মুক্তিযুদ্ধের দিনলিপি
ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা ভাবনা
মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পেছনে ছিল দেশ-বিদেশের বহু মানুষের একক ও মিলিত প্রচেষ্টা, অজস্র ঘটনা। এখানে রইল একাত্তরের প্রতিটি দিনের বিবরণ।
ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার রাজনৈতিক কমিটিতে ১৪ নভেম্বর পাকিস্তানের হুমকির কারণে উদ্ভূত পরিস্থিতির পর্যালোচনা করা হয়। মন্ত্রীরা প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর অনুপস্থিতিতে দেশে সংঘটিত ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ পেশ করেন।
প্রধানমন্ত্রী তাঁর সহকর্মীদের বলেন, বাংলাদেশে রাজনৈতিক সমাধানে ইয়াহিয়া খানকে রাজি করতে পশ্চিমা নেতারা কতটা সাফল্য পাবেন, সে ব্যাপারে তাঁর সংশয় আছে।
বৈঠকটি নিয়ে দ্য টাইমস-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, মন্ত্রিসভার রাজনীতিবিষয়ক কমিটির সভায় ইন্দিরা গান্ধী বলেন, পূর্ববঙ্গ সমস্যার গ্রহণযোগ্য সমাধান বের করানোর জন্য ইয়াহিয়াকে রাজি করাতে বিশ্বনেতাদের কিছুদিন সময় দেওয়া উচিত।
তাঁরা ব্যর্থ হলে জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া ভারতের পক্ষে অসংগত হবে না। ইন্দিরার বক্তব্যে বোঝা যায়, আন্তর্জাতিক উদ্যোগে সংকটের অবসান নিয়ে তিনি আশাবাদী নন।
আগামী সপ্তাহের মধ্যে তিনি জরুরি অবস্থা জারি করতে পারেন। তবে এর আগে বিরোধী দলের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করবেন।
ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম দিল্লিতে এক আলোচনা সভায় বলেন, সোভিয়েত-ভারত মৈত্রী ও শান্তি চুক্তি অনুযায়ী কাজ শুরু হয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে কয়েকজন ভারতে ঘুরে গিয়েছেন।
পাকিস্তানের যুদ্ধংদেহী মনোভাবের কারণে নিরাপত্তা মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার আলাপ হয়েছে। ভারতে নিযুক্ত সোভিয়েত রাষ্ট্রদূত এন এম পেগোভও অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন।
নিক্সনের নতুন উদ্যোগ
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম রজার্স এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ভারত-পাকিস্তান আকস্মিক সংঘর্ষের শঙ্কা আছে। পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ।
এ দিনের নিউজউইক ম্যাগাজিনের এক রিপোর্টে বলা হয়, মুক্তিবাহিনীর হাতে পাকিস্তানি সেনারা মার খাচ্ছে। মুক্তিবাহিনীর গেরিলার সংখ্যা এক লাখ।
মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ তীব্রতর
মুজিবনগরে মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তর থেকে ১৪ নভেম্বর এক ঘোষণায় জানানো হয়, মুক্তিযোদ্ধারা বাংলাদেশের সব জেলাতেই পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে প্রচণ্ড লড়াই করছেন।
গুরুত্বপূর্ণ রেল ও সড়ক সংযোগ ধ্বংস করে ঢাকা ও কুমিল্লার সঙ্গে চট্টগ্রামকে বিচ্ছিন্ন করাই মুক্তিবাহিনীর অন্যতম লক্ষ্য। ফেনী, সালদা নদী, নয়নপুর এবং খুলনা জেলার কিছু এলাকা এখন মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে।
ঢাকায় পাকিস্তানিদের কঠোর নিরাপত্তার মধ্যেই মুক্তিযোদ্ধারা তাঁদের তৎপরতা অব্যাহত রেখেছেন।
২ নম্বর সেক্টরের ঢাকা উত্তরের একদল মুক্তিযোদ্ধা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর চলাচলে বিঘ্ন ঘটাতে রাতে ঢাকা-আরিচা সড়কের ধামরাইয়ের ভায়াডুবি সড়কসেতু ধ্বংস করেন।
রাতের অন্ধকারে রেজাউল করিম মানিকসহ (স্বাধীনতার পর মরণোত্তর বীর প্রতীক) অন্য গেরিলাযোদ্ধারা নিঃশব্দে সেখানে পৌঁছান।
তাঁদের আক্রমণে দু-তিনজন নিহত হওয়ার পর বাকি পাকিস্তানি সেনারা পালিয়ে যায়।
গেরিলাযোদ্ধারা তখন সেতু ধ্বংসের কাজ শুরু করেন। এ সময় পাকিস্তানি সেনাদের একটি কনভয় সেখানে এসে তাদের আক্রমণ করে।
প্রচণ্ড যুদ্ধের মধ্যেই রেজাউল করিম মানিকসহ কয়েকজন সেতুটি ধ্বংসের কাজ শেষ করেন।
এরপর তিনি যুদ্ধে যোগ দিয়ে লড়াই করতে থাকেন। রাত আনুমানিক সাড়ে ১০টায় পাকিস্তানি সেনাদের ছোড়া মর্টারের স্প্লিন্টার তাঁর গায়ে আঘাত করলে তিনি শহীদ হন।
একপর্যায়ে পাকিস্তানি সেনারা পিছু হটতে বাধ্য হয়।
সহযোদ্ধারা মানিকের লাশ উদ্ধার করে নিয়ে এলে তাঁর মা-বাবা তাঁকে আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করেন।
রেজাউল করিম মানিক ১৯৭১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন।
এই সেক্টরের নারায়ণগঞ্জের গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল রাতে সিদ্ধিরগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীতে ভাসমান ডকইয়াডে৴ অভিযান চালায়। তাঁদের ছোড়া বোমায় ভাসমান ডকইয়ার্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
৫ নম্বর সেক্টরের একদল মুক্তিযোদ্ধা রাতে সুনামগঞ্জে একটি সড়কসেতু ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেয়। আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা নদীঘাটের ফেরি ধ্বংস করে।
পাকিস্তানি বাহিনীর একটি জিপ তখন ফেরি দিয়ে নদী পার হচ্ছিল। বিস্ফোরণে পাকিস্তানি বাহিনীর কয়েকজন হতাহত হয়। ফেরিটি ডুবে যায়।
৬ নম্বর সেক্টরের ভূরুঙ্গামারী এলাকার একাংশ এদিন মুক্ত হয়।
এ অঞ্চলের দায়িত্বপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল ভূরুঙ্গামারীতে পাকিস্তানিদের একটি অগ্রবর্তী অবস্থানে আক্রমণ করে। কোনো সাড়া না পেয়ে তাঁরা খবর নিয়ে জানতে পারেন, কিছু অস্ত্রশস্ত্র এবং শুকনো খাবার ফেলে পাকিস্তানি সেনারা রাতের অন্ধকারে ওই অবস্থান থেকে পালিয়ে গেছে। ভূরুঙ্গামারীর পাশে জয়মনির হাটের একাংশ এ দিন মুক্তিবাহিনীর দখলে আসে।
সূত্র: স্বাধীনতাসংগ্রামে প্রবাসী বাঙালি, আবদুল মতিন, র্যাডিক্যাল পাবলিকেশনস, লন্ডন, যুক্তরাজ্য; ইত্তেফাক, ঢাকা, ১৫ নভেম্বর ১৯৭১; আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ভারত, ১৫ ও ১৬ নভেম্বর ১৯৭১; দ্য অবজারভার, লন্ডন, যুক্তরাজ্য, ১৪ নভেম্বর ১৯৭১; দ্য টাইমস, লন্ডন, যুক্তরাজ্য, ১৫ নভেম্বর ১৯৭১
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
Also Read
-
তাঁরা বিদেশে বসে ‘বোতাম টেপেন’, আর ঘটনা ঘটে ঢাকায়
-
ঘুষ নিতে বাড়িতে আসা কনস্টেবলকে আটকে ৯৯৯–এ ফোন, তারপর...
-
বিরোধীরা ‘এককাট্টা’, এই বার্তা দিতেই বৈঠক বিএনপির
-
কিরগিজস্তানে বাংলাদেশি ছাত্র খুব জখম হয়েছে এমন খবর নেই: পররাষ্ট্রমন্ত্রী
-
পিছিয়ে গেল রূপপুরের বিদ্যুৎ উৎপাদন