শহীদ বুদ্ধিজীবী

আবদুল আওয়াল

শহীদ বুদ্ধিজীবী, প্রধান শিক্ষক, দুর্গাপুর, নেত্রকোনা

আবদুল আওয়াল

নেত্রকোনার দুর্গাপুরের মহারাজা কুমুদ চন্দ্র মেমোরিয়াল (এমকেসিএম) পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবদুল আওয়াল ছিলেন সংবেদনশীল সরল মনের মানুষ। প্রশাসনিক কাজের দক্ষতা তাঁর যেমন ছিল, তেমনি ছাত্রদের খুব আপন করেও নিতে পারতেন। সে জন্য ছাত্রদের কাছে খুব প্রিয় ছিলেন ‘আওয়াল স্যার’। বিদ্যালয় পরিচালনা ও পড়ানোর ফাঁকে ফুলের বাগান করা, লেখালেখির চর্চা এবং বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক কাজেও যুক্ত ছিলেন তিনি।

সক্রিয় রাজনীতি না করলেও দেশের অবস্থা সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে সহায়ক শক্তি হিসেবে নানাভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করেছেন। তাঁর এ ভূমিকায় ক্ষুব্ধ হয়ে একাত্তরের ৩ আগস্ট রাতে মুসলিম লীগের চিহ্নিত রাজাকার কিতাব আলী তালুকদারের নেতৃত্বে রাজাকারের দল তাঁকে ধরিয়ে দেয় পাকিস্তানি হানাদার সেনাদের হাতে। হায়েনার দল তাঁকে আটক করে বিরিশিরি পাকিস্তানি ক্যাম্পে নিয়ে টানা তিন দিন নির্যাতন করে। ৭ আগস্ট রাতে তাঁকে বিরিশিরি বধ্যভূমিতে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে লাশটি ভাসিয়ে দেয় সোমেশ্বরী নদীতে। লাশের সন্ধান পাননি স্বজনেরা।

শহীদ আবদুল আওয়ালের জন্ম ১৯৩৯ সালে, ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার বিরই গ্রামে। বাবা বাশির আলী, মা জয়নাব খাতুন গৃহিণী। পাঁচ ভাই ও তিন বোনের মধ্যে তিনি সবার ছোট। নরসিংদী কলেজ থেকে স্নাতক এবং ময়মনসিংহ টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে বিএড ও এমএড ডিগ্রি অর্জনের পর ১৯৬৫ সালে তিনি দুর্গাপুরে এমকেসিএম পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন।

আবদুল আওয়ালের স্ত্রী হাসিনা আক্তারও শিক্ষক ছিলেন। তিনি ২০১১ সালে ইন্তেকাল করেছেন। তাঁদের তিন মেয়ে ও এক ছেলে। ছেলে তোফায়েল আওয়াল ঢাকায় উত্তরা ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে সহকারী মহাব্যবস্থাপক হিসেবে কর্মরত। তিনি বলেন, ‘আব্বাকে হত্যার পর আমার নানা দুর্গাপুর থেকে আমাদের ময়নসিংহ নিয়ে আসেন। আম্মা কষ্ট করে শিক্ষকতা করে আমাদের মানুষ করেছেন। আব্বাকে নিয়ে আমরা গর্বিত। দেশের জন্য তিনি জীবন উৎসর্গ করেছেন। শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে তাঁর নাম সরকারিভাবে গেজেটে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানাই।’

সরকারি স্বীকৃতি না পেলেও ছাত্ররাই উদ্যোগ নিয়েছে তাদের প্রিয় শিক্ষক শহীদ আবদুল আওয়ালের স্মৃতি ধরে রাখতে। দেশ স্বাধীন হলে ছাত্ররা সবাই মিলে এমকেসিএম পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ে সামনে একটি তোরণ নির্মাণ করে তাঁর নামে নামকরণ করেছে ‘আওয়াল স্মৃতি তোরণ’। এ ছাড়া ২০১২ সালে দুর্গাপুর থেকে প্রকাশিত আমাদের কথা নামে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সাময়িকীতে মুক্তিযোদ্ধা শামসুল হক মণ্ডল তাঁর শিক্ষক আবদুল আওয়ালের অবদানের কথা উল্লেখ করেছেন।

তাঁর আরেক ছাত্র উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা ইউনিটের সাবেক কমান্ডার সোহরাব উদ্দিন তালুকদার জানান, আবদুল আওয়াল মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে যাওয়ার ব্যবস্থা করা, আর্থিক সহায়তা দেওয়াসহ গোপনে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করছিলেন। এ জন্য স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় পাকিস্তানি সেনারা তাঁকে ধরে নিয়ে হত্যা করে।

গ্রন্থনা: পল্লব চক্রবর্তী, নেত্রকোনা