মুক্তিযুদ্ধের দিনলিপি
রণাঙ্গনেই সমস্যার চূড়ান্ত ফয়সালা
মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পেছনে ছিল দেশ বিদেশের বহু মানুষের একক ও মিলিত প্রচেষ্টা, অজস্র ঘটনা। এখানে রইল একাত্তরের প্রতিটি দিনের বিবরণ।
বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ৮ অক্টোবর এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে বলেন, যুদ্ধক্ষেত্রেই বাংলাদেশ প্রশ্নের সমাধান নিহিত। বাংলাদেশের বীর মুক্তিযোদ্ধারা রণাঙ্গনেই বাংলাদেশ সমস্যার চূড়ান্ত ফয়সালা করবেন। স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি, বঙ্গবন্ধুর নিঃশর্ত মুক্তি, বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অপসারণ এবং পাকিস্তানের সামরিক সরকার বাংলাদেশকে ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করবে—এই চার দাবি পূরণ করা ছাড়া কোনো রাজনৈতিক মীমাংসা সম্ভব নয়। তিনি বলেন, ‘আমাদের যুদ্ধ আমাদেরই করতে হবে, আমাদের স্বাধীনতা আমাদেরই অর্জন করতে হবে।’
বাংলাদেশের কৃষক শ্রমিক সমাজবাদী দল মুজিবনগরে সংবাদ সম্মেলনে জানায়, মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের ছোট–বড় সব দল নিয়ে জাতীয় মুক্তি ফ্রন্ট গঠন করা দরকার। মুক্তিসংগ্রামকে সহায়তার জন্য সম্প্রতি গঠিত উপদেষ্টা কমিটিতে কয়েকটি ছোট দল বা উপদল বাদ পড়ে গেছে। এ ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করে তাজউদ্দীন আহমদের কাছে পাঠানো তারবার্তার কোনো জবাব এখনো পাওয়া যায়নি।
বাংলাদেশের সমর্থনে রাশিয়ায় সমাবেশ
বাংলাদেশে রাজনৈতিক সমাধানের দাবিতে সোভিয়েত ইউনিয়নের রাজধানী মস্কোয় এ দিন শিক্ষক ও ছাত্ররা গণপ্রতিবাদে যোগ দেন। ৭ অক্টোবর রাতে সোভিয়েত নাগরিকেরা টেলিভিশনে বাংলাদেশের শরণার্থীদের দুর্দশার চিত্র দেখেন। এ ছাড়া মস্কোর ছাত্র ও শিক্ষকদের স্থানীয় প্রতিনিধিদের এক বৈঠকে বলা হয়, শেখ মুজিবুর রহমানের গোপন বিচার উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।
সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির পত্রিকা প্রাভদায় প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়, সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বত্র বাংলাদেশের সমর্থনে সভা হচ্ছে।
ব্রিটেনের দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, পাকিস্তান সরকারের বিনা অনুমতিতে বাংলাদেশে ঢুকে দুস্থদের মধ্যে কাপড়চোপড় বিতরণ করার জন্য অপারেশন ওমেগার আরও দুজন কর্মীকে গ্রেপ্তার করে যশোর জেলে পাঠানো হয়। গত আগস্ট মাস থেকে এ পর্যন্ত ওমেগার কর্মীরা মোট ছয়বার বাংলাদেশে গিয়ে সাহায্যসামগ্রী বিতরণের চেষ্টা করেন। এর আগে ১২ জন কর্মীকে গ্রেপ্তার করে কিছুদিন জেলে আটক রাখার পর বাংলাদেশ থেকে বহিষ্কার করা হয়।
দিল্লিতে আকাশবাণীর পক্ষ থেকে এ কে সেন সংবাদ সম্মেলনে জানান, বাংলাদেশের প্রায় দেড় শ সংগীতশিল্পীকে আকাশবাণীর বিভিন্ন কর্মসূচিতে অতিথি শিল্পী হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। তাঁরা ভারতীয় শিল্পীদের সমান অর্থ পাচ্ছেন।
গেরিলা অভিযান
১ নম্বর সেক্টরের কয়েক দল মুক্তিযোদ্ধা এই দিন ফেনীর ছাগলনাইয়ার পূর্বদেবপুর, গুতুমা ও ফুলগাজী থানায় অভিযান পরিচালনা করেন। একটি দল ভোরে পূর্বদেবপুরে অ্যামবুশ করে। সকাল সাড়ে আটটার দিকে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি টহল দল অ্যামবুশের মধ্যে এলে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের ওপর আক্রমণ চালাস। দুই পক্ষের যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর কয়েকজন হতাহত হয়। এই অভিযান পরিচালনার সময় মুক্তিবাহিনীর ১ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম (স্বাধীনতার পর বীর উত্তম ও মেজর) উপস্থিত ছিলেন। যুদ্ধে তিনি সামান্য আহত হন।
এই সেক্টরের অন্য একদল মুক্তিযোদ্ধা গুতুমা-পূর্বদেবপুরে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থানে আক্রমণ করেন। সন্ধ্যায় গুতুমায় আরেকটি দলের আকস্মিক আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনীর কয়েকজন হতাহত হয়। ভিন্ন আরেকটি দল ফুলগাজীতে অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনাদের অ্যামবুশ করলে কয়েকজন হতাহত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের কারও ক্ষতি হয়নি।
রাজাকারদের কাছে খবর পেয়ে পাকিস্তানি সেনারা রামনগরে ২ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের গোপন অবস্থানে হামলা করে। কয়েকজন সেনা ও রাজাকার নিহত হয়। একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ এবং দুজন আহত হন।
এই অঞ্চলের আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর একটি দলকে অ্যামবুশ করলে কয়েকজন হতাহত হয়।
২ নম্বর সেক্টরের কুমিল্লা অঞ্চলের আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা জামবাড়ি এলাকার একটি সুবিধাজনক স্থানে অ্যামবুশ করে পাকিস্তানি বাহিনীর অপেক্ষায় থাকেন। পাকিস্তানি সেনারা কাছাকাছি আসা মাত্র তাঁরা আক্রমণ করেন। পাকিস্তানি বাহিনীর কয়েকজন হতাহত হয়।
এই সেক্টরের অন্য এক দল মুক্তিযোদ্ধা দত্তসর ও গাবতলা এলাকায় অ্যামবুশ করলে পাকিস্তানি সেনাদলের দুজন হতাহত হয়। এই সেক্টরের আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা রাতে পাকিস্তানিদের ঘাঁটির কয়েকটি অবস্থানে তিন দিক থেকে অতর্কিতে আক্রমণ চালান। পাকিস্তানি সেনা, মিলিশিয়া ও রাজাকাররা দুটি অবস্থান ত্যাগ করে অবশিষ্ট ঘাঁটিতে আশ্রয় নেয়। তারা সংগঠিত হয়ে পাল্টা আক্রমণ শুরুর আগেই মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদ স্থানে চলে আসেন।
৮ নম্বর সেক্টরের একদল মুক্তিযোদ্ধা ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী মথুরানগরে অবস্থানরত পাকিস্তানি বাহিনীর দলকে আক্রমণ করেন। যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর কয়েকজন হতাহত হয়। তিনজন মুক্তিযোদ্ধাও আহত হন। এই সেক্টরের সীমান্ত এলাকার কিমখোলায় গণবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধাদের একটি ক্যাম্প ছিল। পাকিস্তানি বাহিনী তাতে হামলা করে। এতে একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। একজন মুক্তিযোদ্ধাকে পাকিস্তানি বাহিনী আটক করে।
সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর এক, দুই ও আট; দ্য গার্ডিয়ান, লন্ডন, যুক্তরাজ্য, ৮ অক্টোবর ১৯৭১; ইত্তেফাক, ঢাকা, ৯ অক্টোবর ১৯৭১; আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ভারত ৯ ও ১০ অক্টোবর ১৯৭১
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
Also Read
-
অভিনেত্রী শমী কায়সার গ্রেপ্তার
-
মার্চ-এপ্রিলে নির্বাচনের দাবিতে কর্মসূচি শুরুর চিন্তা বিএনপির
-
চট্টগ্রামে ফেসবুক পোস্টকে ঘিরে সংঘর্ষ, ফাঁকা গুলি, সাত পুলিশ সদস্য আহত
-
সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা এখনো আক্রমণের মুখে: সম্পাদক পরিষদ
-
প্রাথমিক ভোট গণনার ফল যে কারণে বিভ্রান্তিকর হতে পারে