বীরত্বসূচক খেতাবপ্রাপ্তদের তালিকা

জহিরুল হক খান, বীর প্রতীক

  • গ্রাম সুহিলপুর, ইউনিয়ন সুহিলপুর, সদর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া। বর্তমান ঠিকানা মৌলভীপাড়া, পৌর এলাকা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।

  • বাবা সুলতান আহমদ খান, মা হাবিয়া খাতুন।

  • স্ত্রী মাহবুবা আক্তার। তাঁদের চার ছেলে।

  • খেতাবের সনদ নম্বর ৩৭।

জহিরুল হক খান

জহিরুল হক খানের প্রতিরক্ষা অবস্থানের দিক দিয়ে পাকিস্তানি সেনারা পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল। তিনি সহযোদ্ধাদের নিয়ে পাল্টা আক্রমণ চালাচ্ছেন। তাঁর ত্বরিত তত্পরতায় পাকিস্তানি সেনাদের পালিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে গেল। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচণ্ড আক্রমণে অধিকাংশ পাকিস্তানি সেনা নিহত হলো। মুক্ত হলো বিরাট এক এলাকা। এ ঘটনা ঘটেছিল কানাইঘাটে। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে।

কানাইঘাট সিলেট জেলার অন্তর্গত উপজেলা। এর অবস্থান জৈন্তাপুর-জকিগঞ্জ সংযোগ সড়কে সুরমা নদীর তীরে এবং ভারতের মেঘালয় রাজ্যের সীমান্তে। এখানে ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর শক্ত এক প্রতিরক্ষাব্যূহ। প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত ছিল পাঞ্জাব রেজিমেন্ট। তাদের সহায়তা করেছে খাইবার রাইফেলস, থাল ও তোচি স্কাউটস এবং স্থানীয় রাজাকার বাহিনী।

মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে জকিগঞ্জ ও আটগ্রাম মুক্ত হওয়ার পর মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী সিলেটের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। কিন্তু কানাইঘাটের পাকিস্তানি অবস্থান ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য শক্ত এক বাধা। এ জন্য কানাইঘাট দখল করার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। মুক্তিযোদ্ধারা প্রথমে কানাইঘাট-দরবস্ত রাস্তা বন্ধ করতে ওই সড়কের লুবাছড়া চা-বাগানে অবস্থান নেন। তখন পাকিস্তানি সেনারা দূরবর্তী অবস্থান থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান লক্ষ্য করে ১০৫ মিলিমিটার কামানের গোলাবর্ষণ করতে থাকে।

এ অবস্থায় মুক্তিযোদ্ধারা তাঁদের আক্রমণের কৌশল পাল্টে ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করেন। তাঁরা তিনটি দলে বিভক্ত হয়ে যান। দুটি দল কাট অফ পার্টি হিসেবে দায়িত্ব পালন করে। একটি দল অবস্থান নেয় কানাইঘাট-দরবস্ত সড়কে। আরেকটি কানাইঘাট-চরখাই সড়কে। এ দলের দলনেতা জহিরুল হক খান। অন্যটি আক্রমণকারী দল হিসেবে থাকে। ২ ডিসেম্বর রাতে মুক্তিযোদ্ধারা যে যাঁর অবস্থানে পৌঁছে যান। কিন্তু আক্রমণ শুরু করার আগেই পাকিস্তানি সেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের উপস্থিতি টের পেয়ে যায়। তারা মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর ব্যাপক আক্রমণ শুরু করে। মুক্তিযোদ্ধারাও পাল্টা আক্রমণ চালান। দেড় ঘণ্টা প্রচণ্ড যুদ্ধের পর পাকিস্তানি সেনারা পালাতে থাকে। কিন্তু তাদের পালানোর পথ ছিল রুদ্ধ। একদল পাকিস্তানি সেনা ও তাদের সহযোগীরা জহিরুল হক খানের অবস্থানের দিক দিয়ে পালানোর চেষ্টা করে। কিন্তু সে সুযোগ তারা পায়নি। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে পলায়নরত পাকিস্তানি সেনাদের ওপর আক্রমণ করেন। তাঁদের প্রবল আক্রমণে অধিকাংশ পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। লাশে ভরে যায় যুদ্ধক্ষেত্র। ৪ ডিসেম্বর সকাল আটটার মধ্যেই কানাইঘাট স্বাধীন হয়। কানাইঘাটের যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাদের ৫০ জন নিহত, ২০ জন আহত এবং ২৫ জন আত্মসমর্পণ করে। মুক্তিবাহিনীর ১১ জন শহীদ ও ২০ জন আহত হন।

জহিরুল হক খান ১৯৭১ সালে স্নাতক প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিলেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজের (বর্তমানে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি কলেজ) শিক্ষার্থী ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে এতে যোগ দেন। পরে ভারতে চলে যান। সেখান থেকে সীমান্ত এলাকায় খণ্ড খণ্ড যুদ্ধে অংশ নেন। জুনে তাঁকে অন্তর্ভুক্ত করা হয় প্রথম বাংলাদেশ অফিসার্স ওয়ার কোর্সে। প্রশিক্ষণ শেষে তাঁকে ৪ নম্বর সেক্টরের অমলসিদ সাব-সেক্টরের অধিনায়কের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তারপর বেশ কয়েকটি যুদ্ধে তিনি অগ্রবর্তী দলে থেকে যুদ্ধ পরিচালনা করেন।

সূত্র: একাত্তরের বীরযোদ্ধা: খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা, প্রথম খণ্ড, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা ২০১২

সম্পাদক: মতিউর রহমান, সংগ্রহ ও গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান