বীরত্বসূচক খেতাবপ্রাপ্তদের তালিকা

শরফুদ্দীন আহমেদ, বীর উত্তম

  • গ্রাম সুলতানপুর, কুমারখালী, কুষ্টিয়া।

  • বাবা মো. শামসুল আলম, মা হাসিনা আলম। অবিবাহিত।

  • খেতাবের সনদ নম্বর ৬৬। গেজেটে নাম শরফুদ্দীন।

  • মৃত্যু ১০ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২।

শরফুদ্দীন আহমেদ

ভারতের এক ঘাঁটি থেকে আকাশে উড়ল ছোট একটি অটার বিমান। বিমানটির চালকের আসনে শরফুদ্দীন আহমেদ ও আক্রাম আহমেদ (বীর উত্তম)। আরও আছেন একজন গানার। বিমানে আছে রকেট ও মেশিনগান। স্বল্পগতির বিমানটি সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে ঢুকে এগিয়ে যেতে থাকে লক্ষ্যস্থলের দিকে। শরফুদ্দীন আহমেদ ও আক্রাম আহমেদ যতটা সম্ভব কৌশলে বিমান চালিয়ে যাচ্ছেন। একসময় তাঁরা পৌঁছে গেলেন লক্ষ্যস্থলে। তারপর আকাশের নির্দিষ্ট স্থানে বারবার চক্কর দিয়ে কয়েকটি রকেট ছুড়লেন। একই সময় গানার তাঁর মেশিনগান থেকে বর্ষণ করলেন গুলি। আর নিচে ভূমিতে থাকা পাকিস্তানি সেনারা জীবন বাঁচাতে ছোটাছুটি করতে লাগল। বিস্ফোরিত রকেটের স্প্লিন্টার ও গুলিতে নিহত ও আহত হলো অনেক পাকিস্তানি সেনা। এ ঘটনা ১৯৭১ সালের ৫ ডিসেম্বরের। ঘটেছিল কুশিয়ারা নদীর তীরে।

মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে মুক্তিবাহিনী মিত্রবাহিনীর সহযোগিতায় বৃহত্তর সিলেট অঞ্চল মুক্ত করার জন্য যৌথভাবে অভিযান শুরু করে। তারা সীমান্ত অতিক্রম করে আটগ্রাম-চরখাই-সিলেট, জাফলং-ছোটখেল-গোয়াইনঘাট-কোম্পানীগঞ্জ-সালুটিকর-সিলেট এবং ছাতক-গোবিন্দগঞ্জ-লামাকাজিঘাট-সিলেট অক্ষ ধরে অগ্রসর হতে থাকে। এ সময় পাকিস্তানি সেনারা সীমান্ত এলাকা থেকে পশ্চাদপসরণ করে বিভিন্ন জায়গায় অবস্থান নেয়। তারা মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীকে প্রবল বাধা দিতে থাকে। এতে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর অগ্রযাত্রা স্তিমিত হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় পাকিস্তানি অবস্থানে বিমান থেকে হামলার প্রয়োজন হয়। তখন মুক্তিবাহিনীর নবগঠিত বিমান উইং পাকিস্তানি অবস্থানের ওপর বিমান থেকে হামলা করে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীকে সাহায্য করতে থাকে। কুশিয়ারা নদীর তীরে এক জায়গায় পাকিস্তানি সেনারা বিপুল সেনাসমাবেশ ঘটায়। ওই পথ দিয়ে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর যোদ্ধারা অগ্রসর হচ্ছিলেন। শরফুদ্দীন আহমেদ ও আক্রাম আহমেদ পাকিস্তানি অবস্থানে হামলা চালিয়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেন। বিমান হামলায় বিপুলসংখ্যক পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। আহতও হয় অনেকে। এরপর পাকিস্তানি সেনাদের মনোবল ভেঙে পড়ে। সেদিন ওই বিমান হামলা পরিচালনা ছিল যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ, স্বল্পগতির অটার বিমানটি যেকোনো সময় পাকিস্তানি সেনাদের মেশিনগানের গুলিতে ভূপাতিত হতে পারত।

শরফুদ্দীন আহমেদ ১৯৬৭ সালে বিমান চালানোর বাণিজ্যিক লাইসেন্স পান। ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তান কৃষি বিভাগে প্ল্যান্ট প্রটেকশন কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করতেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি মে মাসে ভারতে চলে যান। সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে মুক্তিবাহিনীর বিমান উইং গঠিত হলে তাঁকে এতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বিমান উইংয়ের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে তিনি অটার বিমান দিয়ে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেন। প্রথম অপারেশনের সুযোগ পান ৫ ডিসেম্বরে। পরে তিনি অটার বিমান দিয়ে ৭ ও ৮ ডিসেম্বর মৌলভীবাজারে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অবস্থানে আক্রমণ চালান।

সূত্র: একাত্তরের বীরযোদ্ধা: খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা, প্রথম খণ্ড, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা ২০১২

সম্পাদক: মতিউর রহমান, সংগ্রহ ও গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান