাঁদের পরিবার ছিল আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। তাঁর বড় চাচা শহীদ বুদ্ধিজীবী চিকিৎসক জিকরুল হক ছিলেন সৈয়দপুর থানা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ এবং তৎকালীন প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য। তাঁর বাবা আমিনুল হক সৈয়দপুরের শতবর্ষী সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘শিল্প-সাহিত্য সংসদের’ অন্যতম সদস্য ছিলেন। ব্যক্তিগতভাবে তিনি ছিলেন নাট্যাভিনেতা। অভিনয়গুণে এই অঞ্চলে তিনি জনপ্রিয় ছিলেন।

শহীদ আমিনুল হকের জন্ম ১৯২১ সালে। তাঁর বাবা জেয়ারতউল্লাহ আহমদ। সৈয়দপুর কায়েদে আযম কলেজ থেকে তিনি স্নাতক ডিগ্রি নিয়েছিলেন। বড় ভাই জিকরুল হক ছিলেন সৈয়দপুরের খ্যাতিমান চিকিৎসক। পেশাগতভাবে তিনি বড় ভাইয়ের ডিসপেনসারিতে চিকিৎসা সহকারী হিসেবেও কাজ করতেন।

মহসিনুল হক বলেন, ১৯৭০ সালের সংসদ নির্বাচনে জিকরুল হক নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে অংশ নেন। তাঁর বাবা নির্বাচনী প্রচারে গিয়ে গ্রামেগঞ্জে স্বাধীনতার পক্ষে জনমত সৃষ্টি করেন। এসব কারণে অবাঙালিরা তাঁদের পরিবারের ওপর প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত ছিল। তাঁর বাবা–চাচারা তিন ভাইসহ তাঁদের পরিবারের সাতজন মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সৈয়দপুর বিমানবন্দর নির্মাণকাজ শুরু হয়। বিনা পারিশ্রমিকে নির্মাণশ্রমিক হিসেবে কাজ করতে অনেক বাঙালিকে ধরে আনে পাকিস্তানি হানাদার সেনারা। আমিনুল হককে ২৮ মার্চ তাঁর নতুন বাবুপাড়ার বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায়। সৈয়দপুর হাইস্কুলের একটি কক্ষে অনেকের সঙ্গে তাঁকেও আটকে রেখে নির্মাণকাজ করতে বাধ্য করে। এ ধরনের কাজে অনভ্যস্ত বলে ক্লান্ত হয়ে পড়লে প্রচণ্ড নির্যাতন করা হতো তাঁকে। একপর্যায়ে ২৮ জুন পাকিস্তানি সেনারা আমিনুল হককে অবাঙালি রাজাকার দলপতি ইজাহার আহমদের হাতে তুলে দেয়। রাজাকাররা তাঁকে সৈয়দপুর পৌরসভার সামনে ভুলিয়া মাড়োয়ারির পাট গুদামে নিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে।

সৈয়দপুর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা ইউনিটের সাবেক কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা একরামুল হক জানান, সৈয়দপুরের অন্যতম সাংস্কৃতিক সংগঠক এবং নাট্যজন আমিনুল হক সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেননি। তবে তিনি বাঙালি সংস্কৃতির জাগরণ ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সৃষ্টিতে সংগঠক হিসেবে কাজ করেছেন।

স্বাধীনতার পর শহীদ আমিনুল হকের নামে সৈয়দপুর শহরের একটি সড়কের নামকরণ হয়েছে। এ ছাড়া শহরের ইসলামবাগ এলাকায় একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ও তাঁর নামে হয়েছে।

গ্রন্থনা: এম আর আলম, সৈয়দপুর, নীলফামারী।