মুক্তিযুদ্ধের দিনলিপি
মুক্তিবাহিনী এখন ভীষণ মারমুখী
মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পেছনে ছিল দেশ বিদেশের বহু মানুষের একক ও মিলিত প্রচেষ্টা, অজস্র ঘটনা। এখানে রইল একাত্তরের প্রতিটি দিনের বিবরণ।
মুজিবনগরে বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তরের একজন মুখপাত্র ১৬ অক্টোবর দেশি-বিদেশি সাংবাদিকের জানান, মুক্তিবাহিনীর পূর্ণ ও স্বল্প প্রশিক্ষিত মুক্তিযোদ্ধারা এখন ভীষণ মারমুখী। শুধু গেরিলা লড়াই, অ্যামবুশ বা চোরাগোপ্তা গুলি চালানো নয়, সম্মুখসমরের জন্যও তাঁরা তৈরি। প্রতিটি সেক্টরেই মুক্তিবাহিনী সক্রিয় হয়ে উঠেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পাকিস্তানিরা হারছে। মুক্তিযোদ্ধারা উড়িয়ে দিচ্ছেন রেললাইন ও সেতু। পাকিস্তানি সেনাবাহী ট্রেনের ওপর নিয়মিত আঘাত হানছে। বিভিন্ন স্থানে এতটাই তাঁদের সফলতা যে পাকিস্তানি সেনারা ট্রেনে চড়তে ভয় পাচ্ছে। রাতে কোনো ট্রেন চলছে না।
মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তর থেকে আরও দুটি খবর দেওয়া হয়। একটি হলো বঙ্গবন্ধুর নামে মুক্তিবাহিনীর নিজস্ব নৌবহর সংগঠিত হয়েছে। আপাতত তাতে আছে পাকিস্তানি বাহিনীর কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া পাঁচটি মোটর বোট। দ্বিতীয়টি হলো, বাংলাদেশের বিমান সেনা ও বৈমানিকদের নিয়ে বিমান ইউনিট গঠন। আগে এঁরা পাকিস্তান বিমানবাহিনী এবং পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনসের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ইউনিটের জন্য বিমান সংগ্রহ করা হয়েছে। এখন চলছে প্রশিক্ষণ।
গেরিলা অভিযান
১ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা ভারত সীমান্তবর্তী ফেনীর জগন্নাথ সোনাপুর গ্রামে এই দিন পাকিস্তানি বাহিনীকে অ্যামবুশ করেন। আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা ফেনী নদীর পূর্ব তীরে চট্টগ্রামের পশ্চিম অলিনগরে পাকিস্তানি বাহিনীর আরেকটি দলকে অ্যামবুশ করেন। দুই হামলায় কিছু সেনা ও রাজাকার হতাহত হয়।
২ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি দল ১৬ অক্টোবর বিকেলে পাকিস্তানি বাহিনীর সালদা ঘাঁটিতে অতর্কিতে আক্রমণ চালিয়ে নিরাপদে নিজেদের অবস্থানে ফিরে যায়।
৫ নম্বর সেক্টরে সুনামগঞ্জের ছাতকে ১৪ অক্টোবর সূচিত হওয়া যুদ্ধ ১৬ অক্টোবরও অব্যাহত থাকে। এ দিন সকালে মুক্তিবাহিনীর জেড ফোর্সের তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের আলফা ও ব্রাভো কোম্পানির ঠিক পেছনের টিলায় পাকিস্তানি বাহিনী অবস্থান নিতে শুরু করে। পরে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে আলফা কোম্পানির মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। ব্রাভো কোম্পানি আলফা কোম্পানিকে ফায়ার সাপোর্ট দেয়। সন্ধ্যার মধ্যে সিমেন্ট ফ্যাক্টরি এলাকা আলফা ও ব্রাভো কোম্পানির দখলে চলে আসে।
তবে আলফা ও ব্রাভো কোম্পানির ঠিক পেছনের টিলাগুলোতে দিনভর পাকিস্তানের সেনাসমাবেশ আলফা অধিনায়ককে চিন্তিত করে রাখে। সন্ধ্যার পরই তিনি সার্বিক অবস্থা পর্যালোচনার জন্য ব্রাভো কোম্পানির অবস্থানে পৌঁছান। আলফা ও ব্রাভো কোম্পানির সঙ্গে চার্লি ও ডেলটা কোম্পানির কোনো যোগাযোগ ছিল না। আলফা ও ব্রাভো কোম্পানি শত্রুর বেষ্টনীর মধ্যে পড়ে গিয়েছিল। এ অবস্থায় তারা অবস্থান ছেড়ে পেছনে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। আলফা ও ব্রাভো কোম্পানির মুক্তিযোদ্ধারা গণবাহিনীর সহায়তায় কোথাও হাঁটুপানি, কোথাও গলাপানি পার হয়ে পেছনে বালিউরার উদ্দেশে রওনা দেন।
৬ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি দল ঠাকুরগাঁও ও লালমনিরহাটে ভারত সীমান্তবর্তী পাকিস্তানি বাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থানের ওপর অভিযান চালায়।
৮ নম্বর সেক্টরভুক্ত এলাকার ভারত সীমান্তের কাছে সাজালিতে একটি বড় যুদ্ধ সংঘটিত হয়। কিছুদিন আগে সাজালি গ্রাম ও এর পার্শ্ববর্তী কিছু এলাকা মুক্ত ঘোষণা করে মুক্তিযোদ্ধারা সেখানে একটি ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করেন। খবর পেয়ে সেনা ও রাজাকারের সমন্বয়ে গড়া পাকিস্তানি বাহিনীর একটি বড় দল এই দিন মুক্তিযোদ্ধাদের সাজালি ক্যাম্পে আক্রমণ করে। যুদ্ধে বেশ কয়েকজন সেনা ও রাজাকার হতাহত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের কেউ হতাহত হননি।
আক্রমণের জন্য ভারত প্রস্তুত
ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম দিল্লিতে ১৬ অক্টোবর নব কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় পার্লামেন্টারি বোর্ডের সভায় বলেন, পাকিস্তান মরিয়া হয়ে গেরিলা আক্রমণ করলে ভারতও সমুচিত জবাব দিতে পুরোপুরি তৈরি। বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীসহ আরও কয়েকজন মন্ত্রী এবং নব কংগ্রেসের সভাপতি সঞ্জিবায়া উপস্থিত ছিলেন।
ভারত সীমান্তে বিপুল পাকিস্তানি সেনা সমাবেশের খবরটি ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র এ দিন সাংবাদিকদের জানান। গত কয়েক দিন সীমান্ত পেরিয়ে যাঁরা ভারতে এসেছেন তাঁরা জানান, সীমান্তের দিকে প্রতিদিন বহু ট্রেন ভারী সাজসরঞ্জাম নিয়ে যাচ্ছে। অসামরিক গাড়িগুলোও সেনা বহনের কাছে লাগানো হয়েছে।
সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর এক, দুই, ছয় ও আট; সম্মুখযুদ্ধ ১৯৭১: মুক্তিযোদ্ধাদের কলমে, সম্পাদনা মতিউর রহমান, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা; ইত্তেফাক, ঢাকা, ১৭ অক্টোবর ১৯৭১; আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ভারত ১৭ ও ১৮ অক্টোবর ১৯৭১
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
Also Read
-
চিকিৎসকেরা নিশ্চিত করলেই খালেদা জিয়াকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হবে: মির্জা ফখরুল
-
যেকোনো মূল্যে দনবাস দখল করব: পুতিন
-
সেক্টর গঠন করে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে
-
হাসপাতালে শাশুড়ি খালেদা জিয়াকে দেখে ধানমণ্ডিতে বাবার বাড়িতে জুবাইদা রহমান
-
প্রযুক্তিগত সমস্যায় প্রথম আলোর ওয়েবসাইট প্রায় ২০ মিনিট বন্ধ ছিল