মুক্তিযুদ্ধের দিনলিপি

বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ নিজে প্রাণ দিয়ে সহযোদ্ধাদের বাঁচালেন

মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পেছনে ছিল দেশ-বিদেশের বহু মানুষের একক ও মিলিত চেষ্টা, অজস্র ঘটনা। এখানে রইল একাত্তরের প্রতিটি দিনের বিবরণ।

বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আবদুর রউফ

খাগড়াছড়ির মহালছড়িতে এই দিনে নিজে প্রাণ দিয়ে বহু সহযোদ্ধার জীবন রক্ষা করেন বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ।

খাগড়াছড়ির মহালছড়ি উপজেলা ও রাঙামাটির নানিয়ারচর উপজেলার সীমান্তে কাপ্তাই লেক তখন গুরুত্বপূর্ণ জলপথ। কাপ্তাই-রাঙামাটি-মহালছড়ি-খাগড়াছড়ি-জালিয়াপাড়া হয়ে রামগড়ে যাওয়ার এটিই পথ। এই জলপথ নিয়ন্ত্রণে রাখতে মেজর মীর শওকত আলীর (পরে বীর উত্তম, লেফটেন্যান্ট জেনারেল, রাষ্ট্রদূত ও মন্ত্রী) নির্দেশে ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান চৌধুরীর (পরে লেফটেন্যান্ট কর্নেল) নেতৃত্বে অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ইপিআর সেনা সমন্বয়ে গড়া মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল প্রতিরক্ষা অবস্থান নিয়েছিল।

পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এই জলপথ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার জন্য খুবই তৎপর হয়ে ওঠে। ২০ এপ্রিল দুপুরে তাদের বড় একটি দল স্টিমার ও স্পিডবোটে করে এসে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরক্ষা অবস্থানে তীব্র হামলা চালায়। স্টিমার থেকে বৃষ্টির মতো ছুটে আসা তীব্র গোলাবর্ষণে মুক্তিযোদ্ধারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যান। ইপিআরের ল্যান্স নায়েক মুন্সী আব্দুর রউফ অপরিসীম সাহসের সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাদের মুখোমুখি হয়ে মেশিনগান চালাতে থাকেন। খালেকুজ্জামানসহ মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদ স্থানে সরে গিয়ে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পান। পাকিস্তানি সেনাদেরও ব্যাপক ক্ষতি হয়। বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে মুন্সী আব্দুর রউফ শহীদ হন। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের সরকার তাঁকে মুক্তিযুদ্ধের সর্বোচ্চ বীরত্বসূচক সম্মান ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ উপাধিতে ভূষিত করে।

১৯৭১ সালে লেখা মুন্সী আব্দুর রউফের অভিজ্ঞানপত্র

মুন্সী আব্দুর রউফের শহীদ হওয়ার তারিখ ও স্থান নিয়ে বহু জায়গায় বিভ্রান্তিকর তথ্য রয়েছে। সরকারি–বেসরকারি নানা স্থানে সে তারিখ কোথাও ৮, কোথাও ১৮ এপ্রিল। ১৯৭১ সালে মুন্সী আব্দুর রউফকে নিয়ে লেখা মুজিবনগর সরকারের অভিজ্ঞানপত্র (সাইটেশন) সম্প্রতি প্রথম আলোর হাতে এসেছে। মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি এম এ জি ওসমানী, মীর শওকত আলী এবং চৌধুরী খালেকুজ্জামান স্বাক্ষরিত সে অভিজ্ঞানপত্রে মুন্সী আব্দুর রউফের শহীদ হওয়ার তারিখ ২০ এপ্রিল। যদিও নামের বানান তাতে ছিল মুন্সী আবদুর রব। কয়েক বছর পর সে ভুল সংশোধন করা হয়।

