বীরত্বসূচক খেতাবপ্রাপ্তদের তালিকা

আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী, বীর উত্তম ও বীর বিক্রম

  • গ্রাম উত্তর শ্রীপুর, উপজেলা ফুলগাজী, ফেনী।

  • বাবা সামসুল হুদা চৌধুরী, মা বুল-এ-আনার বেগম।

  • স্ত্রী সাবেরা ওয়াহেদ চৌধুরী। তাঁদের এক মেয়ে ও এক ছেলে।

  • খেতাবের সনদ নম্বর ৫৫ ও ১৩৩।

আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ামাত্র বিদেশ থেকে আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরীসহ আটজন বাঙালি নাবিকের যুদ্ধে যোগদান ছিল উল্লেখযোগ্য এক ঘটনা। ফ্রান্সের তুঁল নৌঘাঁটিতে তাঁরা পাকিস্তানের সদ্য কেনা সাবমেরিনে (ম্যানগ্রো) সাবমেরিনার হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

ওয়াহেদ চৌধুরীসহ আটজন বাঙালি নাবিকের অদম্য মনোবল, একাগ্রতা ও দেশের প্রতি ভালোবাসা দেখে মুক্তিবাহিনীর নৌ উইং অর্থাত্ নৌ-কমান্ডো বাহিনী গঠন করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে নৌবাহিনী গঠিত হয়। তাঁরা আটজন প্রথমে প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করে বাংলাদেশের ভেতরে নৌ-অভিযান পরিচালনার জন্য আরও সহযোদ্ধা (সুইসাইডাল স্কোয়াড) তৈরি করেন।

প্রশিক্ষণ ছিল অত্যন্ত কষ্টসাধ্য ও ঝুঁকিপূর্ণ। বিপজ্জনক, স্পর্শকাতর মাইন ও বিস্ফোরকের সঠিক ব্যবহার রপ্ত করতে নৌ-মুক্তিযোদ্ধাদের অন্তত তিন বছর সময়ের প্রয়োজন ছিল। তাঁরা দুই মাসের মধ্যে অন্তর্ভুক্তদের নৌ-অভিযানের জন্য পারদর্শী করে তোলেন। এ জন্য তাঁরা দৈনিক প্রায় ১৮ ঘণ্টা প্রশিক্ষণ দেন। এরপর দীর্ঘ যাত্রাপথে ঘটে অনেক ঘটনা। অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ওয়াহেদ চৌধুরী সহযোদ্ধাদের নিয়ে ১১ আগস্ট চট্টগ্রাম শহরের কাছে পৌঁছান। ১৩ আগস্ট আকাশবাণী বেতারকেন্দ্রে পরিবেশিত হয় একটি গান—‘আমি তোমায় শুনিয়েছিলাম যত গান’। এই গান ছিল সংকেত। এটা শুধু দলনেতাই জানতেন। এরপর তাঁর নির্দেশে সবাই প্রস্তুত হন। গোলাবারুদসহ শহর অতিক্রম করে পরদিন তাঁরা কর্ণফুলী নদীর তীরে পৌঁছান।

১৪ আগস্ট ওয়াহেদ চৌধুরী অপেক্ষায় থাকেন আরেকটি গান শোনার জন্য। গানটি সেদিনই বাজানোর কথা ছিল। কিন্তু বাজানো হয়নি। পরদিন ১৫ আগস্ট সকালে গানটি বাজে—‘আমার পুতুল আজকে যাবে শ্বশুরবাড়ি’। তিনি সহযোদ্ধাদের জানান, ওই রাতেই হবে অপারেশন।

এরপর ওয়াহেদ চৌধুরীসহ নৌ-মুক্তিযোদ্ধারা চরম উত্কণ্ঠায় সময় কাটান। তাঁদের স্নায়ুচাপ বেড়ে যায়। কারণ, ওই রাতই হয়তো তাঁদের জীবনের শেষ রাত। এভাবে ১৫ তারিখের সূর্য বিদায় নেয়। গোপন শিবিরে নৌ-মুক্তিযোদ্ধারা প্রস্তুত হন।

বর্ষণমুখর গাঢ় অন্ধকার রাতে ওয়াহেদ চৌধুরী সহযোদ্ধাদের নিয়ে রওনা হন। রাত আনুমানিক একটায় তাঁর সহযোদ্ধারা পানিতে নেমে সাঁতার কেটে দ্রুত এগিয়ে যান লক্ষ্যের দিকে। তিনিসহ কয়েকজন তীরে থাকেন নিরাপত্তায়। রাত আনুমানিক দুইটা। কানফাটা আওয়াজে কেঁপে ওঠে গোটা নগর। একের পর এক বিস্ফোরণ ঘটে চলে। চট্টগ্রাম বন্দরে থাকা পাকিস্তানি সেনারা ছোটাছুটি শুরু করে। এ অপারেশনের সাংকেতিক নাম ছিল ‘অপারেশন জ্যাকপট’। অভিযান সফল হওয়ার পর আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী সহযোদ্ধাদের নিয়ে ভারতে ফিরে যান।

সূত্র: একাত্তরের বীরযোদ্ধা: খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা, দ্বিতীয় খণ্ড, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা ২০১৩

সম্পাদক: মতিউর রহমান, সংগ্রহ ও গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান