মুক্তিযুদ্ধের দিনলিপি
শরণার্থীদের জন্য অস্ট্রেলিয়ায় অনশন
অস্ট্রেলিয়ার রাজধানী ক্যানবেরায় পার্লামেন্ট হাউসের সামনে ৫ অক্টোবর তিনজন অনশন শুরু করেন। বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য অস্ট্রেলিয়া সরকার অন্তত এক কোটি ডলার জরুরি সাহায্য না দিলে তাঁরা অনশন চালিয়ে যাবেন বলে জানান। অনশনকারীরা হলেন ইন্দোনেশীয় লেখক পল পেয়ার নোমো, পল ইভান ও মেলবোর্নের স্টিভ রুনি।
ইতালির বিশপ সম্মেলন বাংলাদেশের শরণার্থীদের সাহায্যের জন্য এই দিন এক আবেদনে ১০ অক্টোবর রোববার সারা দেশে অনশন পালনের দিন স্থির করে। ৪ অক্টোবর ষষ্ঠ পোপ পলের এমন একটি আবেদনে উদ্বুদ্ধ হয়ে বিশপ সম্মেলন এ সিদ্ধান্ত নেয়। ভ্যাটিকানের সংবাদপত্র লোসার-ভাতোর রোসাত শরণার্থীদের দুর্দশার কাহিনি জানিয়ে ৪ অক্টোবর তিন পৃষ্ঠার একটি ক্রোড়পত্রও প্রকাশ করে।
ভারত সরকার এদিন জানায়, শেষ সরকারি হিসাব অনুযায়ী ভারতে এখন বাংলাদেশি শরণার্থীর সংখ্যা ৯০ লাখ ৯১ হাজার। শরণার্থী শিবিরগুলোতে কাজ করছেন ৮০০ জন ডাক্তার এবং ২ হাজার জন আধা চিকিৎসক কর্মী। শরণার্থীদের জন্য ৫০টি হাসপাতাল ও ৭০০ মেডিকেল ইউনিট আছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটের পররাষ্ট্র–সম্পর্কিত কমিটি এদিন পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক ও সামরিক সাহায্য স্থগিত রাখার পক্ষে ভোট দেয়। পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা স্বাভাবিক করে তোলার জন্য পাকিস্তান সরকারের সহযোগিতা এবং ভারতে অবস্থানরত বাংলাদেশের শরণার্থীদের দেশে ফেরার ব্যবস্থা না করা পর্যন্ত সাহায্য স্থগিত রাখা হবে। এর আগে আরও কঠোরভাবে পাকিস্তানকে সাহায্য দেওয়া স্থগিত রাখার জন্য আনা একটি সংশোধনী প্রস্তাব ছয়–সাত ভোটে বাতিল হয়ে যায়।
যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটের শরণার্থীবিষয়ক বিচার বিভাগীয় উপকমিটিতে পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থীদের সমস্যা নিয়ে বিতর্কে সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি অভিযোগ করেন, প্রশাসনিক নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে প্রায় ৯০ লাখ ডলার মূল্যের সামরিক সরঞ্জাম দিতে চেয়েছে।
এ অভিযোগের জবাবে মধ্য এশিয়া ও দক্ষিণ এশিয়াসংক্রান্ত দপ্তরের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস্টোফার ভ্যান হোলেন বলেন, মার্চ মাসে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে পাকিস্তানে সমরাস্ত্র সরবরাহের জন্য কাউকে লাইসেন্স দেওয়া হয়নি।
এরপর কেনেডি বলেন, প্রতিরক্ষা দপ্তর আমেরিকান বি-৫৭ বোমারু বিমান, এফ ১০৪ জেট ফাইটার এবং মাইন সুইপারের বিভিন্ন অংশ বিক্রি করতে চেয়েছে। এপ্রিল মাসে বিক্রির প্রস্তাব করা হয় এবং পাকিস্তান জুন মাসে প্রস্তাবটি গ্রহণ করে। পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহের প্রশ্নের মতো মার্কিন নীতির আপসবিরোধী মনোভাব আর কিছুতে দেখা যায়নি। তিনি বলেন, এই উপকমিটি যা জেনেছিল, প্রকৃত ঘটনা তার বিপরীত। জুন মাসেও যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে অতিরিক্ত সামরিক সাহায্য দিয়েছে।
দিল্লির যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস এক প্রেস নোটে জানায়, পাকিস্তানকে সমরাস্ত্র সরবরাহের জন্য কোনো লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে না। পাকিস্তানে অস্ত্র সরবরাহ নিয়ে সিনেটর কেনেডির বক্তব্যের প্রেক্ষাপটে এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের মনোভাব আবার জানানো হলো। তবে দূতাবাস কেনেডির দেওয়া দৃষ্টান্তগুলো সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করেনি।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বাংলাদেশের সমস্যা নিয়ে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার প্রস্তাব ভারত এদিন দৃঢ়তার সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করে জানায়, সমস্যাটি পুরোপুরি পাকিস্তানের তৈরি। পাকিস্তানি প্রতিনিধিদলের নেতা মাহমুদ আলীর এর আগে আনা একটি অভিযোগের উত্তরে জাতিসংঘে ভারতের প্রতিনিধি সমর সেন বলেন, বাংলাদেশের সমস্যা পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সমস্যা। বাংলাদেশে গণহত্যা চালানোর ব্যাপারে ভারত পাকিস্তানকে সহযোগিতা করতে পারে না।
মাহমুদ আলী জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে অভিযোগ করেন, ভারত পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সীমান্তে প্রায় দুই লাখ সেনা সমাবেশ করেছে।
মুক্তিবাহিনীর অভিযান
১ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা এদিন বেলা আনুমানিক ১১টার দিকে ফেনীর ছাগলনাইয়ার অন্তর্গত মহামায়ার পূর্ব দেবপুরে পেট্রলরত পাকিস্তানি বাহিনীকে অ্যামবুশ করেন। এতে একজন পাকিস্তানি সেনা নিহত এবং একজন মারাত্মকভাবে আহত হয়।
এ সেক্টরের আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা ফেনীর পরশুরামের বিলোনিয়ার সীমান্তবর্তী গুতুমায় আবার অভিযান পরিচালনা করেন। সকাল ৮টায় পাকিস্তানি বাহিনীর কিছু সদস্য সীমান্তঘাঁটি থেকে বের হয়ে পরশুরামের দিকে রওনা দিলে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের আক্রমণ করেন। কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার হতাহত হয়।
২ নম্বর সেক্টরের একদল মুক্তিযোদ্ধা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুরের উজান চরের কাছে কয়েকটি বিদ্যুৎ টাওয়ারের তার কেটে পাকিস্তানি বাহিনীর অপেক্ষায় থাকেন। সেনা, রাজাকার ও মুজাহিদদের সমন্বয়ে গড়া পাকিস্তানি বাহিনীর একটি দল লঞ্চে করে সেখানে উপস্থিত হলে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের আক্রমণ করেন। পাকিস্তানি বাহিনীর কয়েকজন হতাহত হয়।
সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ১ ও ২; ইত্তেফাক, ঢাকা ৭ অক্টোবর ১৯৭১; আনন্দবাজার পত্রিকা ও যুগান্তর, কলকাতা, ভারত ৬ ও ৭ অক্টোবর ১৯৭১
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
Also Read
-
খালেদা জিয়াকে দেখতে হাসপাতালে জুবাইদা রহমান
-
শারীরিক অবস্থা ঠিক থাকলে রোববার খালেদা জিয়াকে লন্ডনে নেওয়া হবে
-
মুক্তিযুদ্ধে বিদেশি স্বজনদের কথা
-
ক্ষমতার প্রতি মোহমুক্ত একজন নেলসন ম্যান্ডেলা
-
শেখ হাসিনাকে ফেরত পাঠানোর বিষয়ে ভারত এখনো সাড়া দেয়নি : পররাষ্ট্র উপদেষ্টা