মুক্তিযুদ্ধের দিনলিপি

বাংলাদেশের দুর্দশায় উদাসীনতা অনুচিত

মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পেছনে ছিল দেশ–বিদেশের বহু মানুষের একক ও মিলিত প্রচেষ্টা, অজস্র ঘটনা। এখানে রইল একাত্তরের প্রতিটি দিনের বিবরণ।

ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি দেশটির স্বাধীনতার ২৪তম বার্ষিকীর প্রাক্কালে ১৪ আগস্ট জাতির উদ্দেশে এক বেতার ভাষণে বাংলাদেশের শরণার্থীদের মর্মান্তিক দুঃখ–দুর্দশার কথা উল্লেখ করে বলেন, অভ্যন্তরীণ সার্বভৌমত্ব বা শক্তি–সাম্যের আদিম ধারণা অনুযায়ী বিশ্বের জাতিসমূহের পক্ষে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের অপরিসীম এবং দীর্ঘ দুঃখ-দুর্দশার ব্যাপারে উদাসীনতা অনুচিত।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী রাজ্যসভায় বলেন, ভারত-সোভিয়েত চুক্তি বাংলাদেশকে ভারতের স্বীকৃতিদানের পথরোধ করবে বলে নিউইয়র্ক টাইমস­–এ প্রকাশিত খবরটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।

ভারতের কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম সংসদের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় ভারত-সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তি নিয়ে আলোচনাকালে বলেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমাধানের একমাত্র অর্থ ওই অঞ্চলের স্বাধীনতা। বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেছেন, স্বাধীনতা ছাড়া অন্য কিছুতেই তাঁরা সন্তুষ্ট হবেন না। পাকিস্তানের উন্মাদনা বন্ধ করতে এই চুক্তির সুনির্দিষ্ট ভূমিকা রয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটের শরণার্থীবিষয়ক সাব–কমিটির চেয়ারম্যান সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি দিল্লিতে সাংবাদিকদের বলেন, পাকিস্তান যে যুদ্ধে নামতে পারে, ভারতের এই আশঙ্কা অমূলক নয়। শরণার্থীশিবিরগুলোতে গিয়ে তিনি যা দেখেছেন ও বুঝেছেন, তা থেকে তাঁর ধারণা হয়েছে, দ্রুতই বাংলাদেশের শরণার্থী আগমন কমার কিংবা তা বন্ধ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।

বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামীদের সাহায্যার্থে কলকাতার রবীন্দ্রসরোবর স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ ফুটবল দল তৃতীয় প্রদর্শনী খেলায় অংশ নেয়। খেলায় বাংলাদেশ দল দক্ষিণ কলকাতা স্পোর্টস ফেডারেশন দলকে ৪-২ গোলে হারিয়ে প্রথম জয়লাভের কৃতিত্ব অর্জন করে। প্রথম খেলায় তারা নদীয়ার সঙ্গে ২-২ গোলে ড্র করে। দ্বিতীয় খেলায় গোষ্ঠ পাল একাদশের কাছে ৪-২ গোলে পরাজিত হয়।

ইয়াহিয়ার জবাবদিহি প্রয়োজন

ব্রিটেনের ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকা ১৪ আগস্ট সম্পাদকীয় নিবন্ধে জানায়, শেখ মুজিব আদৌ বেঁচে আছেন কি না, ইয়াহিয়া খানকে এ প্রশ্নের জবাব দিতে হবে। কারণ, শেখ মুজিব পাকিস্তানি সেনাদের হাতে বন্দী হয়েছিলেন। তারপর বাইরের কেউ তাঁকে দেখেনি। তাঁর কথা শোনেনি। তাঁর সম্পর্কে যা কিছু, তা ইয়াহিয়াই বলেছেন। সভ্য সমাজের কাছে ইয়াহিয়াকে এর জবাবদিহি করা প্রয়োজন।

পূর্ব জার্মানির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র সাংবাদিকদের বলেন, শেখ মুজিবুর রহমানকে শাস্তি দেওয়া হলে বিশ্ব শান্তি বিপন্ন হবে। তিনি বলেন, পূর্ব জার্মান সরকারের পক্ষ থেকে পাকিস্তান সরকারের কাছে শেখ মুজিবের বিচার বন্ধ এবং বাংলাদেশের সমস্যার রাজনৈতিক মীমাংসা করে নেওয়ার জন্য জরুরি অনুরোধ জানানো হয়েছে।

ইন্দোনেশিয়া সফররত ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং জাকার্তায় বলেন, বাংলাদেশ সমস্যা সম্পর্কে তিনি এবং ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী অনেকটা একমত হয়েছেন। দুই দিন আলোচনার পর এক যুক্ত ইশতেহারে তাঁরা বলেন, ভারতে যেভাবে বাংলাদেশি শরণার্থী আসছেন, সেটা নিয়ে তাঁরা বিশদ আলোচনা করেছেন এবং এর পেছনে যেসব করুণ কাহিনি রয়েছে, সেগুলো সম্পর্কেও তাঁরা গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন।

ভয়েস অব আমেরিকা জানায়, শরণার্থীদের স্বদেশে ফিরিয়ে নিতে পাকিস্তান ভারতের সঙ্গে অর্থপূর্ণ আলোচনায় বসতে চায়। জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্টের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে পাকিস্তান এই আশা প্রকাশ করে যে বন্ধুরাষ্ট্রগুলোর পরামর্শে ভারতও আলোচনায় রাজি হবে। ভারতের গত ২ আগস্টের চিঠির জবাবে পাকিস্তান এই চিঠি দেয়।

ঢাকা শহরে গেরিলা অভিযান

পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে ঢাকার কার্জন হলে পাকিস্তানের ঐক্য বিষয়ে এক আলোচনা সভা চলাকালে মুক্তিযোদ্ধারা সেখানে গেরিলা অভিযান পরিচালনা করেন। সভাস্থলের কাছাকাছি মুক্তিযোদ্ধাদের নিক্ষেপ করা কয়েকটি বোমা বিস্ফোরিত হলে সভায় চরম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। অন্য একদল মুক্তিযোদ্ধা বোমা দিয়ে বিদ্যুতের খুঁটি উড়িয়ে দিয়ে ঢাকার তেজগাঁও, মালিবাগসহ কয়েকটি জায়গার বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেন।

চট্টগ্রামে মুক্তিবাহিনীর একটি দল মিরসরাই হয়ে চট্টগ্রাম শহরের দিকে যাওয়ার পথে মিয়াজান ঘাটে একদল পাকিস্তানি সেনার সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে লিপ্ত হয়। যুদ্ধে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনাকে হতাহত করে মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদে নিজ অবস্থানে চলে যান।

মুক্তিবাহিনীর গেরিলা যোদ্ধারা নরসিংদীর ঘোড়াশালের কাছে ঝিনারদি রেলওয়ে স্টেশনের পাশে একটি গ্রামে পাকিস্তানি সেনাদের ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। তিন ঘণ্টা যুদ্ধের পর কয়েকজন হতাহত সেনাকে ফেলে তারা নরসিংদীর দিকে পালিয়ে যায়।

এ ছাড়া মুক্তিযোদ্ধারা নোয়াখালী জেলার কোম্পানীগঞ্জ থানার বসুরহাটে এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাটে পাকিস্তানি মিলিশিয়াদের ওপর আক্রমণ করে। দুই জায়গাতেই পাকিস্তানি সেনারা হতাহত হয়। বসুরহাটের সংঘর্ষে একজন মুক্তিযোদ্ধা গুরুতর আহত হন।

নওগাঁর মহাদেবপুরের হাপুনিয়া সড়কে মুক্তিবাহিনীর পুঁতে রাখা ডিনামাইটের বিস্ফোরণে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি জিপ ক্ষতিগ্রস্ত এবং কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়।

নওগাঁর ধামইরহাটের সীমান্তবর্তী কুলফৎপুর গ্রামে পাকিস্তান সেনারা ১৮ জন কৃষককে সার বেঁধে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে। ঘটনাস্থলেই ১৪ জন শহীদ হন। ১২ জন শহীদকে কালাহারের পুকুরপাড়ে এবং দুজন শহীদকে গ্রামের উত্তর পাড়ায় কবর দেওয়া হয়।

সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর এক, দুই, তিন ও সাত; দৈনিক পাকিস্তান, ১৫ ও ১৬ আগস্ট ১৯৭১; আনন্দবাজার পত্রিকাযুগান্তর, ভারত, ১৫ও ১৭ আগস্ট ১৯৭১

গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান