মুক্তিযুদ্ধের দিনলিপি

সোভিয়েত বিমানবাহিনী প্রধানের ভারত ত্যাগ

মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পেছনে ছিল দেশ বিদেশের বহু মানুষের একক ও মিলিত প্রচেষ্টা, অজস্র ঘটনা। এখানে রইল একাত্তরের প্রতিটি দিনের বিবরণ।

সোভিয়েত ইউনিয়নের বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার মার্শাল পাভেল কুতাকভ পাঁচ দিনের ভারত সফর শেষে ৩ নভেম্বর মস্কো উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের আশঙ্কার মধ্যে তাঁর এই সফর ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে সত্যি সত্যি এ দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হলে সোভিয়েত বিমানবাহিনী ভারতকে কী ধরনের সহায়তা করতে পারে, তা নিয়ে আলাপ হয়েছে বলে ওয়াকিবহাল মহল ধারণা দেয়। ভারতে অবস্থানকালে তিনি ও তাঁর সঙ্গীরা ভারতের প্রধানমন্ত্রী ও বিমানবাহিনী প্রধানের সঙ্গে আলোচনা করেন।

ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মরিস সুম্যান এই দিন বাংলাদেশ সংকট প্রশ্নে রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক মীমাংসায় আসার জন্য পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কাছে আবেদন জানান।

৩ নভেম্বর যুক্তরাজ্যের দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ-এর বিশেষ সংবাদদাতা ক্লেয়ার হোলিংওয়ার্থের ঢাকা থেকে পাঠানো এক সংবাদে বলা হয়, ৪০ হাজারের মতো মুক্তিযোদ্ধা বাংলাদেশের ভেতরে গেরিলা হামলা চালিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের জন্য গুরুতর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছেন। শহরাঞ্চলে তাঁরা দিনে অন্তত ২০ জন করে পাকিস্তানি সেনাকে হতাহত করেছেন। জনসমর্থনপুষ্ট গেরিলাযোদ্ধারা তাঁদের ক্ষমতা সম্পর্কে ক্রমশ সচেতন হয়ে উঠছেন।

কিছুদিন আগে চট্টগ্রাম শহরে দুপুরবেলা দুই পক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি গুলির ফলে দুজন পাকিস্তানি সেনা, একজন পুলিশ এবং একজন মুক্তিযোদ্ধা নিহত হয়।

প্রতি রাতে পুরান ঢাকায় দীর্ঘ গোলাগুলি এবং বোমা বিস্ফোরণের আওয়াজ শোনা যায়। পাকিস্তানি এক সামরিক কর্মকর্তা টেলিগ্রাফ-এর সংবাদদাতাকে বলেন, দুই মাস ধরে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সমর্থন জোয়ারের পানির মতো সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে।

সুইজারল্যান্ডের পাকিস্তানি দূতাবাস থেকেসদ্য পক্ষত্যাগকারী কূটনীতিক ওয়ালিউর রহমান
সাংবাদিকদের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, জেনেভায় তিনি একটি বাংলাদেশ তথ্যকেন্দ্র খুলবেন।

ভারতের রাজধানী দিল্লিতে পাকিস্তান হাইকমিশনে আটক একজন বাঙালি কর্মীর মুক্তির দাবিতে সেই হাইকমিশনের সামনে কয়েকজন বাঙালি দিনব্যাপী অবস্থান ধর্মঘট করেন। ধর্মঘটকারীদের মধ্যে পাকিস্তান হাইকমিশন থেকে আগের দিন পালিয়ে আসা বাঙালি কর্মীরাও ছিলেন। তাঁরা পরদিন দুপুর পর্যন্ত অবস্থান কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন।

মুক্তিযোদ্ধাদের অভিযান

মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তর থেকে ৩ নভেম্বর জানানো হয়, মুক্তিবাহিনী ময়মনসিংহের কিশোরগঞ্জের কিছু এলাকা পাকিস্তানি সেনাদের দখল থেকে মুক্ত করেছে। মুক্তিবাহিনী কটিয়াদী, ইটনা, অষ্টগ্রামসহ কয়েকটি থানায় আক্রমণ করে। তাদের আক্রমণে বহু পাকিস্তানি সেনা, পুলিশ ও রাজাকার হতাহত হয়। মুক্তিবাহিনীর পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, গত এক সপ্তাহে ঢাকা, কুমিল্লা ও নোয়াখালীর বিভিন্ন রণাঙ্গনে অনেক পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সেনাদের বহু অস্ত্রশস্ত্র দখল এবং তিনজন পাঠান সেনা ও ৫৩ জন রাজাকারকে বন্দী করেছেন। ঢাকার মানিকগঞ্জের হরিরামপুরে মুক্তিবাহিনীর হাতে বহু পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়েছে।

১ নম্বর সেক্টরে চট্টগ্রাম বন্দরে মুক্তিবাহিনীর নৌকমান্ডোদের পাতা লিমপেট মাইন বিস্ফোরণের ফলে পাকিস্তানি তেলবাহী জাহাজ মাহতাব জাভেদ নিমজ্জিত হয়। জাহাজের কয়েকজন নাবিকও হতাহত হয়।

২ নম্বর সেক্টরে ঢাকা নগরীর আশপাশে অভিযান চালানোর জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা ভোরে ঢাকার সিদ্ধিরগঞ্জ বিদ্যুৎকেন্দ্রের চারটি জেনারেটর ধ্বংস করে দিলে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, টঙ্গীসহ আশপাশের এলাকা সাময়িকভাবে বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়ে।

এই সেক্টরে ঢাকা নগরীতে অভিযান পরিচালনার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত গেরিলা মুক্তিযোদ্ধারা এদিন ঢাকার কয়েকটি স্থানে অভিযান চালান। একটি দল দুপুর ১২টার দিকে নয়াপল্টন এলাকায় জোনাকী সিনেমা হলের পূর্ব পাশের পলওয়েল মার্কেটে মুসলিম কমার্শিয়াল ব্যাংকে ঢুকে প্রহরীকে নিরস্ত্র করে অস্ত্রের মুখে ব্যাংকের ১৮ হাজার ৪৫৫ টাকা লুটে নিয়ে যায়। দ্বিতীয় দলটি বেলা সাড়ে ১১টায় মৌচাকে ইউনিয়ন ব্যাংকে অভিযান চালিয়ে ৬ হাজার ৯৩১ টাকা লুট করে। তৃতীয় দল শাহজাহানপুরে শান্তি কমিটির সদস্যদের ওপর অভিযান চালিয়ে তিন-চারজনকে হতাহত করে। চতুর্থ দল আরমানিটোলার কাছে অভিযান চালায়।

৮ নম্বর সেক্টরে গণবাহিনী ও ইপিআর সেনার সমন্বয়ে গড়া মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল লেফটেন্যান্ট অলীক গুপ্তের (স্বাধীনতার পর বীর প্রতীক) নেতৃত্বে ভোরের দিকে যশোরের চৌগাছার সীমান্তঘাঁটির সামনে অ্যামবুশ পাতে। সকাল নয়টা থেকে পাকিস্তানের একটা টহল দলের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ শুরু হয়।

তাদের আক্রান্ত হওয়ার খবর পেয়ে চৌগাছা সীমান্তঘাঁটি থেকে আরও পাকিস্তানি সেনা এসে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘিরে ফেলে। মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকেন। খবর পেয়ে সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন নাজমুল হুদা (স্বাধীনতার পর বীর বিক্রম ও কর্নেল) ক্যাম্প থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে এসে যুদ্ধে যোগ দেন। একপর্যায়ে পাকিস্তানি সেনারা পালিয়ে যায়। পাকিস্তানি সেনাদের বেশ কয়েকজন হতাহত হয়। মুক্তিবাহিনীর ইপিআরের একজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন।

কড়া পাহারা এড়িয়ে মুক্তিযোদ্ধারা সিদ্ধিরগঞ্জের বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্রের চারটির মধ্যে তিনটি জেনারেটর বিধ্বস্ত করে দিলে ঢাকার চারপাশের শিল্পাঞ্চলগুলো অকেজো হয়ে পড়ে।

সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর আট; দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ, ৩ ও ৪ নভেম্বর ১৯৭১; দ্য টাইমস, ৩ নভেম্বর ১৯৭১; ইত্তেফাক, ঢাকা, ৪ নভেম্বর ১৯৭১; আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ভারত, ৪ ও ৫ নভেম্বর ১৯৭১

গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান