মুক্তিযুদ্ধের দিনলিপি

বঙ্গবন্ধু নিয়ে নিক্সনকে ইয়াহিয়ার আশ্বাস

মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পেছনে ছিল দেশ বিদেশের বহু মানুষের একক ও মিলিত প্রচেষ্টা, অজস্র ঘটনা। এখানে রইল একাত্তরের প্রতিটি দিনের বিবরণ।

মিসরের সংবাদপত্র আল আহরাম­-এ ১২ অক্টোবর এক নিবন্ধে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ইয়াহিয়া খানের কাছ থেকে আশ্বাস পেয়েছেন যে বিচারের ফল যা-ই হোক না কেন, শেখ মুজিবুর রহমানকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলানো হবে না। পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য এবং নিবন্ধ লেখক ড. ক্লোভিমা ম্যাক সাঈদ বিশ্বাসযোগ্য একটি পাকিস্তানি সূত্র থেকে এ তথ্য পেয়েছেন বলে জানান।

ইয়াহিয়া খান এই দিন এক বেতার ভাষণে ২৭ ডিসেম্বর জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান এবং শাসনতন্ত্র প্রকাশের কথা ঘোষণা করেন। অধিবেশনের পরপরই তিনি কেন্দ্রীয় সরকার গঠন করবেন এবং পরিষদ খসড়া শাসনতন্ত্র নিয়ে আলোচনা শুরু করবে। তিনি বলেন, ভারত শিগগিরই পাকিস্তানকে আক্রমণ করবে মনে হচ্ছে। তবে তাঁর বাহিনী সম্পূর্ণ সজাগ এবং সতর্ক রয়েছে।

ইয়াহিয়ার বক্তৃতায় প্রতিক্রিয়া

ইয়াহিয়ার বক্তৃতার পরপরই ভারতের প্রতিরক্ষা মহল দিল্লিতে সাংবাদিকদের বলেন, ভারতের বিরুদ্ধে
ইয়াহিয়ার যুদ্ধের হুমকি গুরুত্বের সঙ্গে পর্যালোচনা করা হচ্ছে। ভারতীয় প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণে প্রস্তুত।

বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র এবং ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী এ এইচ এম কামারুজ্জামান বলেন, ইয়াহিয়ার বেতার ভাষণের পর ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের সঙ্গে তাঁর আলোচনা হয়েছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ সম্পর্কে কোনো কথা বলার অধিকার ইয়াহিয়া খানের নেই। কারণ, তিনি বিদেশি আক্রমণকারী এবং বাংলাদেশ এখন স্বাধীন রাষ্ট্র।

দিল্লির পাকিস্তান হাইকমিশনের সাবেক উপদেষ্টা এবং সদ্য পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশকারী হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী সাংবাদিকদের আরও বলেন, তিনি তাঁর আবাস ও আসবাব বাংলাদেশ সরকারের হাতে তুলে দিয়েছেন। কারণ, আইনগতভাবে তা বাংলাদেশেরই প্রাপ্য।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সৃষ্টির লক্ষ্যে অরুণকুমার নন্দী ১২ অক্টোবর ভোররাত ২টা ৪০ মিনিট পর্যন্ত একটানা ৯০ ঘণ্টা ৫ মিনিট সাঁতরে বিশ্ব রেকর্ড করেন। অরুণ নন্দী ৮ অক্টোবর শুক্রবার সকাল ৮টা ৩৫ মিনিটে চাঁদপুর সম্মিলনীর পৃষ্ঠপোষকতায় এবং বউবাজার ব্যায়াম সমিতির আয়োজনে কলকাতার কলেজ স্কয়ার পুকুরে সাঁতার শুরু করেন।

বিদেশি বন্ধুদের সহমর্মিতা

যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র জানান, অপারেশন ওমেগা দলের দুজন সদস্য ৪ অক্টোবর বাংলাদেশে ঢোকার পর পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাঁদের আটক করে যশোর জেলে পাঠায়। পাকিস্তান প্রশাসন তাঁদের দুই বছরের কারাদণ্ড দেয়। অপারেশন ওমেগার একজন মুখপাত্র জানান, কারাদণ্ড দেওয়া সত্ত্বেও অবরুদ্ধ বাংলাদেশে আবার তাঁরা সদস্য পাঠাবেন।

বুলগেরিয়ার মুসলমান সম্প্রদায়ের প্রধান মুফতি হাসান আদেমভ এবং দক্ষিণ বুলগেরিয়ার স্মলিয়ানের মুফতি ইউসেইন সেফরকভ ১২ অক্টোবর বাংলাদেশের শরণার্থীদের স্বদেশে ফিরিয়ে নিতে ইয়াহিয়ার কাছে আবেদন জানান।

গেরিলা অভিযান

১১ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা ভোরে কয়েকটি দলে পাকিস্তানি বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি চিলমারী বন্দরে সমন্বিত আক্রমণ চালান। দীর্ঘ যুদ্ধের পর বলবাড়ি রেলস্টেশন ও ওয়াপদা ভবন বাদে পুরো চিলমারীর নিয়ন্ত্রণ মুক্তিযোদ্ধারা নিয়ে নেন। বহু পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার হতাহত ও বন্দী হয়। চিলমারীতে একটি ছোট দল রেখে মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্রশস্ত্র ও যুদ্ধবন্দীদের নিয়ে রৌমারীতে ফিরে আসেন।

টাঙ্গাইল থেকে খাদ্য ও রসদ নিয়ে এলাসিন হয়ে নাগরপুর যাওয়ার পথে কাদেরিয়া বাহিনীর আক্রমণের মুখে কয়েকজন রাজাকার হতাহত হয়। বাকিরা পালানোর সময় ধরা পড়ে।

১ নম্বর সেক্টরের একদল মুক্তিযোদ্ধা ফেনীর পরশুরামে অ্যামবুশ করে একদল পাকিস্তানি সেনার দুজন নিহত ও একজন আহত করেন।

২ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল রকেট লঞ্চার ও মেশিনগানের সাহায্যে পাকিস্তানি বাহিনীর কালীরবাজার অবস্থানে আক্রমণ করে। এতে সেনা ও রাজাকার সমন্বয়ে গড়া পাকিস্তানি বাহিনীর কয়েকজন হতাহত এবং পাকিস্তানিদের দুটি বাংকার ধ্বংস হয়।

৫ নম্বর সেক্টরের একদল মুক্তিযোদ্ধা জেড ফোর্সের সহায়তায় ছাতক সার কারখানা আক্রমণের লক্ষ্যে ছাতকের কাছে মহড়াটিলা ও জয়নগর টিলাতে অবস্থান নেন। খবর পেয়ে পাকিস্তানি সেনারাও প্রস্তুতি নিয়ে এগিয়ে আসে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল আক্রমণের মুখে তারা পর্যুদস্ত হয়।

৭ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি বাহিনীর গড়াগড়ি ও সুলতানপুর অবস্থানে হামলা করলে বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। একজন মুক্তিযোদ্ধাও আহত হন।

৮ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা দুপুর ১২টার দিকে ঝিনাইদহের মহেশপুরের শ্রীরামপুরে পাকিস্তানি সেনাদের ওপর আক্রমণ চালান। অতর্কিত এ আক্রমণে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার নিহত হয়। এই সেক্টরের বয়রা সাব-সেক্টরের অন্য মুক্তিযোদ্ধারা অ্যামবুশ করে পাকিস্তানি সেনাদের হতাহত করেন।

মুক্তিযোদ্ধারা সাতক্ষীরার ভেটখালীর রাজাকার ক্যাম্পে আক্রমণ করলে রাজাকাররা ক্যাম্প ছেড়ে পালিয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা বিস্ফোরক দিয়ে ক্যাম্পটি ধ্বংস করে দেন।

ঢাকায় পাকিস্তানপন্থীদের তৎপরতা

পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি), কাইয়ুম মুসলিম লীগ, জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের প্রতিনিধিসহ কয়েকজন কট্টর পাকিস্তানপন্থী নেতা ঢাকায় সফররত পিপিপির প্রতিনিধিদলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তাঁরা পিপিপিতে যোগ দিয়ে উপনির্বাচনে অংশ নেওয়ার ইচ্ছার কথা জানান।

সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র, খণ্ড দশ ও এগারো; বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর এক, দুই ও আট; ইত্তেফাক, ঢাকা, ১৩ অক্টোবর ১৯৭১; আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ভারত ১৩ ও ১৪ অক্টোবর ১৯৭১

গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান