মুক্তিযুদ্ধের দিনলিপি
মুক্তাঞ্চলে তাজউদ্দীনের সঙ্গে ব্রিটিশ এমপির সাক্ষাৎ
মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পেছনে ছিল দেশ-বিদেশের বহু মানুষের একক ও মিলিত চেষ্টা, অজস্র ঘটনা। এখানে রইল একাত্তরের প্রতিটি দিনের বিবরণ।
বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ২৩ এপ্রিল যুক্তরাজ্যের সাংসদ ব্রুস ডগলাস–মানকে সাক্ষাৎ দেন। যশোরের বেনাপোলে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটিতে তাঁরা এক ঘণ্টা আলোচনা করেন।
খুলনা, যশোর, কুষ্টিয়াসহ বৃহত্তর দক্ষিণ–পশ্চিমাঞ্চলে প্রতিরোধযুদ্ধে অংশ নেওয়া মুক্তিযোদ্ধারা সেদিন ভারত সীমান্তসংলগ্ন বেনাপোল এলাকায় সমবেত হয়ে বিভিন্ন স্থানে প্রতিরক্ষা অবস্থান গড়ে তোলেন। তাজউদ্দীন আহমদ এই প্রতিরক্ষা অবস্থানের ভেতরে ডগলাস-মানকে সাক্ষাৎ দেন।
বেনাপোলে তাজউদ্দীন আহমদের উপস্থিতির খবর পেয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি বিরাট দল সেখানে দ্রুত এসে হামলা করে। মুক্তিযোদ্ধাদের মূল ঘাঁটি ছিল ভারতের সীমান্তবর্তী কাগজপুকুর গ্রামে। পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর ভয়াবহ যুদ্ধ হয় কাগজপুকুরে। দীর্ঘ ছয় ঘণ্টার যুদ্ধের পর পিছু হটতে বাধ্য হয় পাকিস্তানি সেনারা। পাকিস্তানিদের প্রায় ৫০ জন নিহত এবং অনেক আহত হয়। মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন ১৬ জন। পাকিস্তানি বাহিনী রাতে দ্বিতীয় দফা হামলা করলে মুক্তিযোদ্ধারা ভারতে সরে যান।
যুক্তরাজ্যের কমন্স সভায় এই দিন লেবার পার্টির সদস্য এবং অর্থনৈতিক সাহায্যবিষয়ক কমিটির সাবেক সচিব পিটার সোর বলেন, পূর্ব বাংলায় পাকিস্তান সরকারের আচরণ নীতিবহির্ভূত ও বন্য। লেবার পার্টিকে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে সব রকম অর্থনৈতিক ও সামরিক সাহায্য দ্রুত বন্ধ করার জন্য সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে অনুরোধ জানান।
পাকিস্তান সরকার এদিন কলকাতায় পাকিস্তানের উপহাইকমিশন বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে একই সঙ্গে ঢাকায় ভারতীয় উপহাইকমিশন বন্ধ করে দিতে ভারত সরকারের প্রতি আহ্বান জানায়। কার্যত কলকাতায় পাকিস্তানের উপহাইকমিশনের অস্তিত্ব ছিল না। ১৮ এপ্রিল কলকাতায় নিযুক্ত পাকিস্তানের উপহাইকমিশনার হোসেন আলী তাঁর সব বাঙালি সহকর্মীকে নিয়ে বাংলাদেশের পক্ষে আনুগত্য প্রকাশ করেছিলেন।
বাংলাদেশের ভেতরে
ঢাকায় সামরিক কর্তৃপক্ষ ঘোষণা করে, ময়মনসিংহ, জামালপুর, বগুড়া ও গাইবান্ধা এলাকা পাকিস্তান সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। সিলেট শহরে এই দিনে শান্তি কমিটির মিছিল বের করা হয়। মিছিলে লোকের তেমন উপস্থিতি ছিল না।
পূর্বাঞ্চলে চট্টগ্রামের হিঙ্গুলিতে এই দিন পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ হয়। ২১ এপ্রিল রাতে হিঙ্গুলি সেতু ধ্বংস করে মুক্তিযোদ্ধারা মস্তাননগর থেকে পিছু হটে হিঙ্গুলিতে অবস্থান নিয়েছিলেন। ২২ এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনী ট্যাংক ও সাঁজোয়া যান নিয়ে হিঙ্গুলি সেতুর কাছাকাছি চলে আসে। বিধ্বস্ত সেতুর কাছে তারা থেমে যায়।
ক্যাপ্টেন অলি আহমদের (পরে বীর বিক্রম, কর্নেল, সাংসদ ও মন্ত্রী) নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা কয়েক দিন ধরে হিঙ্গুলিতে যুদ্ধ করছিলেন। তাদের সহায়তা করতে ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম (পরে বীর উত্তম, মেজর, সাংসদ ও মন্ত্রী) একদল মুক্তিযোদ্ধাসহ হিঙ্গুলিতে আসেন।
২৩ এপ্রিল পাকিস্তানি সেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর তীব্র আক্রমণ চালায়। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে ভারী অস্ত্র না থাকায় পাকিস্তানি আক্রমণ প্রতিরোধ করা তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। পাকিস্তানি আর্টিলারি আক্রমণের মুখে মুক্তিযোদ্ধারা ২৩ এপ্রিল টিকে থাকতে পারলেও পরদিন তাঁরা অবস্থান ছেড়ে মহালছড়ি চলে যান।
পাকিস্তানি বাহিনীর আরেকটি দল রাঙামাটি থেকে মহালছড়ির দিকে যাত্রা করে। পথে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ হলে তাদের মহালছড়ি যাত্রা শ্লথ হয়ে যায়।
উত্তরাঞ্চলে পাকিস্তানি সেনারা লালমনিরহাট থেকে কুড়িগ্রামের দিকে এগোয়। পাকিস্তানিদের তীব্র আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটেন। নওগাঁয় বেশ কয়েকজন বাঙালি শহীদ হন। পাকিস্তানি বাহিনী লাকসামেও নারকীয় হত্যাকাণ্ড চালায়।
সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: দলিলপত্র, ত্রয়োদশ খণ্ড; বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর এক, দুই, সাত, আট; রক্তে ভেজা একাত্তর, মেজর হাফিজ উদ্দিন আহমদ বীর বিক্রম, সাহিত্য প্রকাশ; দৈনিক পাকিস্তান, ২৪ এপ্রিল ১৯৭১
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
Also Read
-
চিকিৎসকেরা নিশ্চিত করলেই খালেদা জিয়াকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হবে: মির্জা ফখরুল
-
যেকোনো মূল্যে দনবাস দখল করব: পুতিন
-
সেক্টর গঠন করে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে
-
হাসপাতালে শাশুড়ি খালেদা জিয়াকে দেখে ধানমণ্ডিতে বাবার বাড়িতে জুবাইদা রহমান
-
প্রযুক্তিগত সমস্যায় প্রথম আলোর ওয়েবসাইট প্রায় ২০ মিনিট বন্ধ ছিল