মুক্তিযুদ্ধের দিনলিপি

রাজনৈতিক মীমাংসার আহ্বান কোসিগিনের

সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধানমন্ত্রী আলেক্সি কোসিগিন দেশটিতে সফররত ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সম্মানে মস্কোর ক্রেমলিনে ২৮ সেপ্টেম্বর দেওয়া এক ভোজসভায় বাংলাদেশে রাজনৈতিক মীমাংসার ওপর জোর দিয়ে সেখানকার অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির অবসানের জন্য পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে সবচেয়ে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে আহ্বান জানান। তিনি বলেন, সেখানকার জনগণের আইনসংগত অধিকারের প্রতি লক্ষ্য রেখেই এই মীমাংসা হওয়া চাই। তিনি পাকিস্তান সরকারের সমালোচনা করে বলেন, পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশের ৮০ লাখের বেশি মানুষকে দেশত্যাগে বাধ্য করায় তাদের সমর্থন জানানো অসম্ভব।

ভোজসভায় ইন্দিরা গান্ধী তাঁর ভাষণে দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, এই মর্মান্তিক ঘটনাবলির জন্য আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর কাছ থেকে যে ধরনের সাড়া পাওয়া উচিত ছিল, তা পাওয়া যায়নি। তিনি বলেন, রাজনৈতিক সমাধানে পাকিস্তানকে রাজি করাতে রুশ প্রচেষ্টা প্রশংসনীয়। পূর্ব বাংলার সমস্যার বিস্তারিত উল্লেখ করে তিনি বলেন, পূর্ব বাংলার সমস্যা আদৌ ভারত-পাকিস্তান বিরোধ নয়। এটি একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা। প্রকৃত শান্তির জন্য আন্তর্জাতিক উদ্যোগ জরুরি।

সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধানমন্ত্রী আলেক্স কোসিগিন মস্কোতে একদল ভারতীয় সাংবাদিককে বলেন, বাংলাদেশের শরণার্থীদের নিরাপদে স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের ব্যাপারে ভারতের দাবি ন্যায্য। সোভিয়েত ইউনিয়ন তা সমর্থন করে।

বাংলাদেশ ঘরোয়া সমস্যা নয়

নিউইয়র্কে এ দিন জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের দ্বিতীয় দিনের অধিবেশন শুরু হলে সুইডেন, ফ্রান্স ও সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিনিধিরা বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান চান। তবে এ সমাধান স্বাধীনতার অধিকারসহ আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার বোঝায় কি না, তা তাঁরা স্পষ্ট করে বলেননি। তাঁরা বলেন, মানবাধিকার ও ভোটের মাধ্যমে অভিব্যক্ত জনগণের ইচ্ছার প্রতি সম্মানের ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যার সমাধান হতে পারে।

আন্দ্রে গ্রোমিকো জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বলেন, বাংলাদেশে উদ্ভূত পরিস্থিতি নিছক পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সমস্যা নয়। বাংলাদেশের সমস্যা এবং ওই এলাকায় উত্তেজনা প্রশমনের একটিই পথ, তা হলো বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান।

ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বলেন, পাকিস্তান ভারত-পাকিস্তান বিরোধের অজুহাত সৃষ্টি করে পূর্ব বাংলা থেকে বিশ্বের দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে নিচ্ছে। শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আলোচনা করে ইয়াহিয়া খানের পূর্ব বাংলার সমস্যার সমাধান করা উচিত

বঙ্গবন্ধুর বিচার

পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার সম্পর্কে দীর্ঘ নীরবতা ভঙ্গ করে এ দিন ঘোষণা দেয়, বিশেষ ট্রাইব্যুনালের এজলাসে তাঁর বিচার এখনো চলছে। উপযুক্ত সময়ে রায় জানানো হবে। রাওয়ালপিন্ডির এই ঘোষণা রেডিও পাকিস্তান প্রচার করে। সংবাদে বলা হয়, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার অভিযোগে শেখ মুজিবের বিচার হচ্ছে। ভূতপূর্ব আইনমন্ত্রী এ কে ব্রোহি শেখ মুজিবকে সমর্থন করছেন।

কোথায় শেখ মুজিবের বিচার হচ্ছে, সে সম্পর্কে অবশ্য কোনো কিছু উল্লেখ করা হয়নি।

পাকিস্তানি বর্বরতার প্রতিবাদে

বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের ওপর পাকিস্তানের জঙ্গি শাসকগোষ্ঠীর বর্বরতার প্রতিবাদে ঢাকার বিশ্বব্যাংক প্রতিনিধি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক টাইগারম্যান এ দিন পদত্যাগ করেন। তিনি কলকাতায় এ কথা ঘোষণা করেন।

টাইগারম্যান বলেন, গোটা ঢাকা শহরই বন্দিশালা। সর্বত্র ত্রাস আর আতঙ্ক। টাইগারম্যান এই দিনই বিশ্বব্যাংকের সদর দপ্তরে এক তারবার্তায় তাঁর সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দেন।

মুক্তিবাহিনীর বিমান ইউনিট

ভারতের নাগাল্যান্ডের ডিমাপুরে এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর বিমান ইউনিট ‘কিলো ফ্লাইট’ গঠন করা হয়। অনুষ্ঠানে মুক্তিবাহিনীর উপপ্রধান গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার (স্বাধীনতার পর বীর উত্তম ও এয়ার ভাইস মার্শাল), বাঙালি বৈমানিক ও গ্রাউন্ড ক্রুরা ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন ভারতের বিমানবাহিনীর প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল পি সি লাল, এয়ার মার্শাল এইচ সি দেওয়ানসহ ভারতীয় বিমানবাহিনীর বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। এ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে তিনটি বিমান নিয়ে বিশ্বের ক্ষুদ্রতম বিমানবহর জন্মলাভ করে।

দিল্লির পাকিস্তান হাইকমিশনে কর্মরত চারজন বাঙালি কর্মী এ দিন বাংলাদেশের পক্ষে তাঁদের আনুগত্য প্রকাশ করেন। এই চারজন বাঙালি কর্মীকে সপরিবার এ দিন বাসে করে ইসলামাবাদে পাঠানোর সময় তাঁরা পরিবারসহ নাটকীয়ভাবে সরে গিয়ে আত্মরক্ষা করেন।

সূত্র: একাত্তরের যুদ্ধে বিমানবাহিনী, শ জামান, মুক্তিযোদ্ধা সমন্বয় পরিষদ; ইত্তেফাক, ঢাকা, ২৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭১; আনন্দবাজার পত্রিকাযুগান্তর, কলকাতা, ভারত, ২৯ ও ৩০ সেপ্টেম্বর ১৯৭১

গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান