মুক্তিযুদ্ধের দিনলিপি
বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে মিছিলের ঢেউ
মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পেছনে ছিল দেশ-বিদেশের বহু মানুষের একক ও মিলিত চেষ্টা, অজস্র ঘটনা। এখানে রইল একাত্তরের প্রতিটি দিনের বিবরণ।

একাত্তরের ১৭ মার্চ ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৫২তম জন্মদিন। দিনটি আর দশটি দিনের মতো স্বাভাবিক ছিল না। আগের দিন ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর বৈঠক কোনো পরিণতির দিকে এগোয়নি। আজ সেই অসমাপ্ত বৈঠকের দ্বিতীয় দফা। একদিকে বৈঠক চলছে, আরেক দিকে সারা দেশ উদ্বেলিত হয়ে আছে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায়। শহরগুলো মিছিলের নগরী।
বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন উপলক্ষে সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত সমাজের সর্বস্তরের মানুষ মুহুর্মুহু মিছিল করে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডে আসে। বাসভবনের সামনের রাস্তা লোকারণ্য হয়ে যায়। তাঁরা বাসভবনে গিয়ে বঙ্গবন্ধুকে শুভেচ্ছা জানান। তাঁদের শুভেচ্ছাবার্তার সঙ্গে মিশে ছিল মুক্তির জন্য আকুল বার্তা।
শেখ মুজিবের বাসভবনে অত্যন্ত অনাড়ম্বর পরিবেশে তাঁর জন্মদিন পালন করা হয়। রাত পর্যন্ত দলীয় কর্মী ছাড়াও বিভিন্ন ব্যক্তি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে শুভেচ্ছা সাক্ষাতে মিলিত হন। বায়তুল মোকাররম মসজিদে বাদ আসর মিলাদ শেষে শেখ মুজিবের দীর্ঘায়ু কামনা করে বিশেষ মোনাজাত হয়। সন্ধ্যায় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হয়।
ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আলোচনা শেষে বাসভবনে পৌঁছানোর পর দেশি-বিদেশি সাংবাদিকেরা শেখ মুজিবের সঙ্গে ঘরোয়া আলোচনায় মিলিত হয়েছিলেন।
একজন বিদেশি সাংবাদিক জানতে চান, এই জন্মদিনে তাঁর সবচেয়ে বড় কামনা কী? শেখ মুজিব বলেন, ‘জনগণের সার্বিক মুক্তি।’ এরপর তিনি আরও যোগ করেন, ‘আমি জন্মদিন পালন করি না। আমার জন্মদিনে মোমবাতি জ্বালাই না, কেকও কাটি না। আমি জনগণেরই একজন। আমার জন্মদিনই কী, আর মৃত্যুদিনই কী!’
অন্য এক প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমি বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করছি। আমি যখন আলোচনা করি, অবশ্যই আমার দাবির কথাও বলি।’ তিনি বলেন, আলোচনা ফলপ্রসূ হচ্ছে নাকি নিরর্থক হচ্ছে, বলা যাচ্ছে না। শুধু বলা চলে, আলোচনা চলছে। তবে এর পাশাপাশি আন্দোলনও চলছে। মূল লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত এ আন্দোলন চলবে।
ইয়াহিয়ার সঙ্গে দ্বিতীয় দফা বৈঠক
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সকালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে ঢাকায় দ্বিতীয় দফা বৈঠকে বসেন। আলোচনা শুরু হয় সকাল ১০টায় ঢাকার প্রেসিডেন্ট ভবনে (বর্তমানে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন সুগন্ধা) রুদ্ধদ্বার কক্ষে। চলে প্রায় ঘণ্টাব্যাপী। আলোচনায় শেখ মুজিব ও ইয়াহিয়া খান ছাড়া তৃতীয় কোনো ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন না। বৈঠক শেষে প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে বের হয়ে এলে বিপুলসংখ্যক সাংবাদিক ও আলোকচিত্রী শেখ মুজিবকে ঘিরে ধরেন। সাংবাদিকদের তিনি বলেন, আলোচনা শেষ হয়ে যায়নি। তবে পরবর্তী বৈঠকের সময়ও ঠিক করা হয়নি। লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। এ সময় তাঁকে গম্ভীর দেখাচ্ছিল।
দিনটি ছিল অসহযোগ আন্দোলনের ১৬তম দিবস। অফিস-আদালত ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এই দিনও বন্ধ ছিল। ঢাকায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সভা ও শোভাযাত্রা করে। হাজার হাজার মানুষ শহীদ মিনারে গিয়ে বঙ্গবন্ধু ঘোষিত স্বাধীনতাসংগ্রামকে সফল করার শপথ নেন। শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মাঠসহ বিভিন্ন এলাকায় কুচকাওয়াজ ও রাইফেল চালনার প্রশিক্ষণ শুরু করেন।
‘পূর্ব বাংলা এখন স্বাধীন’
সন্ধ্যায় চট্টগ্রামে স্থানীয় সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে ভাসানী ন্যাপ প্রধান মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী বলেন, পূর্ব বাংলা এখন স্বাধীন। সাড়ে সাত কোটি বাঙালি এখন স্বাধীনতার প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ। তিনি বলেন, একটি সর্বজনীন দাবিতে মানুষের মধ্যে এখনকার মতো এমন একতা ও সহযোগিতা এর আগে আর কখনো তিনি দেখেননি। রাতে তিনি চট্টগ্রাম থেকে বঙ্গবন্ধুকে এক তারবার্তায় চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর গণহত্যা সম্পর্কে সরেজমিনে অবহিত হওয়ার জন্য তাঁর পক্ষ থেকে প্রতিনিধি পাঠানোর পরামর্শ দেন।
পাকিস্তান দিবস নয়, প্রতিরোধ দিবস
স্বাধীন বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবসকে ‘প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে পালনের কর্মসূচি ঘোষণা করে। ২৩ মার্চ সকাল ছয়টায় সরকারি-বেসরকারি অফিস, আদালত, শিক্ষা ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এবং সব ধরনের যানবাহনে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন, প্রভাতফেরি, শহীদদের মাজার জিয়ারত, শহীদ মিনারে ফুলের মালা দেওয়া, ‘জয় বাংলা’ বাহিনীর কুচকাওয়াজ এবং বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বটতলায় ছাত্র-জনসভায় কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়।
পাকিস্তানের তৎপরতা
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টোকে ঢাকায় আসার আমন্ত্রণ জানান। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি হামুদুর রহমানকেও তিনি ঢাকায় ডেকে পাঠান। সাবেক আইনমন্ত্রী বিচারপতি এ আর কর্নেলিয়াস সকালে ঢাকায় প্রেসিডেন্ট ভবনে প্রেসিডেন্টের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার লেফটেন্যান্ট জেনারেল এস ই এম পীরজাদার সঙ্গে বৈঠক করেন।
লাহোরে পশ্চিম পাকিস্তানি কয়েকজন রাজনীতিক আলাদা আলাদা বিবৃতিতে ভুট্টোর দুই অংশের দুটি সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রস্তাব প্রসঙ্গে বলেন, সাধারণ নির্বাচন হয়েছে সমগ্র দেশের জন্য, দুই অংশের জন্য আলাদাভাবে নির্বাচন হয়নি। তাই জাতীয় পরিষদে একটিমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠ দলই থাকবে। ভুট্টোর প্রস্তাব পাকিস্তানকে বিভক্ত করার ষড়যন্ত্র।
সূত্র: ইত্তেফাক ও সংবাদ, ১৮ মার্চ ১৯৭১
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান।
Also Read
-
শাহবাগ থানা ঘেরাও, শাহরিয়ার হত্যায় আসামিদের গ্রেপ্তারে ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম
-
কাকরাইলে জগন্নাথের শিক্ষার্থীদের অবস্থান, দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত একচুল না সরার ঘোষণা
-
জুবাইদা রহমানকে প্রার্থী হিসেবে চেয়ে নগরজুড়ে পোস্টার, বিএনপিতে নানা আলোচনা
-
‘স্যার, ফিনিশ’ বলে নিশ্চিত করা সেই হত্যার তদন্তে এবার সিআইডি
-
পুলিশে দুই স্তরে নিয়োগের চিন্তা, এসআই পদে সরাসরি নয়