চৌধুরী খালেকুজ্জামান তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, ‘২০ (এপ্রিল) তারিখে মহালছড়ির বাঘমারা নামক একটি পাহাড়ি জায়গায় অবস্থান গ্রহণ করি।...আনুমানিক দুপুর ১২টার সময় অনেক দূরে পাকিস্তানি পতাকাবাহী একটি স্টিমার, কয়েকটি স্পিডবোট এবং নৌকায় সাদা পোশাকে সামরিক এবং বেসামরিক লোক আমরা দেখতে পাই। সঙ্গে সঙ্গে তাদের প্রতিহত করার জন্য তৈরি হই। ...যুদ্ধের জন্য জায়গাটি মোটেও অনুকূলে ছিল না। ...আমার দশ গজ দূরে অবস্থান নিয়ে বীর বিক্রমে যুদ্ধ করছিলেন মুন্সী আবদুর রব (রউফ)। ...তাঁর গুলিবর্ষণে শত্রুপক্ষের ভীষণ ক্ষতি হয় বলে পরবর্তী সময়ে জানা যায়। …তাদের মর্টার শেলিংয়ের ফলে আমাদের ল্যান্স নায়েক মুন্সী আবদুর রব মারাত্মক আহত হন। ...মুন্সী আবদুর রব...নিহত হন। ...আমি তাঁর সাইটেশন লিখি।’

১৯৭১ সালে লেখা মুন্সী আব্দুর রউফের অভিজ্ঞানপত্র

বাংলাদেশ সরকারকে মোজাফফর ন্যাপের সমর্থন

মুক্তাঞ্চল থেকে এক বিবৃতিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ। বাংলাদেশের একমাত্র বৈধ সাংবিধানিক সরকারকে স্বীকৃতি দিতে বিশ্বের গণতন্ত্রকামী রাষ্ট্রের প্রতিও তিনি আহ্বান জানান।

ফ্রেন্ডস অব বাংলাদেশ নামে একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন ‘পূর্ব পাকিস্তানকে বাঁচানো সম্ভব’ শিরোনামে এই দিন একটি প্রচারপত্র প্রকাশ করে। যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাটমিক এনার্জি–সংক্রান্ত যুক্ত কমিটির সদস্য সিনেটর জন ও পেস্টর বাঙালিদের ওপর অমানবিক আচরণের বিরোধিতা করে একটি চিঠি লেখেন।

তাজউদ্দীন, সৈয়দ নজরুলকে সামরিক আদালতের নির্দেশ

পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান এই দিনে আওয়ামী লীগ নেতা তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, আবদুল মান্নান, তোফায়েল আহমদ ও দ্য পিপল সম্পাদক আবিদুর রহমানকে ২৬ এপ্রিল সকাল ৮টায় ঢাকার ১ নম্বর সামরিক আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেন।

নেজামে ইসলাম পার্টির নেতাসহ কয়েকজন ঢাকায় এক যুক্ত বিবৃতিতে ভারতের সহযোগিতায় মুক্তিযোদ্ধাদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকে পাকিস্তানের সার্বভৌমত্বের ওপর হামলা বলে উল্লেখ করেন।

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি বড় দল মিরসরাইয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর তীব্র আক্রমণ চালায়। সকাল থেকে সন্ধ্যা যুদ্ধে দুই পক্ষেরই প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। রাতে মুক্তিযোদ্ধারা মাস্তান নগরে সরে যান। মধ্যরাতে পাকিস্তানি বাহিনী মাস্তান নগর ট্যাংক নিয়ে আক্রমণ করে। ভোররাতে মুক্তিবাহিনী হিংগুলিতে গিয়ে অবস্থান নেয়।

উত্তরবঙ্গের হিলিতেও পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। একপর্যায়ে তারা অবস্থান ছেড়ে দিয়ে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে চলে যায়।

সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ১ ও ৭; সামরিক জীবনের স্মৃতি: ১৯৬৪–১৯৮১, চৌধুরী খালেকুজ্জামান, ইউপিএল; দৈনিক পাকিস্তান, ২১ এপ্রিল ১৯৭১


গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান