বীরত্বসূচক খেতাবপ্রাপ্তদের তালিকা

আবদুল হাই সরকার, বীর প্রতীক

  • গ্রাম মালভাঙা, ইউনিয়ন মোগলবাসা, সদর, কুড়িগ্রাম। বর্তমান ঠিকানা গ্রাম মুক্তারাম, ইউনিয়ন বেলগাছা, সদর, কুড়িগ্রাম।

  • বাবা রমজান আলী সরকার, মা হাফেজা খাতুন।

  • স্ত্রী গুলশান আরা। তাঁদের সাত মেয়ে ও তিন ছেলে।

  • খেতাবের সনদ নম্বর ৩৬২। গেজেটে নাম আবদুল হাই।

আবদুল হাই সরকার

১৯৭১ সালের নভেম্বরের মাঝামাঝি কুড়িগ্রাম জেলার উলিপুরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এরপর পাকিস্তানি সেনারা আশপাশের প্রায় ৭০০ নিরীহ গ্রামবাসীকে ধরে এনে হত্যা করে। এর প্রতিশোধ নিতে সুযোগ খুঁজছিলেন মুক্তিবাহিনীর সাহেবগঞ্জ সাব-সেক্টরের হাই ও নজরুল কোম্পানির মুক্তিযোদ্ধারা। হাই কোম্পানির অধিনায়ক ছিলেন আবদুল হাই সরকার। তাঁরা সিদ্ধান্ত নিলেন, কুড়িগ্রাম-চিলমারী রেললাইনের উলিপুর অংশের হালাবটগাছে অ্যান্টি ট্যাংক মাইন পুঁতে পাকিস্তানি সেনা ও রসদবাহী ট্রেন অ্যামবুশ করবেন। এ জন্য সাব-সেক্টর হেডকোয়ার্টার থেকে অ্যান্টি ট্যাংক মাইন সংগ্রহ করেন তাঁরা।

কয়েক দিন পর মুক্তিযোদ্ধারা জানতে পারেন, পাকিস্তানি সেনা ও রসদবাহী ট্রেন ২৭ নভেম্বর (মতান্তরে ২০ নভেম্বর) কুড়িগ্রাম থেকে উলিপুরে আসবে। খবর পেয়ে ২৬ নভেম্বর ভোরে আবদুল হাই সরকার তাঁর কোম্পানির মুক্তিযোদ্ধা ও নজরুল কোম্পানির সেকশন কমান্ডার জসিমের অধীনের মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে হালাবটগাছ এলাকায় যান। সেখানে ছিল এক বটগাছ। আশপাশে তেমন কোনো জনবসতি ছিল না। তাঁরা সেখানে রেললাইনের স্লিপারের নিচে অ্যান্টি ট্যাংক মাইন পোঁতেন। মাইনে তার লাগিয়ে সেই তার প্রায় আড়াই শ গজ দূরে নেন। তারের শেষ প্রান্তে লাগান ডেটোনেটর। সেখানে ছিল ঝোপঝাড়। মুক্তিযোদ্ধারা তার ভেতর ওত পেতে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন।

সকাল নয়টার দিকে কুড়িগ্রাম থেকে পাকিস্তানি সেনা ও রসদবাহী ট্রেন উলিপুরে আসছিল। ট্রেনের একেবারে সামনে মাটিভর্তি ওয়াগন। সেটি চিহ্নিত স্থান অতিক্রম করামাত্র মুক্তিযোদ্ধারা ডেটোনেটরের মাধ্যমে মাইনগুলোর বিস্ফোরণ ঘটান। সঙ্গে সঙ্গে গোটা এলাকা গগনবিদারী শব্দে প্রকম্পিত হয়। একটি বগি দুমড়েমুচড়ে রেললাইনের পাশে পড়ে যায়। পেছনের বগিও উল্টে পড়ে। নিহত হয় ১৪-১৫ জন পাকিস্তানি সেনা। বেঁচে যাওয়া পাকিস্তানি সেনারা অবস্থান নিয়ে গুলি করতে থাকে। এ সময় মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রগুলোও একসঙ্গে গর্জে ওঠে। নতুন এই আক্রমণে তারা হতভম্ব হয়ে পড়ে। কিছুক্ষণ প্রতিরোধযুদ্ধ চালিয়ে পাকিস্তানি সেনারা কুড়িগ্রামের দিকে পালিয়ে যায়। সেদিন মোট ১৯ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। অন্যদিকে মুক্তিবাহিনীর পথপ্রদর্শকসহ আটজন সাধারণ গ্রামবাসী শহীদ হন।

আবদুল হাই সরকার ছিলেন একজন শ্রমিক। ১৯৭১ সালে পিটিসির (বর্তমানে ব্রিটিশ-আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানি—বিএটিসি) ঢাকার মহাখালী কারখানায় দিনভিত্তিক মজুরিতে কাজ করতেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি ঢাকা থেকে পালিয়ে নিজ এলাকায় যান। পরে ভারতে গিয়ে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেন। ট্রেনিং শেষে ৬ নম্বর সেক্টরের সাহেবগঞ্জ সাব-সেক্টরের অধীন কুড়িগ্রাম এলাকায় যুদ্ধ করেন। তিনি হালাবটগাছ এলাকার অপারেশনের আগে ও পরে মোগলবাসা, গড়াইহাট, বুড়াবুড়িসহ আরও কয়েকটি স্থানে গেরিলা অপারেশন করেন।

সূত্র: একাত্তরের বীরযোদ্ধা: খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা, প্রথম খণ্ড, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা ২০১২

সম্পাদক: মতিউর রহমান, সংগ্রহ ও গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান