মুক্তিযুদ্ধের দিনলিপি
যশোর অভিমুখে মুক্তিবাহিনী
মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পেছনে ছিল দেশ-বিদেশের বহু মানুষের একক ও মিলিত চেষ্টা, অজস্র ঘটনা। এখানে রইল একাত্তরের প্রতিটি দিনের বিবরণ।
যশোরে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের চৌগাছায় ২২ নভেম্বর মুক্তিবাহিনী চৌগাছার বিরাট এলাকা মুক্ত করে যশোর শহরের দিকে এগোয়। পাকিস্তানি বিমান যশোরে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত পেরিয়ে বয়রায় আসামাত্র ভারতীয় বিমানও আকাশে ওড়ে। বিমানযুদ্ধে তিনটি পাকিস্তানি বিমান বিধ্বস্ত হয়। দুই পাইলট খলিল আহমদ খান ও পারভেজ মেহেদি কোরেশি ভারতে বন্দী হন। পাকিস্তানি বাহিনী ১৩টি ট্যাংক, ৩টি বিমান এবং বেশ কিছু সেনা হারিয়ে শার্শার নাভারনে আশ্রয় নেয়। মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সেনাবাহিনী তাদের পিছু নিয়ে শার্শা সদর পর্যন্ত এগিয়ে গিয়ে সেখানেই ঘাঁটি গাড়ে।
২ নম্বর সেক্টরে রাতে কসবা রেলস্টেশন থেকে তিন মাইল উত্তরে চন্দ্রপুর পাকিস্তানি ঘাঁটিতে মুক্তিবাহিনী ভারতীয় বাহিনীর সহায়তায় হামলা করে। পাকিস্তানি বাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থান সুবিধাজনক স্থানে ছিল। চন্দ্রপুরের লাগোয়া লাটুমুড়া পাহাড়ে ছিল পাকিস্তানিদের আরেকটি প্রতিরক্ষা অবস্থান। সেখান থেকে তারা পাল্টা আক্রমণ চালিয়ে মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় সেনাদের যথেষ্ট ক্ষতি করে। ভারতীয় বাহিনীর একজন কোম্পানি কমান্ডার শিখ মেজর, তিনজন জুনিয়র কমিশন্ড কর্মকর্তাসহ ৪৫ জন সেনা এবং মুক্তিবাহিনীর নবীন সেনা কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট খন্দকার আজিজুল ইসলামসহ (স্বাধীনতার পর মরণোত্তর বীর বিক্রম) ২২ জন শহীদ হন। আহত হন প্রায় ৩৪ জন। মুক্তিবাহিনী ভারতীয় বাহিনীর সহায়তায় গভীর রাতে চন্দ্রপুর দখল করলেও পাকিস্তানি বাহিনী চন্দ্রপুর পুনর্দখল করে নেয়।
এই সেক্টরে ঢাকা শহরে অভিযান পরিচালনার জন্য বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত গেরিলাযোদ্ধাদের একটি দল বনগ্রাম এলাকায় বোমা বিস্ফোরণ ঘটায়। পাকিস্তানি সমর্থকদের মনে ঘটনাটি আতঙ্ক সৃষ্টি করে। রামপুরায় আরেক দলের হামলায় একজন পাকিস্তানি বাহিনীর একজন সহযোগী গুরুতর আহত হয়। হাসপাতালে নেওয়ার পর সে মারা যায়।
৪ ও ৫ নম্বর সেক্টরের সিলেট অঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর জেড ফোর্সের প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট আটগ্রাম-কানাইঘাট-চরখাই-সিলেট অক্ষ বরাবর অগ্রসর হচ্ছিল। এদিন তারা সুরমা নদীর তীর ধরে এগিয়ে গৌরীপুরে পৌঁছায়। দলটির আলফা ও ব্রাভো কোম্পানি সুরমার দক্ষিণ তীরে এবং চার্লি ও ডেলটা কোম্পানি সুরমার উত্তর তীরে অবস্থান নেয়।
প্রথম ইস্ট বেঙ্গল গৌরীপুরে পৌঁছালে কানাইঘাটে নিয়োজিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের আলফা কোম্পানি তাদের প্রতিরক্ষা অবস্থান ছেড়ে গৌরীপুরে এগিয়ে গিয়ে প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সামনের দিকের দুটি কোম্পানিকে ঘিরে ফেলে। প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের চার্লি ও ডেলটা কোম্পানি সুরমার উত্তর তীরে অবস্থান নিয়েছিল।
সিলেট শহরে চূড়ান্ত আঘাত হানার ক্ষেত্রে প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের যেন শক্তিক্ষয় না হয়, সে জন্য ৪ নম্বর সেক্টরের অধীনে থাকা ৪ কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধাকে কানাইঘাট দখলের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। এই সেক্টরের একটি কোম্পানি দরবস্ত-কানাইঘাট রোডে এবং আরেকটি কোম্পানিকে চরখাই-কানাইঘাট রোডে অবস্থান নিতে বলা হয়। তাদের দায়িত্ব ছিল পাকিস্তানিদের শক্তি সঞ্চয়ে বাধা দেওয়া এবং কানাইঘাট থেকে পাকিস্তানিদের পিছু হটতে না দেওয়া। বাকি দুই কোম্পানি সুরমা নদী পেরিয়ে কানাইঘাট আক্রমণের প্রস্তুতি শুরু করে।
৬ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি আলাদা দল অমরখানা ও জগদলহাটে আক্রমণ করে। ভারতীয় আর্টিলারিও পাকিস্তানি ঘাঁটিতে বোমা ফেলে। মুক্তিযোদ্ধাদের তীব্র আক্রমণ এবং ভারতীয় বাহিনীর বোমাবর্ষণের মুখে পাকিস্তানি বাহিনী পিছু হটে যায়। অমরখানা ও জগদলহাট মুক্ত হয়।
খুলনা অঞ্চলে মুক্তিবাহিনী দেশের ভেতরে দ্রুত এগিয়ে গিয়ে সীমান্তের বসন্তপুরে পাকিস্তানি ঘাঁটি দখল করের আরও এগিয়ে যায়।
নুরুল আমিন স্থায়ীভাবে লাহোরে
পশ্চিম পাকিস্তানের স্থানীয় সংবাদপত্রের বরাতে ইত্তেফাক জানায়, কোয়ালিশন দলের প্রধান নুরুল আমিন পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে না গিয়ে স্থায়ীভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের লাহোরেই বাস করতে পারেন।
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান শিয়ালকোটে সীমান্ত অঞ্চল এবং লাহোরে নিয়োজিত সেনাদল পরিদর্শন করেন। শিয়ালকোটে সেনাপ্রধান জেনারেল আবদুল হামিদ খান তাঁর সঙ্গে ছিলেন।
অধিকৃত বাংলাদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ এ কে নিয়াজি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সেনাবাহিনীর স্থাপনাগুলো পরিদর্শন করেন।
অধিকৃত বাংলাদেশে পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষের নির্দেশে পূর্ব পাকিস্তান সড়ক পরিবহন সংস্থার আন্তজেলা কোচ সার্ভিস অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করা হয়। পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনসের ঢাকা ও মফস্বল শহরের সঙ্গে সংযোগ রক্ষাকারী অভ্যন্তরীণ সার্ভিসও বাতিল করা হয়।
মানুষের প্রতি মানুষের অমানুষিক ব্যবহার
ভারতে সফররত সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী লি কুয়ান ইউ রাতে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী আয়োজিত ভোজসভায় যোগ দেন। ভারত সরকারের সামনে যে কঠিন কর্তব্য রয়েছে, তা শান্তিপূর্ণভাবেই তা সম্পন্ন হবে বলে সেখানে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
দিল্লি থেকে ফিন্যান্সিয়াল টাইমস-এর এক খবরে বলা হয়, ইন্দিরা গান্ধী ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন। ১৯ নভেম্বর এক বক্তৃতায় ইয়াহিয়া খান ভারতের প্রতি বন্ধুত্বের হাত প্রসারিত করার কথা উল্লেখ করে বলেছিলেন, ভারত তা সৎ প্রতিবেশীসুলভ মনে গ্রহণ করবে। ইন্দিরা বলেন, আন্তরিকতার প্রমাণ হিসেবে শেখ মুজিবকে প্রথমে মুক্তি দেওয়া উচিত।
সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, দলিলপত্র, দশম খণ্ড; ইত্তেফাক, ঢাকা, ২৩ নভেম্বর ১৯৭১; আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ভারত, ২৩ ও ২৪ নভেম্বর ১৯৭১; ফিন্যান্সিয়াল টাইমস, ২৩ নভেম্বর, ১৯৭১
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
Also Read
-
অভিনেত্রী শমী কায়সার গ্রেপ্তার
-
মার্চ-এপ্রিলে নির্বাচনের দাবিতে কর্মসূচি শুরুর চিন্তা বিএনপির
-
চট্টগ্রামে ফেসবুক পোস্টকে ঘিরে সংঘর্ষ, ফাঁকা গুলি, সাত পুলিশ সদস্য আহত
-
সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা এখনো আক্রমণের মুখে: সম্পাদক পরিষদ
-
প্রাথমিক ভোট গণনার ফল যে কারণে বিভ্রান্তিকর হতে পারে