মুক্তিযুদ্ধের দিনলিপি
হৃত সম্পত্তি ফিরে পাবেন শরণার্থীরা
মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পেছনে ছিল দেশ বিদেশের বহু মানুষের একক ও মিলিত প্রচেষ্টা, অজস্র ঘটনা। এখানে রইল একাত্তরের প্রতিটি দিনের বিবরণ।
বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ২ সেপ্টেম্বর মুজিবনগরে সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ভারতে আশ্রয় নেওয়া সব শরণার্থীকে সসম্মানে নিজ নিজ বাস্তুভিটায় পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে। মন্ত্রিসভায় এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ সরকার খুব ভালো করেই জানে, শরণার্থীদের ফেলে আসা সব সম্পত্তি পাকিস্তানের সামরিক জান্তা দখলে নিয়েছে। তাই শত্রুসেনার কবলমুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শরণার্থীরা তাঁদের ন্যায্য মালিকানা ফিরে পাবেন।
যুক্তরাজ্য ও বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের দূত বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী নরওয়ে সফরকালে এদিন সকালে দেশটির প্রধান বিচারপতি পিয়ের অল্ডের আমন্ত্রণে সুপ্রিম কোর্টে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এ সময় বিচারপতি পিয়ের অল্ড সুপ্রিম কোর্টের সব বিচারপতিকে আবু সাঈদ চৌধুরীর সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য তাঁর কক্ষে আসার অনুরোধ জানান। আবু সাঈদ চৌধুরী সংক্ষেপে তাঁদের বাঙালির স্বাধীনতা কামনার মূল কারণগুলো ব্যাখ্যা করেন। বিচারপতিরা বাঙালিদের প্রতি সহানুভূতি জানিয়ে আন্দোলনের সাফল্য কামনা করেন।
একই দিনে আবু সাঈদ চৌধুরী নরওয়ের পার্লামেন্ট ভবনে গিয়ে পার্লামেন্টের আন্তর্জাতিক কমিটির সদস্যদের সঙ্গে বাংলাদেশ সম্পর্কে আলোচনাকালে বাঙালিদের দাবির যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করেন। এরপর আবু সাঈদ চৌধুরী অসলো বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ডিনের সঙ্গে দেখা করেন। তাঁর সঙ্গে তিনি আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের ব্যাপারে কথা বলেন। ট্রাইব্যুনালের প্রধান কাজ হবে গণহত্যা সম্পর্কে একটি প্রামাণ্য প্রতিবেদন প্রণয়ন করা। এ সম্পর্কে আলোচনার পর অসলো বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ডিন প্রস্তাবিত ট্রাইব্যুনালের সদস্যপদ গ্রহণ করতে রাজি হন।
ফারল্যান্ডের সঙ্গে দেখা করলেন না বঙ্গবন্ধু
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কলকাতায় একটি কূটনৈতিক সূত্র পাকিস্তান থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ২ সেপ্টেম্বর জানায়, পাকিস্তানে বন্দী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ডের সঙ্গে দেখা করার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেছেন। সূত্রটি জানায়, শেখ মুজিব বেঁচে আছেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ডের মাধ্যমে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান তাঁর সঙ্গে একটা সমঝোতায় আসার চেষ্টা করেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও ব্যক্তিগত দূত হেনরি কিসিঞ্জার যখন ইসলামাবাদে গিয়েছিলেন, তখন প্রথম ফারল্যান্ড ওই প্রস্তাব শেখ মুজিবকে পাঠান। দ্বিতীয়বার একই প্রস্তাব পাঠান চলতি মাসের তৃতীয় সপ্তাহে। কিন্তু শেখ মুজিব বলেন, যাদের অস্ত্রে বাঙালিদের হত্যা করা হচ্ছে, তাদের সঙ্গে কথা বলতে চাই না।
ভারত সফররত পশ্চিম জার্মানির সংসদ এবং সরকার প্রেরিত প্রতিনিধিদলের নেতা ড. গুয়েনভার রিনসাচি দিল্লিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করে বলেন, বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানই একমাত্র পথ। তিনি বলেন, তাঁদের সরকার শেখ মুজিবের বিচার সম্পর্কেও ওয়াকিবহাল। জার্মানির চ্যান্সেলর উইলি ব্রান্ট পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে অনুরোধ জানিয়ে বলেছেন, পরিস্থিতি জটিল হয়ে পড়তে পারে, এমন কোনো কাজ যেন তিনি না করেন।
পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নেওয়া বাংলাদেশের শরণার্থীদের অবস্থা নিজ চোখে দেখতে এই দিন ভারতের রাজধানী দিল্লি থেকে ১৬টি দেশের মিলিটারি অ্যাটাশে সন্ধ্যায় কলকাতায় পৌঁছান। ১৬টি দেশ হলো যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ব্রিটেন, ফ্রান্স, কানাডা, ইতালি, পশ্চিম জার্মানি, যুগোস্লাভিয়া, ফিলিপাইন, লেবানন, মিসর, ইরান ও ঘানা প্রভৃতি দেশ।
মুক্তিবাহিনীর গেরিলা অভিযান
২ নম্বর সেক্টরের গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল এই দিন ঢাকা-কুমিল্লা সড়কের গজারিয়ায় পাকিস্তানি সেনাদের একটি প্রতিরক্ষাচৌকিতে হামলা করে কয়েকজন ইপিকাফ সেনাকে হতাহত এবং একজনকে বন্দী করে।
৬ নম্বর সেক্টরের একদল মুক্তিযোদ্ধা তিস্তা নদীসংলগ্ন শঠিবাড়ি বন্দর এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর ঘাঁটিতে হামলা করে। পাকিস্তানি সেনারা শেল ও রকেটের সাহায্যে পাল্টা আক্রমণ চালায়। সারা দিন আক্রমণ অব্যাহত থাকে।
৭ নম্বর সেক্টরের অধীন বগুড়া জেলার গাবতলীতে মুক্তিযোদ্ধারা জাতহলিদা গ্রামে পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর অতর্কিত হামলা চালান। দুই পক্ষের মধ্যে তীব্র একজন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। পাকিস্তানি সেনারা পাঁচজন নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যা করে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার চালনায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ হয়। পাকিস্তানি সেনারা নৌকায় মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের দিকে অগ্রসর হলে মুক্তিবাহিনী তাদের অ্যামবুশ করে তীব্র আক্রমণ চালায়। পাকিস্তানি সেনাবাহীর কয়েকটি নৌকা পানিতে ডুবে যায়। গুলিতে কয়েকজন হতাহত হয়।
সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর দুই, ছয় ও সাত; স্বাধীনতাসংগ্রামে প্রবাসী বাঙালি, আবদুল মতিন, র্যাডিক্যাল এশিয়া পাবলিকেশন্স, লন্ডন; আনন্দবাজার পত্রিকা, ভারত, ৩ ও ৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
Also Read
-
চিকিৎসকেরা নিশ্চিত করলেই খালেদা জিয়াকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হবে: মির্জা ফখরুল
-
যেকোনো মূল্যে দনবাস দখল করব: পুতিন
-
মুক্তিযুদ্ধে বিদেশি স্বজনদের কথা
-
খালেদা জিয়াকে দেখতে হাসপাতালে জুবাইদা রহমান
-
শারীরিক অবস্থা ঠিক থাকলে রোববার খালেদা জিয়াকে লন্ডনে নেওয়া হবে