বীরত্বসূচক খেতাবপ্রাপ্তদের তালিকা

জনাব আলী, বীর বিক্রম

  • গ্রাম মিরাসানির নোয়াবাদী, উপজেলা বিজয়নগর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।

  • বাবা মোহাম্মদ আলী ভূঁইয়া, মা দুধরাজ বিবি। স্ত্রী সাজেদা মাহমুদা। তাঁদের তিন মেয়ে ও তিন ছেলে।

  • খেতাবের সনদ নম্বর ৪৪।

  • মৃত্যু ১৯৮৪।

জনাব আলী

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে জনাব আলীসহ একদল মুক্তিযোদ্ধা অবস্থান নেন মনতলায়।

তেলিয়াপাড়া দখল করার পর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সর্বশক্তি নিয়োগ করে মনতলা দখলের জন্য। এখানে ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের তিনটি দল। আখাউড়া-সিলেট রেলপথের দুই ধারে তাঁরা মোতায়েন ছিলেন। জনাব আলীসহ মুক্তিযোদ্ধা দলের (কোম্পানি) অবস্থান ছিল মনতলা রেলস্টেশনে। অপর দুই দলের একটি ছিল কাশিমপুর রেলস্টেশনে, আরেকটি হরষপুর রেলস্টেশন এলাকায়।

পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ১৫ জুন প্রথম দূরপাল্লার গোলাবর্ষণের মাধ্যমে জনাব আলী ও তাঁর সহযোদ্ধাদের অবস্থানে আক্রমণের সূচনা করে। এরপর কয়েক দিন ধরে সেখানে যুদ্ধ হয়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দুটি ব্যাটালিয়ন কৌশলে মুক্তিযোদ্ধাদের দিকে এগিয়ে যায়। তারা দিনের বেলায় দূর থেকে হালকা অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে গোলাগুলি করে মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যস্ত রাখত। রাতে ভারী মেশিনগানের গুলি ও মর্টারের গোলাবর্ষণ করত। এর ছত্রচ্ছায়ায় তারা ক্রমে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আসে। মুক্তিযোদ্ধারা মাঝেমধ্যে এগিয়ে গিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের বাধা দিলেও পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অগ্রযাত্রা ঠেকাতে পারেননি।

২০ জুন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অগ্রবর্তী দল জনাব আলীদের প্রতিরক্ষা অবস্থানের একেবারে সামনে চলে আসে। একই সময় পাকিস্তানি সেনাদের অন্যান্য দলও বিভিন্ন দিক থেকে সেখানে এগিয়ে আসে। জনাব আলীরা বীরবিক্রমে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আক্রমণ প্রতিহত করতে থাকেন। কিন্তু একটানা কয়েক দিন যুদ্ধ করে তাঁর বেশির ভাগ সহযোদ্ধা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। ফলে তাঁদের প্রতিরক্ষা অবস্থান নাজুক হয়ে পড়ে।

অসমসাহসী জনাব আলী এতে দমে যাননি বা মনোবল হারাননি। সাহসের সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ অব্যাহত রাখেন। ২১ জুন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কয়েকটি দল তিন দিক থেকে জনাব আলীদের অবস্থানে আক্রমণ চালায়। এদিন আক্রমণকারী পাকিস্তানি সেনারা সংখ্যায় ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েক গুণ বেশি। ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে তাঁদের অবস্থান ধরে রাখা অসম্ভব হয়ে পড়ে। শেষে অধিনায়কের নির্দেশে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটে যান। ওই দিন মনতলার পতন হয়।

জনাব আলী চাকরি করতেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীতে। ১৯৭১ সালে কর্মরত ছিলেন দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। এর অবস্থান ছিল জয়দেবপুরে। তখন তাঁর পদবি ছিল নায়েব সুবেদার। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি যুদ্ধে যোগ দেন। প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে মনতলায় অবস্থান নেন। মনতলার পতন হলে ভারতে পুনরায় সংগঠিত হওয়ার পর প্রথমে ৩ নম্বর সেক্টরের পঞ্চবটী সাবসেক্টরে, পরে এস ফোর্সের অধীনে যুদ্ধ করেন। কয়েকটি যুদ্ধে তিনি যথেষ্ট কৃতিত্ব ও বীরত্ব প্রদর্শন করেন।

সূত্র: একাত্তরের বীরযোদ্ধা: খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা, দ্বিতীয় খণ্ড, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা ২০১৩

সম্পাদক: মতিউর রহমান, সংগ্রহ ও গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান