মুক্তিযুদ্ধের দিনলিপি

বাংলাদেশ নিয়ে জাতিসংঘে বিতর্ক

মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পেছনে ছিল দেশ-বিদেশের বহু মানুষের একক ও মিলিত চেষ্টা, অজস্র ঘটনা। এখানে রইল একাত্তরের প্রতিটি দিনের বিবরণ।

জাতিসংঘের দুটি কমিটিতে ২ নভেম্বর বাংলাদেশ নিয়ে বিতর্ক হয়। ভারত জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সামাজিক, মানবিক ও সংস্কৃতিবিষয়ক তৃতীয় কমিটিতে পাকিস্তানের বাংলাদেশ নীতির তীব্র সমালোচনা করে। ভারত অভিযোগ করে, পাকিস্তান পূর্ব বাংলায় জাতিবৈষম্য নীতি অনুসরণ করছে। ভারতের প্রতিনিধি বি পি দাস এই বক্তব্য দেন।
এর আগে পাকিস্তানে প্রতিনিধি ফাতেমা সাদেক এই কমিটিতে বলেন, সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানে ভারত আগ্রহী নয়। তাদের অবিরাম হস্তক্ষেপে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সমস্যা প্রকট হয়েছে। ভারত সীমান্তে সেনা সমাবেশ করছে।
বিশেষ কমিটিতে দক্ষিণ আফ্রিকা সরকারের বর্ণবৈষম্য নীতির নিন্দা করে যে আলোচনা হয়, সেখানেও বাংলাদেশ প্রসঙ্গ ওঠে। ভারতের প্রতিনিধি বলেন, বাংলাদেশে যেখানে জনসাধারণ গৃহচ্যুত, গ্রামগুলো বিধ্বস্ত, হাজার হাজার নারী-শিশু অনাহারে মৃত্যুমুখে, সেখানে শুধু সহানুভূতি প্রকাশ করে মানুষের বিবেক ক্ষান্ত থাকতে পারে না।

আরও কূটনীতিকের পক্ষত্যাগ

সুইজারল্যান্ডের পাকিস্তান দূতাবাসের বাঙালি দ্বিতীয় সচিব ওয়ালিউর রহমান ২ নভেম্বর পদত্যাগ করে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। ওয়ালিউর রহমান এর আগে সুইজারল্যান্ডে পাকিস্তান মিশনের ভারপ্রাপ্ত মিশন প্রধান হিসেবে কিছুদিন কাজ করেন।
জাপানের পাকিস্তান দূতাবাসের দুজন বাঙালি কর্মকর্তা প্রেস অ্যাটাশে এস এম মাসুদ এবং তৃতীয় সচিব এম এ রহিম এই দিন ঘোষণা করেন, বাংলাদেশে পশ্চিম পাকিস্তানি সরকারের অমানবিক নির্যাতন বরদাশত করতে না পেরে পদত্যাগ করেছেন। তাঁরা বাংলাদেশ আন্দোলনে যোগ দেওয়ার কথা জানান।
দিল্লির পাকিস্তান হাইকমিশনের ১১ জন বাঙালি কর্মীর মধ্যে ১০ জন এদিন পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করেন। হাইকমিশন ভবন থেকে তাঁরা সপরিবার পালিয়ে বাইরে আসেন। হোসেন আলী নামের একজন আসতে পারেননি। পাকিস্তানিরা তাঁকে আটক করে রাখে। তাঁর সঙ্গে তাঁর স্ত্রী ও তিন মেয়েও আটক ছিলেন, তবে তাঁর দুই ছেলে পালিয়ে আসে।
পাকিস্তান হাইকমিশনের বাঙালি কর্মীদের হাইকমিশন ভবন থেকে বেরিয়ে আসার খবর পেয়ে দিল্লির বাংলাদেশ মিশনের প্রধান হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী এবং তাঁর দুই সহকর্মী ঘটনাস্থলে যান। তাঁরা তাঁদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করেন। পরে পুলিশ তাঁদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে।

মুক্তিবাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের অভিযান

বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর প্রধান কর্নেল এম এ জি ওসমানী এই দিন মুজিবনগরে বলেন, বাংলাদেশের মানুষের মনোবল অটুট। বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানি সেনাদের হটে যেতেই হবে এবং সেটা আসন্ন। পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিবাহিনীর হাতে প্রচণ্ড মার খাওয়ার কারণে ভারত আক্রমণের উদ্যোগ নিচ্ছে।
১ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা ফেনীর পরশুরাম ও ফুলগাজীর মাঝামাঝি এলাকায় রাতে অ্যামবুশ করেন। ভোরে পাকিস্তানি বাহিনীর ১০ জনের একটি দল টহলে বেরিয়ে ফেনী-বেলুনিয়া রেললাইন দিয়ে একটি ট্রলিতে করে সেখানে উপস্থিত হলে মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ করেন। আকস্মিক এ আক্রমণে একজন লেফটেন্যান্টসহ সবাই নিহত হয়।
গোলাগুলির শব্দ পেয়ে ফুলগাজী থেকে ৪০-৪৫ জন পাকিস্তানির একটি রিইনফোর্সমেন্ট দল এগিয়ে আসে। দলটি রেললাইনের পূর্ব-পশ্চিম দিক এবং রেললাইনের সমান্তরাল বেলুনিয়া-ফেনী সড়কে অবস্থান নেয়। মুক্তিযোদ্ধারা এবারও তাদের ওপর আক্রমণ করলে বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়।
২ নম্বর সেক্টরের একদল মুক্তিযোদ্ধা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবার কাইমপুরে পাকিস্তানি সেনাঘাঁটিতে মর্টার হামলা চালান। এতে পাকিস্তানি বাহিনীর দুজন নিহত ও চারজন আহত হয়। আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা মইনপুরে অ্যামবুশ করেন। এতে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার হতাহত হয়।
এই সেক্টরে মুক্তিযোদ্ধারা নারায়ণগঞ্জের দেওভোগে শান্তি কমিটির স্থানীয় সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযান চালান। অভিযানে স্থানীয় শান্তি কমিটির এক সদস্য নিহত হয়।
৪ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা মৌলভীবাজারের জুড়ী থানার লাঠিটিলায় একটি সেতুর পাশে অ্যামবুশ করেন। ভোরে একদল পাকিস্তানি সেনা অ্যামবুশ এলাকায় এলে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের আক্রমণ করেন। আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনীর বেশ কয়েকজন হতাহত হয়।
১১ নম্বর সেক্টরের একদল মুক্তিযোদ্ধা শেরপুরের শ্রীবর্দী থানায় ভায়াডাঙ্গায় পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্পে আক্রমণ করেন। এতে পাকিস্তানি বাহিনীর কয়েকজন হতাহত হয়।
মুক্তিবাহিনীর নৌকমান্ডোরা মোংলা বন্দরে লিমপেট মাইনের সাহায্যে দুটি জাহাজ ক্ষতিগ্রস্ত করেন।

অবরুদ্ধ বাংলাদেশে

জাতীয় পরিষদের উপনির্বাচনে চূড়ান্ত ঘোষণা সাপেক্ষে ৫৫ জন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা যায়, প্রদেশে জাতীয় পরিষদের উপনির্বাচনে ২৩ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। আসনগুলোতে ৫৬ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন।
পাকিস্তান সেনাবাহিনী ভারতের নদীয়া জেলার শিকারপুর সীমান্ত থেকে চব্বিশ পরগনার হিঙ্গলগঞ্জ-টাকি সীমান্তে বিস্তৃত প্রায় ৩০০ বর্গমাইল এলাকাজুড়ে বিভিন্ন স্থানে গোলাবর্ষণ করে। তারা শিকারপুর, বয়রা ও ভোমরা এলাকায় বারবার গোলাবর্ষণ করলে ভারতীয় বাহিনীও পাল্টা জবাব দেয়।
সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর এক, দুই ও এগারো; ইত্তেফাক, ঢাকা, ৩ নভেম্বর ১৯৭১, আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ভারত, ৩ ও ৪ নভেম্বর ১৯৭১
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান