মুক্তিযুদ্ধের দিনলিপি
স্বাধীনতার সমর্থনে লন্ডনে আবু সাঈদ চৌধুরীর বক্তব্য
মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পেছনে ছিল দেশ-বিদেশের বহু মানুষের একক ও মিলিত প্রচেষ্টা, অজস্র ঘটনাধারা। এখানে রইল একাত্তরের প্রতিটি দিনের বিবরণ
বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ৮ জুন লন্ডনের রয়্যাল কমনওয়েলথ সোসাইটিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিষয়ে তাঁর বক্তব্য উপস্থাপন করেন। বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ এই দূত বলেন, অর্থনৈতিক শোষণে দীর্ঘদিন ধরে জর্জরিত পূর্ব বাংলার জনগণ। ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে জনগণ ভোটকেন্দ্রে গিয়েছিলেন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শোষণের কথা মনে রেখেই। তাঁরা শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য ভোট দিয়েছেন।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ জয়ের পরও সরকার গঠন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করতে সামরিক সরকারের প্রধান ইয়াহিয়া খানের নানা ফন্দিফিকির, নিরীহ মানুষদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া গণহত্যা এবং মুক্তিযুদ্ধ পুরো পরিস্থিতি সবিস্তার বর্ণনা করেন আবু সাঈদ চৌধুরী। তিনি বলেন, ১৬৯টির মধ্যে ১৬৭টি আসনে আওয়ামী লীগের জয়কে ইয়াহিয়ার মন্ত্রণাদাতারা ভালো চোখে দেখেননি। তারই ফল ২৫ মার্চের রাতের বর্বরতম হত্যাযজ্ঞ।
বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ দূত বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী বলেন, পূর্ব বাংলার জনগণ স্বাধীনতার আওয়াজ তুলেছে। বাংলাদেশ নামে নতুন এক দেশের অভ্যুদয় হয়েছে। কারও পক্ষেই বাংলাদেশকে সেনাবাহিনীর কর্তৃত্বাধীন রাখা আর সম্ভব নয়। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, জীবনযাপন, সংস্কৃতি ও ভাষায় পূর্ব বাংলার জনগোষ্ঠী আলাদা। জাতিসংঘ সনদের ভিত্তিতে নিজেদের আত্মরক্ষার অধিকার তাদের আছে। তারা অবশ্যই স্বাধীনতা চায়।
মে মাসে হাঙ্গেরির বুদাপেস্টে শান্তি সম্মেলনে অংশ নেওয়ার পাশাপাশি ইউরোপের কয়েকটি দেশ সফর করে দিল্লিতে ফিরে এসে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের প্রধান আবদুস সামাদ আজাদ এই দিন সাংবাদিকদের বলেন, ইউরোপীয় দেশগুলোর নেতাদের সবাই বাংলাদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিধনযজ্ঞে উদ্বিগ্ন।
উপমহাদেশের বাইরে
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং মস্কোতে সোভিয়েত পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্দ্রে গ্রোমিকোর সঙ্গে এই দিন তৃতীয় দফা অনির্ধারিত বৈঠকে বসেন। বাংলাদেশের জনগণের মুক্তিসংগ্রামে নৈতিক সমর্থন ও সহযোগিতা এবং ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি নিয়ে তাঁদের মধ্যে আলোচনা হয়। সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী অ্যালেক্সি কোসিগিনের সঙ্গেও দেখা করেন সরদার শরণ সিং। পরে তিনি সাংবাদিকদের জানান, সোভিয়েত নেতাদের সঙ্গে সন্তোষজনক আলোচনা হয়েছে।
বাংলাদেশের পক্ষে জনমত সৃষ্টির লক্ষ্যে বিশ্বভ্রমণরত ভারতের সর্বোদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটনে দেশটির সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী জোসেফ সিসকোর সঙ্গে দেখা করেন। পাকিস্তানকে যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য বন্ধ রাখার জন্য তিনি সিসকোর কাছে আবেদন জানিয়েছেন। এরপর তিনি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং বাংলাদেশবান্ধব সভায় বক্তব্য দেন এবং টেলিভিশনে সাক্ষাৎকার দেন। সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, সিসকো বাংলাদেশ পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝতে পেরেছেন।
যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রসচিব স্যার আলেক ডগলাস হোম কমন্স সভায় বলেন, নতুন অর্থনৈতিক সাহায্য প্রকল্পে রাজি হওয়ার আগে রাজনৈতিক সমাধানের জন্য ব্রিটেন পাকিস্তানের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে। তবে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের ওপর রাজনৈতিক সমাধান যুক্তরাজ্য চাপিয়ে দিতে পারে না। তিনি বলেন, বাংলাদেশ থেকে আসা শরণার্থী সমস্যার সমাধানে ভারত সরকার প্রশংসনীয় উদ্যোগ নিয়েছেন। তবে ভারত তা একা সমাধান করতে পারবে না। এর জন্য জাতিসংঘের সহযোগিতা প্রয়োজন।
বাংলাদেশি অধ্যাপকদের নিয়োগে
ভারতের কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী সিদ্ধার্থ শংকর রায় লোকসভায় বলেন, বাংলাদেশ থেকে আসা অধ্যাপকদের কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিভিন্ন কলেজে ভিজিটিং অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ দিতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আর্থিক অনুদানের জন্য যে আবেদন করেছেন, সরকার তা বিবেচনা করছে। বাংলাদেশের প্রায় ১০ জন বিশ্ববিদ্যালয়শিক্ষক ও ৭০০ জন কলেজশিক্ষকের চাকরির বিষয়ে উপাচার্যের কাছে আবেদন এসেছে।
নেতাদের সামরিক আদালতে শাস্তি
ঢাকায় ১ নম্বর বিশেষ সামরিক আদালত আওয়ামী লীগ নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, আবদুল মান্নান ও তোফায়েল আহমেদ এবং দ্য পিপল পত্রিকার সম্পাদক আবিদুর রহমানকে ১৪ বছর সশ্রম কারাদণ্ড দেন এবং তাঁদের সম্পত্তির শতকরা ৫০ ভাগ বাজেয়াপ্ত করেন। তাঁদের অনুপস্থিতিতে এই বিচার করা হয়।
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী বাঙালি: যুক্তরাজ্য, আবদুল মতিন, সাহিত্য প্রকাশ; ইত্তেফাক, পূর্বদেশ ও আজাদ, ৯ জুন ১৯৭১; আনন্দবাজার পত্রিকা ও যুগান্তর, ভারত, ৯ ও ১০ জুন ১৯৭১।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
Also Read
-
অভিনেত্রী শমী কায়সার গ্রেপ্তার
-
মার্চ-এপ্রিলে নির্বাচনের দাবিতে কর্মসূচি শুরুর চিন্তা বিএনপির
-
চট্টগ্রামে ফেসবুক পোস্টকে ঘিরে সংঘর্ষ, ফাঁকা গুলি, সাত পুলিশ সদস্য আহত
-
সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা এখনো আক্রমণের মুখে: সম্পাদক পরিষদ
-
প্রাথমিক ভোট গণনার ফল যে কারণে বিভ্রান্তিকর হতে পারে