মুক্তিযুদ্ধের দিনলিপি
যুদ্ধ ছাড়া সমাধানে ইন্দিরার সংশয়
মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পেছনে ছিল দেশ-বিদেশের বহু মানুষের একক ও মিলিত প্রচেষ্টা, অজস্র ঘটনা। এখানে রইল একাত্তরের প্রতিটি দিনের বিবরণ।
তিন সপ্তাহের বিদেশ সফর শেষে ১৩ নভেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী দিল্লির পালাম বিমানবন্দরে নেমে সাংবাদিকদের বলেন, যুদ্ধ ছাড়া বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান সম্ভব কি না, সেটাই এখন প্রশ্ন। রাজনৈতিক সমাধান অবশ্যই বাংলাদেশের জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে হবে। নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই শুধু কোনো প্রস্তাব গ্রহণ বা অগ্রাহ্য করতে পারেন। শেখ মুজিবকে আলোচনায় ডাকা না হলে বাংলাদেশের নেতারা ইয়াহিয়ার সঙ্গে আদৌ কথা বলবেন কি না, তাতে সন্দেহ আছে।
ইন্দিরা গান্ধী বলেন, যুক্তরাষ্ট্র যদিও পাকিস্তানকে অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করার কথা বলেছে, তবু তৃতীয় কোনো দেশের মাধ্যমে পাকিস্তান আমেরিকার অস্ত্র পাবে কি না, সে ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত নন।
ভারতের আসাম রাজে৵র মুখ্যমন্ত্রী মহেন্দ্রমোহন চৌধুরী বলেন, স্থানীয় জনসাধারণ ও শরণার্থীদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করে স্বার্থসিদ্ধির মতলব আঁটছে স্বার্থান্বেষীরা। বাংলাদেশ সমস্যার সমাধানে দেরি হলে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটবে।
নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় এ দিন প্রকাশিত সম্পাদকীয় নিবন্ধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে একটা সমঝোতায় আসার জন্য ইয়াহিয়া সরকারের ওপর প্রভাব সৃষ্টি করতে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কাছে অনুরোধ জানানো হয়। সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনের আচরণ পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলছে। যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্যপুষ্ট ইয়াহিয়া সরকার পূর্ববঙ্গে যে ভয়ংকর অত্যাচার চালিয়েছে, তার প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র না দেওয়ার সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত অতি সামান্য পদক্ষেপ। সেই অস্ত্রে বাঙালিদের ওপর চালানো অত্যাচারের জন্য যুক্তরাষ্ট্রও দায়ী।
মাইন বিস্ফোরণে কূটনীতিক নিহত
নারায়ণগঞ্জে অভিযান চালানোর জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত গেরিলাদের (২ নম্বর সেক্টরের অধীন) একটি দল এ দিন ভোরে পাকিস্তানি বাহিনীর যান চলাচলে বাধা দিতে সোনারগাঁয়ের কাছে ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়কে মাইন পুঁতে রাখেন। সে মাইন বিস্ফোরণে ঢাকার পশ্চিম জার্মান কনস্যুলেটের একজন কূটনীতিক এবং একজন কর্মকর্তা নিহত হন।
এই সেক্টরে সালদা নদী এলাকায় মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানে হামলা করলে তারাও পাল্টা আক্রমণ করে। দুই পক্ষের তুমুল যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর কয়েকজন হতাহত হয়।
৬ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা দিনাজপুরের খানপুরে পাকিস্তান সেনাবাহিনী, রাজাকার ও ইস্ট পাকিস্তান সিভিল আর্মড ফোর্সের (ইপিসিএফ) সেনাদের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড লড়াই করে খানপুর সীমান্তঘাঁটি দখল করেন। অভিযানে বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার হতাহত হয়। পাকিস্তানিরা পিছু হটে আবার সংগঠিত হয়ে ফিরে এসে সীমান্তঘাঁটি দখলের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়।
এই সেক্টরের হিলির ভারতীয় অংশে পাকিস্তান সেনাবাহিনী গুলিবর্ষণ করতে থাকলে মুক্তিযোদ্ধারাও তার পাল্টা জবাব দেন।
৮ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা প্রথম প্রহরে ক্যাপ্টেন মোস্তাফিজুর রহমানের (স্বাধীনতার পর বীর বিক্রম, জেনারেল ও সেনাপ্রধান) নেতৃত্বে চুয়াডাঙ্গার জীবননগরের ধোপাখালী সীমান্তঘাঁটিতে পাকিস্তানি অবস্থানে আক্রমণ করেন। এখানে ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৩৮ ফ্রন্টিয়ার ফোস৴ রেজিমেন্টের প্রায় এক কোম্পানি সেনাসহ রাজাকার ও মিলিশিয়াদের দল। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের একপর্যায়ে ক্যাপ্টেন মোস্তাফিজুর আহত হন। তারপরও যুদ্ধে নেতৃত্ব দিতে থাকেন। এই যুদ্ধে ধোপাখালী সীমান্তঘাঁটি মুক্ত হয়। যু্দ্ধে প্রায় ২০ জন পাকিস্তান সেনা ও রাজাকার হতাহত হয়।
এই সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা দর্শনায় পাকিস্তান বাহিনীর অবস্থানে আক্রমণ করলে দুই পক্ষে তুমুল যুদ্ধ হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের গোলায় দর্শনা রেলস্টেশনের একাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
অবরুদ্ধ বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে
যুক্তরাষ্ট্রের ত্রাণসংক্রান্ত কর্মকর্তারা এদিন ঢাকায় বার্তা সংস্থা এপির প্রতিনিধির কাছে বলেন, বাঙালি মুক্তিযোদ্ধারা এই প্রথম মাইন দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া একটি জাহাজে বিস্ফোরণ ঘটিয়েছেন। ত্রাণের জন্য খাদ্যশস্যবাহী এই জাহাজে জাতিসংঘের পতাকা ছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে ত্রাণ কর্মসূচি পরিচালনা জটিল হয়ে পড়েছে। ইতিমধ্যে ৫০ লাখ ডলার মূলে৵র খাদ্য নষ্ট হতে বসেছে।
ঢাকা থেকে এ দিন দ্য সানডে টেলিগ্রাফ-এর সংবাদদাতার পাঠানো খবরে বলা হয়, পূর্ববঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অনায়ত্ত এলাকায় জাতিসংঘের ত্রাণ বিতরণ করা সম্ভব নয় বলে সহকারী মহাসচিব মার্ক হেনরি মনে করেন। পরিস্থিতি সম্পর্কে মহাসচিব উ থান্টের কাছে রিপোর্ট দেওয়ার জন্য সফরসূচি সংক্ষিপ্ত করে তিনি এ দিন নিউইয়র্কে রওনা হন।
পাকিস্তানি সেনা এবং তাদের সহযোগীদের নিয়ে গড়া একটি বিরাট বাহিনী ভারতের নদীয়া জেলার শিকারপুর সীমান্ত দিয়ে ভারতে ঢুকে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে আক্রমণ করে। মুক্তিযোদ্ধারা ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সহায়তায় পাল্টা আক্রমণ চালিয়ে তাদের প্রতিরোধ করেন। তুমুল যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর বেশ কয়েকজন হতাহত হয়।
পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পাটি৴র সভাপতি নুরুল আমিন লাহোরে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে হুঁশিয়ারি দেন, পাকিস্তান পিপলস পাটি৴র চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টোকে যেন পাকিস্তানের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রীর পদে নিয়োগের চেষ্টা না করা হয়। পরবর্তী প্রধানমন্ত্রীর পদ প্রাপ্য পূর্ব পাকিস্তানের।
সূত্র: স্বাধীনতাসংগ্রামে প্রবাসী বাঙালি, আবদুল মতিন, র্যাডিক্যাল পাবলিকেশনস, লন্ডন, যুক্তরাজ্য; ইত্তেফাক, ঢাকা, ১৪ নভেম্বর ১৯৭১; আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ভারত, ১৪ ও ১৫ নভেম্বর ১৯৭১
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
Also Read
-
ট্রাম্প ১৭৮, কমলা ৯১
-
পেনসিলভানিয়ায় জিতলেই আমরা জিতে যাব: ট্রাম্প
-
অভিনেত্রী শমী কায়সার গ্রেপ্তার
-
মার্চ-এপ্রিলে নির্বাচনের দাবিতে কর্মসূচি শুরুর চিন্তা বিএনপির
-
বাংলাদেশের স্বস্তি নাকি শঙ্কার সিরিজ