বীরত্বসূচক খেতাবপ্রাপ্তদের তালিকা
হোসেন আলী তালুকদার, বীর প্রতীক
গ্রাম চর দশসিকা, কামারখন্দ, সিরাজগঞ্জ।
বাবা সাবেরউদ্দীন তালুকদার, মা সাকেরা খাতুন।
স্ত্রী সুফিয়া বেগম। তাঁদের দুই মেয়ে ও দুই ছেলে।
খেতাবের সনদ নম্বর ৭৮।
ডিসেম্বর মাসের কনকনে শীতের মধ্যে সিলেটের দিকে এগিয়ে চলেছেন হোসেন আলী তালুকদারসহ একদল মুক্তিযোদ্ধা। তাঁরা নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্য। কদিন ধরে প্রায় না খেয়ে আছেন। শীতবস্ত্রও তেমন নেই। তার পরও তাঁদের মনোবল অত্যন্ত দৃঢ়। তাঁরা বুঝতে পারছেন, চূড়ান্ত বিজয় খুব কাছে। বিপুল উত্সাহে তিন দিন একটানা হেঁটে খাল-বিল-জলাভূমি অতিক্রম করে ১৪ ডিসেম্বর পৌঁছে গেলেন সিলেট এমসি কলেজ এলাকায়। পথে বিভিন্ন স্থানে ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কয়েকটি প্রতিরক্ষা অবস্থান। সেগুলো তাঁরা এড়িয়ে গেলেন। সিলেট শহরের উপকণ্ঠে এমসি কলেজে আছে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর শক্ত একটি ঘাঁটি। হোসেন আলী তালুকদার ও তাঁর সহযোদ্ধারা অবস্থান নিলেন ৫০০ গজ দূরে টিলার ওপরে। পাকিস্তানি সেনাদের নাকের ডগায় পরিখা খুঁড়ে তাঁরা অবস্থান নিতে থাকেন। এমসি কলেজের পাঁচ মাইল পেছনে খাদিমনগরে তখনো যুদ্ধ চলছে।
হোসেন আলী তালুকদার ও তাঁর সহযোদ্ধাদের পোশাক, হেলমেট ও অস্ত্রশস্ত্র দেখতে একদম পাকিস্তানি সেনাদের মতো। পাকিস্তানি সেনারা ভাবতেই পারেনি, তাঁরা মুক্তিযোদ্ধা। পাকিস্তানি সেনারা চিৎকার করে কয়েকবার তাঁদের পরিচয় জানতে চেয়েছে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা জবাব না দিয়ে চুপচাপ টিলার ওপর পরিখা খুঁড়তে থাকেন। এ সময় সেখানে মুক্তিবাহিনীর ডি কোম্পানির অবস্থানের সামনে এসে হাজির হলো পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি আর্টিলারি গানবাহী গাড়ি ও দুটি জিপ। মুক্তিযোদ্ধারা সঙ্গে সঙ্গে গোলাবর্ষণ করলেন। মুহূর্তে আগুন ধরে গেল কামানবাহী গাড়ি ও জিপে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় পাকিস্তানি সেনারা দৌড়াদৌড়ি শুরু করল। সে সুযোগে হোসেন আলী তালুকদার ও তাঁর সহযোদ্ধারা মেশিনগান ও অন্যান্য অস্ত্র দিয়ে গুলি শুরু করলেন। তাঁদের গুলিতে প্রায় ২৫ জন পাকিস্তানি সেনা রাস্তার ওপরই হতাহত হলো। পাকিস্তানি সেনাদের তখন বোধোদয় হয়েছে। দ্রুত তারা সর্বশক্তি দিয়ে পাল্টা আক্রমণ শুরু করল। মুক্তিযোদ্ধারাও তা মোকাবিলা করতে থাকেন। শুরু হয়ে গেল প্রচণ্ড যুদ্ধ। মুক্তিযোদ্ধাদের তীব্র আক্রমণে পাকিস্তানি সেনারা কিছুক্ষণের মধ্যেই ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে গেল শহরের ভেতরে মূল ঘাঁটিতে। সেদিন যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর শতাধিক নিহত ও ২৫-৩০ জন আহত হয়। মুক্তিবাহিনীর ২০ জন শহীদ ও ২২-২৩ জন আহত হন।
হোসেন আলী তালুকদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে কর্মরত ছিলেন। ১৯৭১ সালে তাঁদের অবস্থান ছিল যশোর সেনানিবাসে। ২৯ মার্চ তাঁরা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে আক্রান্ত হলে সেনানিবাস থেকে পালিয়ে ভারত সীমান্তে অবস্থান নেন। সেখানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে কিছুদিন খণ্ড খণ্ড যুদ্ধ করেন। তারপর ভারতে যান। সেখানে পুনর্গঠন ও নতুন করে প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর তাঁদের জেড ব্রিগেডে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ৩১ জুলাই জামালপুর জেলার কামালপুরে প্রথম তিনি সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেন। কামালপুর যুদ্ধে তাঁদের দলের মেশিনগান থেকে হঠাৎ গুলি ছোড়া বন্ধ হয়ে যায়। সেটি ছিল সামনে। অধিনায়কের নির্দেশে দুজন সহযোদ্ধাকে সঙ্গে নিয়ে তিনি সেই মেশিনগান উদ্ধারে যান। তখন তাঁর দুই সহযোদ্ধার একজন শহীদ ও একজন আহত হন। কিন্তু তিনি মনোবল হারাননি। প্রচণ্ড গুলির মধ্যে ক্রল করে মেশিনগানের অবস্থানে গিয়ে তা উদ্ধার করে আনেন। হোসেন আলী তালুকদার সিলেটের কানাইঘাটসহ আরও কয়েকটি স্থানে যুদ্ধ করেন।
সূত্র: একাত্তরের বীরযোদ্ধা: খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা, প্রথম খণ্ড, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা ২০১২
সম্পাদক: মতিউর রহমান, সংগ্রহ ও গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
Also Read
-
কিরগিজস্তানে বিদেশিদের ওপর হামলা, আতঙ্কে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা
-
পাবনায় বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে স্কুলছাত্রীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগ, মামলা
-
ময়নাতদন্তে হত্যাকাণ্ড, পিবিআইয়ের প্রতিবেদনে আত্মহত্যা
-
ডিবিতে কেন গেলেন জানালেন মামুনুল হক
-
মাহমুদউল্লাহ ‘স্পিরিট অব দ্য টিম’, সাকিব ‘কিংবদন্তি’, রিশাদ ‘বিরল’