বীরত্বসূচক খেতাবপ্রাপ্তদের তালিকা

আবদুল জলিল শিকদার, বীর প্রতীক

  • গ্রাম চাচই, লোহাগড়া, নড়াইল। বর্তমান ঠিকানা চানমারী, রূপসা, খুলনা।

  • বাবা আবদুল হক শিকদার, মা পুটি বেগম। স্ত্রী নূরজাহান বেগম। তাঁদের সাত ছেলেমেয়ে।

  • খেতাবের সনদ নম্বর ১৭১।

  • মৃত্যু ২০০৬।

আবদুল জলিল শিকদার

১৯৭১ সালের ১১ এপ্রিল। আবদুল জলিল শিকদার খবর পেলেন, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বড় একটি দল সেনানিবাস থেকে বেরিয়ে রাস্তার দুই পাশের বাড়িঘর জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে তাঁদের প্রতিরক্ষা অবস্থানের দিকে আসছে। তিনি একদল মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে প্রতিরক্ষা অবস্থানে ছিলেন ঝিকরগাছার লাউজানিতে। খবর পেয়ে তিনি পাকিস্তানি সেনাদের প্রতিরোধ করতে তাঁর দলের দুই প্লাটুন মুক্তিযোদ্ধাকে সামনের দিকে পাঠালেন। যশোর-বেনাপোল সড়ক ধরে তাঁরা কিছুদূর অগ্রসর হতেই পড়ে গেলেন পাকিস্তানি সেনাদের সামনে। পাকিস্তানি সেনারা তাঁদের প্রচণ্ড গতিতে আক্রমণ করল। প্রবল আক্রমণে তাঁরা পিছু হটতে বাধ্য হলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই পাকিস্তানি সেনারা হাজির হলো আবদুল জলিল শিকদারের প্রতিরক্ষা অবস্থানের সামনে। তাঁর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করতে লাগলেন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দলটি অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত। সে তুলনায় তাঁদের অস্ত্র খুবই কম। তার পরও তাঁরা প্রতিরোধ চালিয়ে গেলেন। পরদিন পাকিস্তানি সেনারা আর্টিলারির সাহায্যে তাঁদের আক্রমণ করল। এতে শহীদ হলেন বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা। ফলে তাঁদের প্রতিরক্ষা অবস্থান ধরে রাখা ক্রমে কঠিন হয়ে পড়ল। এ অবস্থায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে আবদুল জলিল শিকদার পশ্চাদপসরণের সিদ্ধান্ত নিলেন।

ঝিকরগাছা যশোরের অন্তর্গত একটি উপজেলা। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ৩০ মার্চ থেকে যশোরে প্রতিরোধযুদ্ধ শুরু হয়। এ যুদ্ধে যশোর ইপিআর সেক্টর হেডকোয়ার্টারের অধীন বেশির ভাগ বাঙালি ইপিআর সদস্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। হেডকোয়ার্টারের অধীন খুলনার ৫ নম্বর উইংয়ের তিন কোম্পানি ইপিআর সদস্যও যশোরে সমবেত হয়ে প্রতিরোধযুদ্ধে অংশ নেন। মেজর আবু ওসমান চৌধুরীর (পরে লেফটেন্যান্ট কর্নেল) নির্দেশে ৫ নম্বর উইংয়ের তিন কোম্পানি ইপিআর সদস্যের একাংশ যশোর শহরে এবং অপর অংশ ঝিকরগাছায় প্রতিরক্ষা অবস্থান নেয়। দুই দলের সার্বিক নেতৃত্বে থাকেন (সুবেদার) আবদুল জলিল শিকদার। তাঁর নির্দেশে সুবেদার হাসান উদ্দিনের নেতৃত্বাধীন ‘সি’ কোম্পানি যশোর সেনানিবাসে মর্টারের সাহায্যে আক্রমণ চালায়। কিন্তু তাঁরা পাকিস্তানি সেনাদের পাল্টা আক্রমণে পিছু হটে নড়াইলের দিকে চলে যান। এ সময় মুক্তিযোদ্ধাদের এক দল আরেক দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ঝিকরগাছার পতন হলে সেখানকার মুক্তিযোদ্ধারা ভারত সীমান্তসংলগ্ন বেনাপোলে আশ্রয় নেন। কয়েক দিন পর বেনাপোলও পাকিস্তানি সেনাদের দখলে চলে যায়। তখন মুক্তিযোদ্ধারা ভারতে অবস্থান নেন।

আবদুল জলিল শিকদার ভারতে অবস্থানকালে কিছুদিন প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। বিহারের চাকুলিয়ায় প্রথম ব্যাচের মুক্তিযোদ্ধাদের ২৪ দিন প্রশিক্ষণ দেন। এরপর ৯ নম্বর সেক্টরের অধীন হিঙ্গলগঞ্জ সাব-সেক্টরে প্রশিক্ষক ও সমন্বয়কারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের বাংলাদেশের ভেতরে গেরিলা অপারেশনে পাঠানো, তাঁদের পরামর্শ ও সহায়তা প্রদান প্রভৃতি কাজ তিনিই করতেন।

১৯৭১ সালে আবদুল জলিল শিকদার যশোর ইপিআর সেক্টরের ৫ নম্বর উইংয়ের ‘এ’ কোম্পানির নেতৃত্বে ছিলেন। পদবি ছিল সুবেদার। কোম্পানির অবস্থান ছিল সাতক্ষীরার কলারোয়ায়। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি সেখান থেকে যশোরে এসে প্রতিরোধযুদ্ধে অংশ নেন।

সূত্র: একাত্তরের বীরযোদ্ধা: খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা, প্রথম খণ্ড, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা ২০১২

সম্পাদক: মতিউর রহমান, সংগ্রহ ও গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান